
অ্যাকশনএইড-সমকাল অনলাইন আলোচনা
কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতন করা জরুরি
প্রকাশ: ১০ জুন ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ১০ জুন ২১ । ০১:০১ | প্রিন্ট সংস্করণ
সমকাল প্রতিবেদক

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো তরুণ সমাজ। ইউএনএফপিএর হিসাবে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী এ দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। অথচ এই তরুণ সমাজের জন্য সঠিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, উন্নত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাকে অবহেলা এবং এ সম্পর্কিত সামগ্রিক অসচেতনতার জন্য দেশে বেড়েছে বাল্যবিয়ে, লিঙ্গ-অসমতা, নারীর প্রতি সহিংসতা, মানসিক বিকৃতিসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ব্যাধি। তাই কৈশোর ও তারুণ্যবান্ধব সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংবেদনশীল একটি সমাজ গঠনের জন্য কিশোর-কিশোরীদের এ বিষয়ে যথাযথভাবে সচেতন করা জরুরি। তাই গ্রামীণ পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোয় কিশোর-কিশোরীদের সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে 'ফ্লেক্সি সময়' বা সহনীয় সময় প্রবর্তনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজন।
গতকাল বুধবার 'গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিসেবা নিশ্চিতকরণ :এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্প'-এর অভিজ্ঞতা বিনিময় শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় বক্তারা এ আহ্বান জানান। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও দৈনিক সমকালের যৌথ আয়োজনে এতে সভাপতিত্ব করেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার-উইম্যান রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি চেয়ারপারসন মরিয়ম নেছা। সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকনের সঞ্চালনায় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. জয়নাল হক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয়) মতিউর রহমান ও পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম। আলোচনায় আরও অংশ নেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রামজীবন ইউনিয়নের সুবর্ণদহ বহুমুখী কৃষি উন্নয়ন দলের নেতা নারী কৃষি উদ্যোক্তা আজমা বেগম, গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের প্রতিনিধিত্বকারী বগুড়ার দুর্গাহাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আকতার মিম ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা মজিদপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রজিনা আখতার রিমা। স্বাগত বক্তব্য দেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ) নামক প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. শওকত আকবর ফকির। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার-অ্যাডভোকেসি জাকিরুল ইসলাম পিটার।
শেখ রোকন বলেন, সুস্থ ও সংবেদনশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা খুবই জরুরি। কারণ, তারাই ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। সমকাল সবসময়ই শুধু কিশোরী নয়, কিশোরদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার বিষয়গুলোয় বিশেষ মনোযোগ দেয়।
ডা. মো. জয়নাল হক বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ ভাগের এক ভাগই হচ্ছে কিশোর-কিশোরী। তাদের মধ্যে অনূর্ধ্ব ২৫-এর সংখ্যা বেশি। বিগত কয়েক বছরে এই কিশোর-কিশোরীদের যে সংখ্যা, তা আগামী ২০৩০ সালের পর অনেকটাই কমে যাবে। ২০৫০ সালে বাড়বে প্রবীণদের সংখ্যা। তাই কিশোরী-কিশোরীদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন পদক্ষেপ ও বিনিয়োগ। তাদের জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে বাল্যবিয়ে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু এটা গুরুত্ব পায় না। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা নেই। তারা জানেও না সঠিক এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা কোথায় পাওয়া যায়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং জ্ঞান নিয়ে কথা বলা, চর্চার পরিবেশ তৈরি করা সময়ের দাবি। এই সচেতনতার কার্যক্রম হতে হবে আনন্দময়। আশার দিক হচ্ছে, সরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
মতিউর রহমান বলেন, কোনো এলাকায় কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন সমস্যার মুখোমুখি হলে '১৬৭৬৭' নম্বরে কল করে জানালেই হবে। ২৪ ঘণ্টা এ সেবা দেওয়া হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের উদ্ৃব্দতি দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি স্কুল ও মাদ্রাসার ছেলে শিক্ষার্থীরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পরিবারকে সচেতন হতে হবে।
ডা. মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের আওতায় স্যানিটারি নেপকিনসহ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে, যা শ্রেণিকক্ষে কিশোরী শিক্ষার্থীর গড় উপস্থিতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি এ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং তারা এসআরএইচআর কর্ণার চালু রাখার বিষয়ে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
মরিয়ম নেছা বলেন, এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, কোনো কিশোর-কিশোরী ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সেবা গ্রহণ করতে চাইলেও শুধু সময়ের পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয় না। তাই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংবেদনশীল একটি সমাজ গঠনে গ্রামীণ পর্যায়ের কিশোর-কিশোরীদের এ বিষয়ে সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে সুবিধাজনক সময়ে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে 'ফ্লেক্সি সময়' বা সহনীয় সময় প্রবর্তন করা জরুরি।
ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কর্ম এলাকায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংবেদনশীল একটি সমাজ গঠন করা। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের কর্ম এলাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। কেননা, এসব শিক্ষার্থীই ভবিষ্যতে সমাজকে নেতৃত্ব দেবে। ফলে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে পারলে একপর্যায়ে সমগ্র সমাজ এ বিষয়ে সংবেদনশীল হবে। এ লক্ষ্যে কর্ম এলাকার ১০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা এসব বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অবহিতকরণ সেশন পরিচালনা করেন। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি স্কুলগুলোয় ১৩টি এসআরএইচআর কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বই, লিফলেট ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা সেগুলো পড়ছে।
সুমাইয়া আকতার মিম ও রজিনা আখতার রিমা জানান, ২০১৭ সাল থেকে এ প্রকল্পের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে সব কিশোর-কিশোরীদের সুবিধাজনক সময়ে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে 'ফ্লেক্সি সময়' বা সহনীয় সময় প্রবর্তনও করা হয়েছে। আগে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে কাউকে বলা যেত না। আর এখন তারা নির্দি্বধায় বলতে পারে। আশপাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়। মাসিককালীন আইএফএ ট্যাবলেট দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ সময়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। ন্যাপকিন, প্যাড ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
আজমা বেগম বলেন, এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ২০১৬ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছি। মাসে প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহের বৃহস্পতিবার 'নমনীয় সময়' নির্ধারণ করা হয়েছে। ওইদিন কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে থাকে।
মূল প্রবন্ধে জাকিরুল ইসলাম পিটার বলেন, প্রকল্পটি নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় পটুয়াখালীর গলাচিপা, ফরিদপুর সদর ও মধুখালী, বগুড়ার গাবতলী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, প্রচলিত বাজার ব্যবস্থাকে নারীবান্ধবকরণের লক্ষ্যে স্থায়ী ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন, লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষতা ও প্রতিযোগী মনোভাবাপন্নতা বৃদ্ধি করা এবং লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি মানের উন্নয়ন সাধন করা, যাতে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্প কর্ম এলাকায় ৬০০২ জন নারী কৃষি উদ্যোক্তা, ৩০টি ইউনিয়ন, ৩০টি বাজার কমিটি, ৩০টি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, পাঁ৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করে। প্রকল্পের ৩১ জন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সেবা প্রদান করতে গ্রামীণ পর্যায়ে বিকল্প সরবরাহ চ্যানেল চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরিবার পর্যায়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ওপর সচেতনতামূলক সেশন পরিচালনা করছে, নিয়মিত বাচ্চাদের উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করছে, পাঁচ বছরের নিচের বয়সী বাচ্চাদের এমইউএসি পরিমাপ করছে। পাশাপাশি তারা গ্রামীণ নারীদের প্রেশার মাপছেন এবং সেনিটারি নেপকিন, সেলাইন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলসহ স্বাস্থ্য সেবার অন্যান্য সামগ্রী সুলভমূল্যে বিক্রয় করে নিজেদের কর্মসংস্থান করছেন এবং উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
গতকাল বুধবার 'গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিসেবা নিশ্চিতকরণ :এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্প'-এর অভিজ্ঞতা বিনিময় শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় বক্তারা এ আহ্বান জানান। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও দৈনিক সমকালের যৌথ আয়োজনে এতে সভাপতিত্ব করেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার-উইম্যান রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি চেয়ারপারসন মরিয়ম নেছা। সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকনের সঞ্চালনায় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. জয়নাল হক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয়) মতিউর রহমান ও পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম। আলোচনায় আরও অংশ নেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রামজীবন ইউনিয়নের সুবর্ণদহ বহুমুখী কৃষি উন্নয়ন দলের নেতা নারী কৃষি উদ্যোক্তা আজমা বেগম, গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের প্রতিনিধিত্বকারী বগুড়ার দুর্গাহাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আকতার মিম ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা মজিদপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রজিনা আখতার রিমা। স্বাগত বক্তব্য দেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ) নামক প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. শওকত আকবর ফকির। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার-অ্যাডভোকেসি জাকিরুল ইসলাম পিটার।
শেখ রোকন বলেন, সুস্থ ও সংবেদনশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা খুবই জরুরি। কারণ, তারাই ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। সমকাল সবসময়ই শুধু কিশোরী নয়, কিশোরদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার বিষয়গুলোয় বিশেষ মনোযোগ দেয়।
ডা. মো. জয়নাল হক বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ ভাগের এক ভাগই হচ্ছে কিশোর-কিশোরী। তাদের মধ্যে অনূর্ধ্ব ২৫-এর সংখ্যা বেশি। বিগত কয়েক বছরে এই কিশোর-কিশোরীদের যে সংখ্যা, তা আগামী ২০৩০ সালের পর অনেকটাই কমে যাবে। ২০৫০ সালে বাড়বে প্রবীণদের সংখ্যা। তাই কিশোরী-কিশোরীদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন পদক্ষেপ ও বিনিয়োগ। তাদের জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে বাল্যবিয়ে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু এটা গুরুত্ব পায় না। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা নেই। তারা জানেও না সঠিক এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা কোথায় পাওয়া যায়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং জ্ঞান নিয়ে কথা বলা, চর্চার পরিবেশ তৈরি করা সময়ের দাবি। এই সচেতনতার কার্যক্রম হতে হবে আনন্দময়। আশার দিক হচ্ছে, সরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
মতিউর রহমান বলেন, কোনো এলাকায় কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন সমস্যার মুখোমুখি হলে '১৬৭৬৭' নম্বরে কল করে জানালেই হবে। ২৪ ঘণ্টা এ সেবা দেওয়া হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের উদ্ৃব্দতি দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি স্কুল ও মাদ্রাসার ছেলে শিক্ষার্থীরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পরিবারকে সচেতন হতে হবে।
ডা. মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের আওতায় স্যানিটারি নেপকিনসহ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে, যা শ্রেণিকক্ষে কিশোরী শিক্ষার্থীর গড় উপস্থিতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি এ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং তারা এসআরএইচআর কর্ণার চালু রাখার বিষয়ে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
মরিয়ম নেছা বলেন, এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, কোনো কিশোর-কিশোরী ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সেবা গ্রহণ করতে চাইলেও শুধু সময়ের পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয় না। তাই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংবেদনশীল একটি সমাজ গঠনে গ্রামীণ পর্যায়ের কিশোর-কিশোরীদের এ বিষয়ে সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে সুবিধাজনক সময়ে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে 'ফ্লেক্সি সময়' বা সহনীয় সময় প্রবর্তন করা জরুরি।
ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কর্ম এলাকায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংবেদনশীল একটি সমাজ গঠন করা। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের কর্ম এলাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। কেননা, এসব শিক্ষার্থীই ভবিষ্যতে সমাজকে নেতৃত্ব দেবে। ফলে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে পারলে একপর্যায়ে সমগ্র সমাজ এ বিষয়ে সংবেদনশীল হবে। এ লক্ষ্যে কর্ম এলাকার ১০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা এসব বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অবহিতকরণ সেশন পরিচালনা করেন। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি স্কুলগুলোয় ১৩টি এসআরএইচআর কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বই, লিফলেট ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা সেগুলো পড়ছে।
সুমাইয়া আকতার মিম ও রজিনা আখতার রিমা জানান, ২০১৭ সাল থেকে এ প্রকল্পের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে সব কিশোর-কিশোরীদের সুবিধাজনক সময়ে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে 'ফ্লেক্সি সময়' বা সহনীয় সময় প্রবর্তনও করা হয়েছে। আগে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে কাউকে বলা যেত না। আর এখন তারা নির্দি্বধায় বলতে পারে। আশপাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়। মাসিককালীন আইএফএ ট্যাবলেট দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ সময়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। ন্যাপকিন, প্যাড ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
আজমা বেগম বলেন, এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ২০১৬ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছি। মাসে প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহের বৃহস্পতিবার 'নমনীয় সময়' নির্ধারণ করা হয়েছে। ওইদিন কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে থাকে।
মূল প্রবন্ধে জাকিরুল ইসলাম পিটার বলেন, প্রকল্পটি নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় পটুয়াখালীর গলাচিপা, ফরিদপুর সদর ও মধুখালী, বগুড়ার গাবতলী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, প্রচলিত বাজার ব্যবস্থাকে নারীবান্ধবকরণের লক্ষ্যে স্থায়ী ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন, লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষতা ও প্রতিযোগী মনোভাবাপন্নতা বৃদ্ধি করা এবং লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি মানের উন্নয়ন সাধন করা, যাতে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্প কর্ম এলাকায় ৬০০২ জন নারী কৃষি উদ্যোক্তা, ৩০টি ইউনিয়ন, ৩০টি বাজার কমিটি, ৩০টি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, পাঁ৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করে। প্রকল্পের ৩১ জন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সেবা প্রদান করতে গ্রামীণ পর্যায়ে বিকল্প সরবরাহ চ্যানেল চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরিবার পর্যায়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ওপর সচেতনতামূলক সেশন পরিচালনা করছে, নিয়মিত বাচ্চাদের উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করছে, পাঁচ বছরের নিচের বয়সী বাচ্চাদের এমইউএসি পরিমাপ করছে। পাশাপাশি তারা গ্রামীণ নারীদের প্রেশার মাপছেন এবং সেনিটারি নেপকিন, সেলাইন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলসহ স্বাস্থ্য সেবার অন্যান্য সামগ্রী সুলভমূল্যে বিক্রয় করে নিজেদের কর্মসংস্থান করছেন এবং উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com