
বাজারব্যবস্থা করতে হবে নারীবান্ধব
প্রকাশ: ২৮ জুন ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জুন ২১ । ০২:৫৯ | প্রিন্ট সংস্করণ
সমকাল প্রতিবেদক

অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কমে অকৃষি খাতে বেড়েছে। এরপরও নারীর মোট কর্মসংস্থানের ৬০ ভাগ জুড়ে আছে কৃষি। তবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিপণনে নারীরা বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। তাই প্রচলিত বাজারব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করে তোলার লক্ষ্যে স্থায়ী ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে দক্ষতা ও প্রতিযোগী মনোভাবাপন্নতা বাড়াতে হবে। লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিমানের উন্নয়ন সাধন করতে হবে, যাতে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোও জরুরি। এতে নারী উদ্যোক্তারাই উপকৃত হবে। টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।
গতকাল রোববার অনলাইনে আয়োজিত 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ) প্রকল্পের এলাকাভিত্তিক অর্জন'বিষয়ক অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। একশনএইড বাংলাদেশ ও দৈনিক সমকালের যৌথ আয়োজনে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন একশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার-উইম্যান রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি চেয়ারপারসন মরিয়ম নেছা। সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকনের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জয়িতা ফাউন্ডেশনের পরিচালক (উপসচিব) মো. আরিফুল ইসলাম। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বাজার সংযোগ ও গবেষণা) ও ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা (আইসিটি সেল) দেওয়ান আসরাফুল হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. শওকত আকবর ফকির।
সভায় আরও বক্তব্য দেন নারী উদ্যোক্তা জাহানারা বেগম, নূরজাহান বেগম, আছিয়া, পারুল বেগম, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এসকেএস ফাউন্ডেশনের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. জামাল উদ্দিন, সোনারায় ইউনিয়নে এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী নারায়ণ চন্দ্র রায়, গলাচিপায় উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্প সমন্বয়কারী শঙ্কর কুমার দাশ, এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার-অ্যাডভোকেসি জাকিরুল ইসলাম পিটার। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন একশনএইড বাংলাদেশের মার্কেট ডেভেলপমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার মো. খাইরুজ্জামান।
বর্তমানে তৃণমূলের নারী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর গুলশানের বিক্রয়কেন্দ্র আউড়ি, আগোরাসহ বেশ কয়েকটি শপে। একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে আউড়ি যাত্রা শুরু করে। সংস্থাটির 'প্রমোটিং অপরচুনিটিজ ফর উইমেন্স এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড রাইটস (পাওয়ার)' প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধা, সুন্দরগঞ্জ, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলার ছয় হাজারের বেশি নারী কৃষক জৈবপদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদন করে সরাসরি আউড়িতে পাঠাচ্ছেন।
শেখ রোকন বলেন, ঐতিহাসিক কারণেই নারীরা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সামাজিক পরিক্রমা। তাই নারীর জন্য সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ সম্ভব।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন নারী কৃষকরা। করোনা মহামারি গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবাকে আরও বেশি হুমকির মুখে ফেলেছে। করোনার প্রভাবে কৃষি এবং অকৃষি খাতে নিয়োজিত নানা বর্ণ ও জাতিসত্তার গ্রামীণ এবং শহরের নারীরা সাময়িক অথবা স্থায়ী বেকারত্বের শিকার। এ অবস্থায় জয়িতা ফাউন্ডেশন চলতি বাজেটে শুধু নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। জয়িতা ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্র একটি প্রয়াস মাত্র। নারীদের এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে নারীরাই মূল চালিকাশক্তি। তারা যেন একে অপরকে সহযোগিতা করেন।
আরিফুল ইসলাম বলেন, পরিবারের লোকজন বা প্রতিবেশীই নারীর অগ্রগতির অন্যতম বাধা। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। জয়িতা ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে একটি চেইনশপ তৈরি করছে। শুধু সংস্থার নিবন্ধনকৃত উদ্যোক্তা নন, সব উদ্যোক্তাই যেন জয়িতা ফাউন্ডেশনের সেবা নিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে। বিস্তৃত পরিসরে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
দেওয়ান আসরাফুল হোসেন বলেন, অসংখ্য নারী বর্তমানে কৃষিপণ্য ব্যবসায় সফল হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যগতভাবেই কৃষির সঙ্গে জড়িত নারীরা। তারা উৎপাদন ও পরবর্তী কার্যাবলিতেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে আসছেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নারী কৃষকের বাজার ব্যবস্থায় যেন নিরাপদে কাজ করতে পারেন, এ জন্য ২০০৬-০৭ কার্যবর্ষে আমরা একটা প্রকল্প চালু করেছিলাম। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন জায়গায় 'ফরওয়ার্ড মার্কেটিং লিঙ্ক' তৈরিতে নারীরা যেন সুবিধা পান। কিন্তু সে সময় নারী কৃষকদের তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে একশনএইড বাংলাদেশের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক সফল নারীর দেখা মিলছে। তারা চাইলে রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে কৃষকদের পাইকারি বাজারে বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে প্রকল্প সম্পর্কে ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, 'এ প্রকল্পটি রাজকীয় নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় পটুয়াখালীর গলাচিপা, ফরিদপুর সদর ও মধুখালী, বগুড়ার গাবতলী এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত বাজারব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করার লক্ষ্যে স্থায়ী ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন সাধন, লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষতা ও প্রতিযোগী মনোভাবাপন্নতা বৃদ্ধি করা এবং লক্ষ্যিত নারী উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিমানের উন্নয়ন সাধন করা, যাতে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।' এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্প কর্ম এলাকায় ৬০০২ জন নারী কৃষি উদ্যোক্তা; ৩০টি ইউনিয়ন, ৩০টি বাজার কমিটি, ৩০টি ইউনিয়ন পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র, ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে কাজ করে। প্রকল্পের ৩১ কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিসেবা প্রদান করার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে বিকল্প সরবরাহ চ্যানেল চালু করেছে।
জাকিরুল ইসলাম পিটার বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সর্বত্র যোগাযোগ করছি। জয়িতা ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও কথা বলছি। তিনি বলেন, কৈশোর ও তারুণ্যবান্ধব সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সংবেদনশীল একটি সমাজ গঠনে কিশোর-কিশোরীদের এ বিষয়ে যথাযথভাবে সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি। তাই গ্রামীণ পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ইউনিয়ন পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে 'ফ্লেক্সি সময়' বা সহনীয় সময় প্রবর্তনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
শঙ্কর কুমার দাশ বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলা গলাচিপা। এখানে নারীরা দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সহজে ঘরের বাইরে যেতে চান না। এ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হয়েছে মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন প্রকল্প। গলাচিপা প্রকল্প এলাকায় প্রধানত তিনটি পণ্যের ভ্যালু চেইন নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এগুলো হলো- পান, মুগডাল এবং সবজি। এখানে নারী উদ্যোক্তারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঢাকার বাজারে তাদের উৎপাদিত পান বাজারজাত করেন। ঢাকার ব্যবসায়ীরা এখানে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। মুগডাল উৎপাদনে জড়িত নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে এর বৃহৎ ক্রেতারা যুক্ত আছেন। কালেকশন পয়েন্ট ব্যবহার করে নারী উদ্যোক্তারা তাদের মুগডাল বিক্রি করেন। এতে তাদের পরিবহন ব্যয় এবং সময় দুই-ই সাশ্রয় হয়। তারা পরিবারের অন্যান্য কাজ ও কৃষি খামারে ব্যয় করতে পারছেন।
মো. জামাল উদ্দিন বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। আয় করছেন বলে তারা পরিবারে বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছেন। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে ওই পরিবারগুলোতে পারিবারিক সহিংসতা কমেছে।
নারায়ণ চন্দ্র রায় বলেন, ৫০ ভাগ নারী উদ্যোক্তার ব্যবসায়িক লাইসেন্স রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারী উদ্যোক্তাদের অধিক পরিমাণে ঋণ দিচ্ছে। নিজস্ব আয় থেকে নারী উদ্যোক্তারা তার ও পরিবারের নারীদের জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য উপকরণ কিনছেন এবং নিয়মিত ব্যবহার করছেন। এতে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হয়েছে। ফলে নারীরা বেশি করে ব্যবসায়িক কাজে সময় দিতে পারছেন। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের সহযোগিতায় স্থানীয় এবং আঞ্চলিক বড় সবজি পাইকারদের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কালেকশন পয়েন্টের মাধ্যমে তারা সরাসরি উৎপাদিত কৃষিপণ্য পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে পারছেন।
সভায় নারী উদ্যোক্তারা বলেন, আগে নারীদের বাজারে প্রবেশাধিকার ছিল না। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এর পক্ষে না। আবার দালাল ধরে পণ্য বাজারে পাঠালে লাভ বলতে কিছু থাকে না। এখন এই প্রকল্পের সহযোগিতায় বাজারে বসে ও কালেকশন পয়েন্টে নারীরা তাদের পণ্য নিয়ে পুরুষের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন। তারা বলেন, গ্রামের বেশিরভাগ নারীই অবহেলিত। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অথচ এখন নিজেদের আয়ে সংসার চলে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও জোগাই।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com