মাদকের ভয়াবহতা এবং নির্মূল কৌশল

প্রকাশ: ২৮ মে ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মো. এমরানুল হাসান

মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদকের সর্বাত্মক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। মাদকের স্বর্গরাজ্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমে এবং আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এসব দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে মাদক পাচারের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ব্যবহার করায় মাদকের বিস্তার রোধ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তারপরও আমরা মাদকমুক্ত একটি সমাজ প্রত্যাশা করি। আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং সব বাহিনী মাদক নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করছে।

যখন কেউ এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তাকে মাদকাসক্ত বলা হয়। মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ মাদকের সহজলভ্যতা। দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক উন্নয়ন, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতার অভাব- এগুলোও মাদকের সমস্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পারিবারিক কলহ, বিচ্ছেদের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবার, প্রেম ও পেশাগত ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থেকে হতাশার কারণেও মাদকাসক্তের হার বাড়ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত, বাংলাদেশে প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ মাদকাসক্ত। দেশের বেকার জনসংখ্যার বেশ বড় অংশই মাদকাসক্ত। মোট মাদকাসক্তের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত ও ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকাসক্তের ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী, যাদের ৭ শতাংশ এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত। সারাদেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক কারবারি রয়েছে। তাদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন নারী। ২০১৯ সালে প্রতিদিন গড়ে ১১৪ জন সরকারি ও বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০৪ এবং ২০১৭ সালে ৬৯। অবাক করার বিষয় হলো, ২০১৯ সালে নারী মাদকসেবীর সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। মাদকের হাতছানি শুধু শহরে নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনা। শুধু পরিবার নয়, মাদকের কালো থাবা ধ্বংস করে একটি সমাজকে, একটি জাতিকে। মাদকে একবার আসক্ত হয়ে পড়লে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ ব্যাপারে পরিবারকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। একটি পরিবার বা সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিই যথেষ্ট। মাদকাসক্তির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। যে পরিবারে কেউ মাদকাসক্ত, সেখানে কোনো সুখ-শান্তি থাকে না। সমাজে চলে চরম বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।

প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সীমান্তপথে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দেশে ঢুকছে অভিনব পদ্ধতিতে। উদ্বেগের কারণ হলো, মাদকের অপব্যবহার ও চোরাচালানের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ব্যবহার হচ্ছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি-সন্ত্রাসের প্রসারে। ফান্ড সংগ্রহে এখন জঙ্গিরা মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে প্রেসক্রিপশন ড্রাগও একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। প্রেসক্রিপশন ড্রাগ হলো একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ড্রাগ, যা আইনিভাবে মেডিকেল প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। মাদকের বিস্তারে নারী ও শিশুদের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবার আমদানি, সরবরাহ ও বেচাকেনার জন্য নিরাপদ হিসেবে নারী ও শিশুদের বেছে নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা ব্যর্থ হওয়ায় তাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের নামাচ্ছে এ কারবারে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের নারী-শিশু অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য জড়াচ্ছে মাদক ব্যবসায়। মাদকবিরোধী সরকারি বা বেসরকারি যাবতীয় কাজের সমন্বয় সাধন, তত্ত্বাবধান,পরামর্শ প্রদান ও মাদকবিরোধী জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রচার কমিটি রয়েছে। সব কমিটির কার্যক্রম জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে থাকে। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জেলা পর্যায়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ প্রচারণা কমিটি রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে উপজেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম পর্যালোচনা সমন্ব্বয় সাধনের জন্য তিন মাস পরপর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রধান কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরবরাহ হ্রাসের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফে ইয়াবা পাচারবিরোধী টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের স্থায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ কার্যালয় চালু হয়েছে। এ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিশ্বমানের ইন্টারোগেশন ইউনিট স্থাপন, ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু, উন্নত গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কেনা এবং মোবাইল ট্র্যাকার স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এ পর্যন্ত মহাপরিচালক পর্যায়ে ছয়টি ফলপ্রসূ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। পাশাপাশি ইয়াবা পাচার রোধকল্পে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। টেকসই মাদক নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আন্তর্জাতিক ড্রাগ কনভেনশনগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা এবং মাদক নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্য ও মানবাধিকারসহ জাতিসংঘের কার্যপরিকল্পনা অনুসারে অভ্যন্তরীণ মাদক পলিসি প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সঙ্গে বেশি বেশি আলোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ ফলপ্রসূ হতে পারে। নতুন করে যেন কোনো শিশু-কিশোর বা তরুণ-তরুণী মাদকের জালে জড়াতে না পারে, তারা যেন কৌতূহল বা এক্সপেরিমেন্টেশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে এবং বন্ধু নির্বাচনে সজাগ থাকে- এজন্য মাদকের পরিণতি সম্পর্কে আগেই খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। এ ছাড়া খেলাধুলাসহ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সৃজনশীল বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে এখনই সব অভিভাবক তথা আমাদের সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

কর্নেল মো. এমরানুল হাসান : বিপিএম (সেবা), সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com