
সমাজ
অগ্রগতির সঙ্গে চাই সুশাসন
প্রকাশ: ২৮ জুন ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জুন ২১ । ০২:৫৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাজ্জাদ কাদির

জাতিসংঘের সাসটেইন্যাবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) গত ১৪ জুন যে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। এর ক'মাস আগে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। বাংলাদেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে উন্নয়ন-অগ্রগতির ছোঁয়া লাগেনি। আজকের এই অবস্থানে আসতে ৫০ বছর পর্যন্ত পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। ৫০ বছরের বাংলাদেশের ঝকঝকে উন্নয়নের আলো যেমন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তেমনি এই সুদীর্ঘ সময় পরও কিছু বিষয় আমাদের চরম ব্যথিত করে। সেই বিষয়গুলোতে খুব বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। নইলে এক পর্যায়ে এ উন্নয়ন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। দ্রুত ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতি গরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। অতি গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বাস করে। বিশ্বব্যাংকের 'দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮' শীর্ষক প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র মানুষ আছে এমন ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের এমন অবস্থান উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে আজও সুস্থ ধারার রাজনীতি তৈরি হয়নি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলে বিপুলসংখ্যক দুর্বৃত্ত এসে ভিড় করে। ফলে রাজনীতি আজ বিত্তবৈভবে পূর্ণ হয়ে গেছে। বিত্ত নয়; রাজনীতিতে ত্যাগ আর চিত্তকে মূল্যায়ন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাজনীতিতে আরেকটি দুর্বল দিক হচ্ছে, দেশে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে না ওঠা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরেই অনেকবার দেশ পরিচালনা করা দল বিএনপিকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ গত এক যুগে বিএনপি কোনোভাবেই শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি।
সরকারি কর্মে সীমাহীন দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য এক বড় সমস্যা। উন্নয়ন-অগ্রগতির এক বড় অংশ চলে যায় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী, টেন্ডারবাজ-ঠিকাদারদের পকেটে। আমরা প্রায় ৮৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি গার্মেন্ট শিল্প থেকে। গার্মেন্টের ওপর নির্ভরশীল না থেকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে জোর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য উৎপাদনে আমরা ইতোমধ্যে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে বিস্ময় সৃষ্টি করেছি। এখন প্রয়োজন কৃষিপণ্যের গ্লোবাল মার্কেটিং।
বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী এখন ঝকঝকে বাড়িতে বসবাস করে, ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে, বিমানে যাতায়াত করে, দামি পোশাক পরে, দামি রেস্টুরেন্টে খেতে যায়, দেশে-বিদেশে আনন্দভ্রমণ করে। কিন্তু মননশীল ও সৃজনশীল জায়গায় মানুষের উপস্থিতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছে। এক সময়ের জ্ঞানভিত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এতে মানুষের বিত্ত তৈরি হচ্ছে, কিন্তু চিত্ত তৈরি হচ্ছে না। সারাদেশে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার জায়গায় ঘাটতি চোখে পড়ছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বন্ধের উপক্রম। দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় বিনোদনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। প্রদর্শনের জন্য মানসম্মত সিনেমা তৈরি হচ্ছে না। টিভি ও ওয়েব নাটক নামের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটির দাপটই বেশি। খেলাধুলার কোনো ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। মাঠের সংকুলান না থাকার কারণে ক্রীড়াচর্চা কমে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস কমছে। খেলাধুলা ও বই পড়ার পরিবর্তে তারা সময় কাটাচ্ছে অনলাইনে।
আমাদের সরকারি-বেসরকারি কোনো ক্ষেত্রেই চিকিৎসাসেবা উন্নত নয়। সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা সীমাহীন; সেবার মান অত্যন্ত নিম্নমুখী। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য বাণিজ্য। আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা মোটেই সুখকর নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বহু পিছিয়ে রয়েছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। আমাদের জনপদের প্রাণ নদীগুলোকে দিন দিন মেরে ফেলা হচ্ছে।
এই সামগ্রিক যে অনিষ্ট, এতে মানুষ আবেগ-অনুভূতিহীন যন্ত্রে পরিণত হয়ে পড়ছে। স্বার্থ ছাড়া কেউ এক পা-ও চলতে চায় না। আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ৫০ বছর সংখ্যাটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। আবার আমাদের আবেগ-অনুভূতি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের জায়গায় অনেক ক্ষেত্রে আমরা তলানিতেই পড়ে আছি। উন্নয়ন-অগ্রগতির আত্মতৃপ্তি থাকতে হবে, সেই সঙ্গে ব্যর্থতা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হওয়া উচিত। ব্যর্থতাগুলো জয় করার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বের একটি সফল রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
গণমাধ্যমকর্মী
sazzadkadir71@gmail.com
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com