
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
সবুজের মাঝে সর্বনাশা রেস্তোরাঁ
প্রকাশ: ০৭ মে ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পাদকীয়
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে রেস্তোরাঁ ও হাঁটার পথ বা 'ওয়াকওয়ে' নির্মাণের যে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই সুবিবেচনার পরিচয় বহন করে না। এই উদ্যান কেবল স্বাধীনতা ও স্বাধিকার সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িতই নয়; রাজধানী অন্যতম প্রধান সবুজ হূৎপিণ্ড। সেখানেই রেস্তোরাঁর মতো স্থাপনা বসাতে হবে কেন? আর প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষুণ্ণ করে কংক্রিটের 'ওয়াকওয়ে' নির্মাণেরই বা প্রয়োজন কী? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই রয়েছে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু গাছ কাটা এবং অন্যত্র আরও বেশি গাছ রোপণের আমরা বিরোধিতা করি না। কিন্তু এর নাম করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের ঠিকাদারি ও বাণিজ্যিক স্বার্থ চরিতার্থ করা হবে কেন? রেস্তোরাঁ কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করবে, আমাদের বোধগম্য নয়। বিশেষত রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই উদ্যানের চারপাশে যেখানে খাবারের দোকানে ভরা, সেখানে উদ্যানের ভেতরেই গাছ কেটে রেস্তোরাঁ বসাতে হবে কেন? আমরা দেখেছি, এর আগে সবুজ বাঁচানোর স্বার্থে ওই উদ্যানে স্বাধীনতা জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে ভূগর্ভে।
তাই এমন প্রশ্ন অমূলক হতে পারে না- রেস্তোরাঁর গুরুত্ব কি স্বাধীনতা জাদুঘরের চেয়ে বেশি? আমরা আরও উদ্বিগ্ন যে, এ ধরনের অবিমৃষ্যকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তর। সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এভাবে পরিবেশবিরোধী অবস্থান নিতে পারে- আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এই মহানগরীতে এমনিতেই উন্মুক্ত এলাকা কমে যাচ্ছে। মুক্ত বায়ু সেবনের সুযোগ আরও কম। এক সময় নদী, খাল, পুকুর, মাঠ, উদ্যানে সুশোভিত এই নগরে এমনিতেই সবুজ কমে যাচ্ছে। অনেক খাল দখল হওয়ার পর, অনেক নদী হারিয়ে যাওয়ার পর, অনেক পুকুর ভরাট হওয়ার পর, অনেক উদ্যান উজাড় হওয়ার পর যে সামান্য কয়েকটি সবুজ-ঢাকা এলাকা এখনও কোনো রকমে টিকে রয়েছে; সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তার একটি। আমরা জানি, উদ্যান ও জলাশয় যে কোনো নগর ব্যবস্থারই হূৎপিণ্ড বলে বিবেচিত। এখন যদি আমাদের সবুজ হূৎপিণ্ডগুলোকে ক্রমেই কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করি, তাহলে এমনিতেই ধুঁকতে থাকা এই নগরী বাঁচবে কীভাবে? এই প্রশ্নও বড় হয়ে দাঁড়ায়- বারবার ঢাকার উদ্যানগুলোই হুমকির মুখে পড়ে কেন? চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর তাঁতীবাজারের প্রবেশমুখে অবস্থিত উদ্যোগ 'নগরে নিসর্গ' গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে ময়লার ভাগাড় তৈরি করতে দেখেছি আমরা। গত বছর নভেম্বরে ওসমানী উদ্যানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ দেখেছি। আমাদের প্রশ- সরকারের নগর পরিকল্পনাকারীরা কি তাহলে আধুনিক ও স্বাস্থ্যকর নগর ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন? নাকি সংশ্নিষ্টরা ব্যক্তিগতভাবেই পরিবেশ ও নিসর্গের প্রতি অসংবেদনশীল? আমরা জানি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশের নদী, বন, সবুজ ও প্রকৃতি রক্ষায় কতটা আন্তরিক ও উদ্যোগী।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি লাভ করেছেন পরিবেশের নোবেলখ্যাত 'চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ' পুরস্কার। তারই সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে অপ্রয়োজনীয় রেস্তোরাঁ নির্মাণ করছে- ভাবতে কষ্ট হয় বৈকি। আমাদের এমন আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, কেবল রাষ্ট্রীয় অর্থ নয়ছয় করতেই এক একটি চক্র বিভিন্ন সময় উদ্যানগুলোতে নতুন নতুন প্রকল্প 'বাস্তবায়ন' করতে চায়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ বিনষ্টকারী নির্মাণকাজ থেকে সংশ্নিষ্টরা অবিলম্বে সরে আসবেন।
আমরা এও দেখতে চাই, সোহরাওয়ার্দীসহ রাজধানীর সব উদ্যান ঘিরে এ ধরনের পরিবেশবিরোধী চিন্তা ও তৎপরতা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বরং বিভিন্ন উদ্যান ও জলাভূমির যেসব জায়গা এরই মধ্যে দখল হয়ে গেছে, সেগুলো উদ্ধারে মনোনিবেশ করা হয়েছে। বিশেষত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইতোমধ্যে যেসব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, সেগুলোর প্রতিবেশগত ক্ষতিপূরণে দিতে হবে অগ্রাধিকার। আমরা মনে করি, রাজধানীর সবুজ হূৎপিণ্ডটিকে সুরক্ষিত রেখেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ সম্ভব। প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা ও সংবেদনশীলতা।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com