আমি যারে চাইরে, সে থাকে মোর এ অন্তরে ...

প্রকাশ: ০৫ জুন ২১ । ১৩:৩২ | আপডেট: ০৫ জুন ২১ । ১৩:৪২

লাবু রহমান

আজম খান [জন্ম :২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, মৃত্যু :৫ জুন ২০১১]

বাংলা পপ ও রক গানের অভিনব পরিবেশনা দিয়ে লাখো শ্রোতার হৃদয় জয় করেছেন আজম খান। পেয়েছেন 'গুরু' খ্যাতি। আজ (৫ জুন) খ্যাতিমান এই শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী। তার স্মরণে তাকে নিয়ে লিখেছেন তার গাওয়া জনপ্রিয় গান 'আমি যারে চাইরে, সে থাকে মোর এ অন্তরে ...' গানের স্রষ্টা লাবু রহমান।

জনপ্রিয়তা অনেকের মনে অহমের জন্ম দেয়। কিন্তু আমৃত্যু আজম খান অহমবর্জিত মানুষ। বাংলা পপ ও রক গানের অভিনব পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তিনি দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন, ইতিহাসের পাতায় তা উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকবে। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আর শ্রোতার কাছে ব্যান্ডসংগীতের গুরু বলে পরিচিতি পেয়েও তার মধ্যে কোনো অহংকার দেখা দেয়নি। বরং আজীবন তিনি সুরের সারথি হিসেবেই থেকে গেছেন। ভালো লাগার বিষয় এটাই যে, সংগীতপ্রাণ এই মানুষটার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। এখনও মনে পড়ে সেই দিনের কথা, যেদিন আমার বন্ধু টুটুল বলেছিল, আজম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তোর কথা বলেছি, তোকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আরও বলেছেন, একটা ব্যান্ড ফর্ম করতে চান। এ কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে কাজ করার। তাই দেরি না করে পরদিন সকালেই চলে গিয়েছিলাম আজম খানের সঙ্গে দেখা করতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কথা শুরু করার মাত্র ১৫ মিনিটে আমাদের সম্পর্কটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। তাই আজম ভাই একমুহূর্ত দেরি না করে বলেছিলেন, চল বাজাই। তার এই কথায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমাকে এবার পরীক্ষা দিতে হবে। আমিও প্রস্তুত হয়ে শুরু করেছিলাম গিটার বাজানো।

আর আজম ভাইও শুরু করেছিলেন একনাগাড়ে গান গাওয়া। এভাবেই গান গাওয়া আর বাজানোর মধ্য দিয়ে চার ঘণ্টা কীভাবে কেটেছিল- বুঝতেই পারিনি। সেই যে শুরু- দীর্ঘদিন আমরা একসঙ্গে কাজ করে গেছি। মিউজিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছি তার 'উচ্চারণ' ব্যান্ডে। আজম খান কণ্ঠশিল্পী, টুটুল রিদম গিটার, পপসি ড্রামস, হেলাল বেইস গিটার আর আমি লিড গিটার- এই লাইনআপ নিয়ে আমরা যখন দর্শকশ্রোতার মাঝে হাজির হতাম, তখন চোখে পড়ত, উচ্চারণ ব্যান্ড নিয়ে তাদের মধ্যে কী উন্মাদনা কাজ করছে। আমাদের এই লাইন নিয়ে টানা ছয় মাস একনাগাড়ে অনুষ্ঠান করে গেছি। এরপর একটা অনুষ্ঠান করি বিটিভিতে। আজম খানের ছয়টি গান নিয়ে সেই আয়োজন সাজানো হয়েছিল। এটা ছিল লাইভ রেকর্ডিং করা অনুষ্ঠান। এটি প্রচার হওয়ার পর অগণিত দর্শকের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা পেয়েছি, যা আমার সংগীতজীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

আজম খান যেমন ছিলেন বড় মনের মানুষ, তেমনই সংগীতের জন্য নিবেদিত একজন। আমার গিটার বাজানো তিনি খুবই পছন্দ করতেন। তাই আজম ভাইয়ের জন্য নতুন কিছু সৃষ্টির উদ্দীপনাও কাজ করত। তাই একটি গান তৈরি করার পর মনে হলো, এটা আজম ভাই গাইলে তার অন্যান্য গান থেকে একটু আলাদা ধাঁচের মনে হবে। এই ভেবেই একদিন আজম ভাইকে বললাম, আমার একটা গান আছে, তিনি গাইবেন কিনা। শোনাতে বললেন। আমি গান গাইতে তিনি তা সহজেই তুলে ফেললেন, আমি যারে চাইরে/সে থাকে মোর এ অন্তরে ...।

এরপরই এক অনুষ্ঠানে এ গান গাইলেন এবং সাড়া ফেলে দিলেন। আজম ভাইয়ের গায়কি এমনি ছিল যে, এ গান একবার যে শুনেছে সে ভালোবেসে ফেলেছে। এটা সম্ভব হয়েছে আজম ভাই সবসময় তার গায়কিতে নিজের শতভাগ উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে। হয়তো সে কারণে শিল্পী হিসেবে তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছেন অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু দুঃখ হয় এটা ভেবে যে, এমন একজন শিল্পী, সংগীত অন্তঃপ্রাণ মানুষ তার জীবদ্দশায় কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না। যদিও মরণোত্তর একুশে পদকে তাকে ভূষিত করা হয়েছে, কিন্তু এই প্রাপ্তি তার জীবদ্দশায় পাওয়া উচিত ছিল বলেই মনে করি।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com