চট্টগ্রামে মিতু হত্যা

নাটকীয় চরিত্র বাবুল

মুসাসহ পলাতকরা কোথায়

প্রকাশ: ১৭ মে ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ১৭ মে ২১ । ০৩:৪৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাহাদাত হোসেন পরশ

স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পর তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের কান্নার ছবি ভাইরাল হয়েছিল। পুলিশের দু-একজন কর্মকর্তা বাবুলের এমন কান্নাকে ওই সময়ই 'অভিনয়' বলে বিশ্বাস করতেন। মিতু হত্যার পরপরই এর তদন্ত শুরু হয়। পাঁচ বছর আগে তখনই আভাস মেলে, এ হত্যার সঙ্গে পুলিশের এই কর্মকর্তার যোগসূত্র রয়েছে। তদন্তকারীদের সন্দেহ হয়, এই খুনের প্লট তারই করা।

বছর পাঁচেক আগেই বাবুলকে সন্দেহভাজন হিসেবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। ওই সময় অনুতপ্ত বাবুল দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠুকে রক্ত বের করে ফেলেছেন- এমন একটি ছবিও প্রকাশ পায়।

সংশ্নিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা অনেকে বিশ্বাস করেছেন, 'কান্নার' মতো এ ছিল তার আরেক নাটক। সব মিলিয়ে বাবুল যেন অনবদ্য এক নাটকীয় চরিত্র; যা হলিউডের কোনো সিনেমার কাহিনিকেও হার মানাবে।

বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য বাবুল পুরস্কারও পেয়েছেন একাধিকবার। পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, জঙ্গিবিরোধী কাজে সম্পৃক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে 'জঙ্গিরা' হত্যা করেছে, এটা প্রতিষ্ঠিত হলে 'সুনাম' আরও বাড়বে- এটাই ছিল বাবুলের বিশ্বাস। এ জন্য এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান তিনি। একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের জের ধরে মিতুর সঙ্গে তার দাম্পত্য সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। এখন পর্যন্ত যে তথ্য সামনে এসেছে তাতে ধারণা করা হয়, কলহপূর্ণ সম্পর্কের কারণে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সোর্সদের ব্যবহার করে সন্তানের সামনে স্ত্রীকে খুনের মতো জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন বাবুল।

পাঁচ বছর আগেই মিতু হত্যার সঙ্গে বাবুলের সম্পৃক্ত থাকার মতো নানা আলামত পুলিশ পেয়েছিল। বাবুল চাকরি হারিয়ে 'দায়মুক্ত' হয়েছেন বলে মনে করছিলেন। এত বছর পর আবার সামনে এলো বাবুল-কাহিনি। এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে সমকাল। এতে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৪ বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা বাবুল আক্তার। চাকরি জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। হাটহাজারী সার্কেলের পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি, কক্সবাজার জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করেছেন। তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সোর্স ছিলেন কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও এহতেশামুল হক ওরফে হানিফুল হক ভোলাইয়া। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে অনেক অপারেশন করেছেন বাবুল। এর বিনিময়ে তাদের জন্য মোটা অঙ্কের সোর্সমানির ব্যবস্থা করতেন বাবুল। ভোলাইয়াকে চট্টগ্রামে বালু উত্তোলনের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। এ থেকে মাসে দুই লাখ টাকা আয় ছিল ভোলাইয়ার। মিতু হত্যার ঘটনায় অস্ত্র সরবরাহ করেন তিনি। পুলিশের ভাষ্য, মিতু হত্যার এজারহারভুক্ত আসামি মুসা ও খায়রুল ইসলাম কালু পলাতক। যদিও তাদের পরিবার বলছে, পুলিশ অনেক আগেই তাদের ধরে নিয়ে গেছে।

একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, স্ত্রীকে হত্যার সময় যে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি ছিল চোরাই। পূর্বপরিকল্পিতভাবে পেশাদার চোরদের দিয়ে ভোলাইয়া ও মুসা সেই মোটরসাইকেল সংগ্রহ করেন। হত্যা মিশনে যারা অংশ নেন তাদেরকে বাবুল বোঝান, এমনভাবে মিতুকে হত্যার ছক করা হয়েছে, এটা কোনো পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে বের করা সম্ভব হবে না। হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া কয়েকজন বাবুলকে এমন যুক্তিও দেখান, কোনো এক সময় তারা ধরা পড়ে যাবেন। তখনও বাবুল আশ্বস্ত করেন- এই হত্যার ক্লু বের করার মতো পুলিশ কর্মকর্তা বাংলাদেশে নেই। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মকর্তার এমন আত্মবিশ্বাস দেখে বড় ধরনের ঝুঁকি নেন তার বিশ্বস্ত সোর্সরা।

বাবুলের দীর্ঘদিন চেনাজানা এমন একাধিক ব্যক্তি সমকালকে বলেন, বাবুলের ভেতর আর বাহির পুরোটা ভিন্ন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন- এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ছিল। তবে পুলিশ বাহিনীতে ঢোকার পর কিছু অপারেশন করে শীর্ষ কর্মকর্তাদের নজর কাড়েন তিনি। আবার বাবুলের ভাষ্য ছিল- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে তার ব্যাপারে শিবির সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়। তবে চট্টগ্রামে বাবুল ভালো কাজ করছেন- এমন ধারণা পুলিশের তৎকালীন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কারও কারও মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। তাই বছর পাঁচেক আগে বাবুল পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর পুলিশ সদর দপ্তরের আইনসিদ্ধ আড়িপাতা শাখা ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে তাকে বদলির প্রস্তাব দেওয়া হয়। রীতিমতো তাকে পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও ছিল। দৃশ্যমান ভালো পুলিশ কর্মকর্তার আড়ালে তিনি একজন কঠিন হৃদয়ের ক্রিমিনাল- এটা অনেকের চিন্তারও বাইরে ছিল। মিতু হত্যার পর যখন ধীরে ধীরে বাবুলের দিকে সন্দেহ ধাবিত হয়, তখন অনেকে বিস্মিত হন। আবার যে দু-চারজন খুব কাছ থেকে তাকে দীর্ঘদিন দেখেছেন, তাদের কাছে বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত কোনো ভাবাবেগ তৈরি করেনি।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, একাধিক নারীর সঙ্গে বাবুলের বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে মিতুকে বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই দাম্পত্য কলহ তৈরি হয়। একবার কক্সবাজারে কর্মরত একজন এনজিও কর্মীর সঙ্গে অশালীন অবস্থায় বাবুলকে দেখতে পান তার স্ত্রী মিতু। এরপর বিষয়টি মিতু তার পরিবারকে জানান। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সালিশ বৈঠকও হয়। মূলত তখন থেকেই মিতুকে 'দেখে নেওয়ার' একটা মনোবৃত্তি বাবুলের মধ্যে তৈরি হয়। মিতু হত্যার পরপরই যখন বাবুলকে প্রথম দফায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে, তখন তার বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের বিষয় জানতে চাওয়া হয়। ওই সময় বাবুল উল্টো তার স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই বাবুলের সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়েও তদন্ত করছে বলে জানা যায়।

মিতু হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশ মহাপরিদর্শক ছিলেন এ কে এম শহীদুল হক। গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, অকাট্য প্রমাণ ছাড়া তো একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা যায় না। আবার বাবুল ছিলেন মামলার বাদীও। ঘটনার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। কোনোভাবে হত্যায় সংশ্নিষ্টতার ব্যাপারে তিনি মুখ খুলছিলেন না। এ ছাড়া হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ওই সময় ধরা হয়। বাবুলের সোর্স মুসাকেও গ্রেপ্তার করতে বলা হয়। যদিও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, সরাসরি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকলে বাবুল কেন, যত বড় কর্মকর্তা হোক- ছাড় পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ছেলেকে স্কুলবাসে উঠিয়ে দিতে যাওয়ার পথে নগরীর জিইসি মোড়ের কাছে তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সদ্য পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া বাবুল আক্তার ঘটনার সময় ঢাকায় ছিলেন। ওই হত্যার প্রেক্ষাপটে দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। একটি জঙ্গি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়- পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে তারা খুন করেনি। নারীদের টার্গেট করে জঙ্গিদের তরফে কোনো অপারেশন চালানো হয় না। তবে অধিকাংশের বিশ্বাস ছিল, এটা জঙ্গিদের কাজ। শুরুতে মিতুর পরিবারও এই হত্যার সঙ্গে বাবুলের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। ধীরে ধীরে নানা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তারা বলতে শুরু করেন, মিতুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন বাবুল আক্তার। গত ১০ মে মামলার বাদী হিসেবে বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। সন্দেহভাজন খুনিদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। একেকবার একেক কথা বলেন। এরপর বাবুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন ১১ মে মিতু হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে ওই দিনই বাবুলকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা করেন। নতুন মামলার পর একটি প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন পর আসামি হলে বিচারের সময় কোনো সুবিধা পাবেন কিনা।

এ ব্যাপারে পিবিআইর প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, কী প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন পর বাদী আসামি হলেন, মামলার নথি সাজানোর সময় তদন্ত কর্মকর্তা এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নিশ্চয় দেবেন। তবে এখন পর্যন্ত বাবুল নিজে মুখ খোলেননি। এই ঘটনায় তার ভূমিকা ও দায়-দায়িত্বের বিষয় অনুসন্ধানে তদন্ত সংশ্নিষ্টরা কাজ করে যাচ্ছেন।

মিতুর মা শাহিদা মোশাররফ সমকালকে জানান, বাবুল ২০১৩ সালে ভারতীয় এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। প্রমাণ হিসেবে ২৯টি মেসেজ সংরক্ষণ করেছিলেন মিতু। বাবুলের মোবাইল ফোনে থাকা ওই মেসেজগুলো তিনি গোপনে ছেলের ছবি আঁকার কাগজ ও মেয়ের খাতায় লিখে রাখেন। সেগুলোতে দু'জনের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ওই এনজিও কর্মী কক্সবাজারে মাসে পাঁচ লাখ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। তার স্বামী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। ওই এনজিও কর্মীর স্বামী বাংলাদেশে পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কামাল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে বাবুলের কাছে বিপুল অর্থ পাঠান। তবে সেই অর্থ পোশাক কারখানায় বিনিয়োগ না করে নিজের কাছেই রেখে দেন বাবুল।

শাহিদা মোশাররফ সমকালকে জানান, মিতু হত্যার পর তিনটি বিয়ে করেন বাবুল। এর মধ্যে দু'জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। এ ছাড়া ওই এনজিও কর্মী ছাড়াও কয়েকজনের সঙ্গে বাবুলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মিতুর দুই সন্তান মাহির ও টাপুরের খোঁজ জানতে চান শাহিদা মোশাররফ।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com