দুর্গম বরকল

অপরূপ প্রকৃতির কোলেও কষ্টের জীবন

প্রকাশ: ১২ জুন ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ১২ জুন ২১ । ০৩:০৫ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারোয়ার সুমন, রাঙামাটি থেকে ফিরে

নান্দনিক রাঙামাটির দুর্গম উপজেলা বরকল। যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হলেও তা যথেষ্ট নয়। ফলে জীবনযাপনের নৈমিত্তিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয় এখানকার মানুষজনকে- সমকাল

হেমায়েত উল্লাহর বয়স আনুমানিক ৩৫। 'কী করেন?' - জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাই।' 'আপনার বাবা কী করেন?'- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, 'তিনিও মোটরসাইকেল চালান।' কথায় কথায় হেমায়েত আরও জানান, তারা দুই ভাই এক বোন। ভাইয়ের বয়স ১৮ বছর, সেও ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালায়।

যেখানে দাঁড়িয়ে হেমায়েতের সঙ্গে এসব কথা হচ্ছিল, সে এলাকার নাম বরকল। রাঙামাটির দুর্গম এক উপজেলা এটি। প্রকৃতি এখানে উদার হলেও জীবন এখানে কঠিন। খুবই কঠিন।

বরকল উপজেলার উত্তরে বাঘাইছড়ি। দক্ষিণে জুরাছড়ি। পশ্চিমে রাঙামাটি সদর। পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এ উপজেলার ৮০ শতাংশ রাস্তাই কাঁচা মাটির। এ এলাকার প্রধান যানবাহন মোটরসাইকেল। যাদের একটু সামর্থ্য আছে, তারা এখানে চড়েন ভাড়া করা মোটরসাইকেলে। সরকারি কোনো কলেজ নেই পুরো বরকল উপজেলাতে। নেই সরকারি কোনো হাসপাতাল। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও তাতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও লোকবল। রাঙামাটি জেলা সদর থেকে এই বরকলে আসতে পাড়ি দিতে হয় ৬০ কিলোমিটার জলপথ। সঙ্গে রাখতে হয় দূর্ভোগ পোহানোর মতো পর্যাপ্ত মানসিক শক্তি।

ভূষণছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'জীবন ধারণের অপরিহার্য সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছুই নেই এখানে। শিক্ষার হারও অনেক কম। স্কুল-কলেজ তেমন না থাকায় শিক্ষায় আগ্রহ থাকলেও থেমে আছে অনেকেই। প্রায় অর্ধলাখ মানুষ এ উপজেলায় থাকে। অথচ এখানে নেই চিকিৎসার নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধাও।'

এ উপজেলার একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অবস্থান এই ভূষণছড়া ইউনিয়নেই। যদিও এ ইউনিয়নেরই দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পায় না এর সেবা। চেয়ারম্যান বলেন, 'স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থান ইউনিয়নের একেবারে একপ্রান্তে বরকল সীমান্তের কাছাকাছি। ইউনিয়নের মূল অংশ থেকে এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। একমাত্র সরকারি হাইস্কুলও এখান থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে-বরকল সদরে।

বরকল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জুয়েল রানা বলেন, 'এ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের চারটিতেই আদিবাসী বেশি। কেবল ভূষণছড়া ইউনিয়নে আধিক্য রয়েছে বাঙালিদের। বর্ষাকালে এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। রাঙামাটি সদর থেকে এ উপজেলাতে আসতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে ছোট নৌযানেরও দেখা মেলে না।'

পাহাড় ও নদীবেষ্টিত এ উপজেলাতে প্রকৃতি সব সময়ই অপরূপ। কর্ণফুলীর স্বচ্ছ জলরাশি আছড়ে পড়ে বরকলের এই কূলে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ নির্মল চাকমা বললেন, 'সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে সব সময় বঞ্চিত হই আমরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় সরকারি কর্মকর্তারা এখানে আসতে চান না। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। পাকা রাস্তা নেই বললেই চলে। বর্ষাকালে এখানে চলাফেরা করা খুবই কঠিন। এখানকার শিক্ষা ও চিকিৎসার দিকে সরকারের আরও নজর বাড়ানো দরকার।'

বরকল থানার ওসি জসীম উদ্দীন জানান, এলাকা দুর্গম হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কিছু রাস্তার কাঠামো হয়েছে। তবে বেশিরভাগ রাস্তা এখনও মাটির। আগের তুলনায় জীবনযাত্রার মান এখন কিছুটা বাড়লেও তা আশাজাগানিয়া নয়। সরকারি অফিসগুলো থেকেও মানুষজন কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না। কারণ যারা দায়িত্বে আছেন তাদের অনেকেই থাকেন না কর্মস্থলে। প্রশাসনের উচিত এদিকে নজর দেওয়া।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com