উদ্যোক্তা নারীর জন্য বাজার

জীবনযুদ্ধের মাঠে অদম্য জাহেনূর

প্রকাশ: ২৮ জুন ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জুন ২১ । ০৩:০১ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাজিদা ইসলাম পারুল

গাইবান্ধার ধুবনী কাঞ্চিবাড়ী গ্রামের নিজ ক্ষেতে জাহেনূর বেগম- সমকাল

গত পাঁচ বছরে ৩৩ শতক জমি কিনেছেন জাহেনূর বেগম। তৈরি করেছেন নতুন বাড়ি। হরেক রকমের শাকসবজির পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন করছেন। কোরবানির ঈদের জন্য করছেন গরু পালন। দুটি পুকুরে মাছ চাষ করছেন। বর্তমানে জাহেনূরের মাসিক আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

অথচ কয়েক বছর আগেও অভাব ছাড়া আর কিছুই ছিল না জাহেনূরের। ২০০১ সালে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের ধুবনী কাঞ্চিবাড়ী গ্রামে বাবলু মিয়ার সঙ্গে সংসার পাতেন তিনি। তবে জামাইকে বিয়েতে যৌতুক হিসেবে ৪৯ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল তার পরিবারের। কিন্তু গরিব বাবা টাকা দিতে পারছিলেন না। তখন জাহেনূরের ওপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে বাবার বাড়ি চলে যান তিনি।

কিন্তু কিছুদিন পর নিজের ভেতর টের পান আরেক প্রাণের অস্তিত্ব। এ সন্তানের কারণেই সংসার বেঁচে যায় তার। তবে জাহেনূর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে রাজি হননি। স্বামী বাবলু তাকে নিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। শুরু হয় দু'জনের চার হাতে টিকে থাকার লড়াই। জাহেনূর চাকরি নেন স্থানীয় গার্মেন্টে। তবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার 'অভিযোগে' দু'মাস পরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন বাবলু মিয়াই রিকশা চালিয়ে সংসার নির্বাহ করতে থাকেন। এভাবেই কোনোভাবে খেয়ে-পরে কাটতে থাকে তাদের জীবন।

তবে দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হলে দুই পরিবারের মধ্যে সমঝোতা হয়। আবার গাইবান্ধায় ফিরে আসেন তারা। প্রথমদিকে কোনো সমস্যা না থাকলেও কিছুদিন পর ফের মানসিক নির্যাতন শুরু হয় জাহেনূরের ওপর। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের শুরুতে ফের চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার চিন্তা করেন তিনি।

এরই মধ্যে জাহেনূরের সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হয় একশনএইড বাংলাদেশের 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)' প্রকল্পের মাঠ সহকারী রিনা পারভীনের সঙ্গে। রিনার পরামর্শে নতুন এক যুদ্ধে নামেন জাহেনূর। সেই শুরু- এই প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ স্বাবলম্বী তিনি।

সমকালের সঙ্গে আলাপচারিতায় জাহেনূর বলেন, 'বাড়িতে তুমুল কাইজ্জা (ঝগড়া) চলছিল। তাই গাছের তলে বসে কাঁদতেছিলাম। অপূর্ব মহিলা সমিতির (স্থানীয় এনজিও) কিস্তি পরিশোধের দিনে রিনা আপার লগে দেখা অয়। নিজে থিকাই আইসে আমার দুঃখের কথা শোনেন। সব শুনে তিনি পরামর্শ দেন। পরামর্শ শুনে আমিও চিন্তা করি, আমার জীবনে এতো যুদ্ধ চলতেছে! দেখি না, এ যুদ্ধটা কেমনে করতে হয়।'

তিনি বলেন, 'এর পরেই বাড়ির পাশে পড়ে থাকা অনাবাদি জায়গায় শাকসবজি চাষ করি। এসব সবজির বীজ ও সার দিয়েছেন আপা নিজেই। দুই হাজার টাকাও দিছিলেন। সেই থেকে আমি চলতে শিখছি। এখনও চলছি। এখন আমার কোনো কষ্ট নাই। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও মানে। আমার থিকা পরামর্শ নেয়।'

জাহেনূর বেগমকে সবজি, হাঁস-মুরগিকে টিকা প্রদান ও মাছ চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে রিনা পারভীন জানান, এসব প্রশিক্ষণের কারণে তিনি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজি ও মাছ চাষ করতে পারছেন।

২০১৬ সালে এসকেএস ফাউন্ডেশন মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ) প্রকল্পের সদস্য হওয়ার পর জাহেনূর শাক-সবজি চাষের প্রশিক্ষণ পান। বিভিন্ন ধরনের ইনপুট ও আউটপুট অ্যাক্টরদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। আধুনিক পদ্ধতিতে জমিতে সারাবছর শাক-সবজি চাষ করে জীবন পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যান তিনি। তার সফলতা ও আগ্রহ দেখে প্রকল্প কর্মকর্তারা তাকে হাঁস-মুরগির টিকা প্রদানের বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেন।

জাহেনূর এ প্রশিক্ষণ নিয়ে মানুষজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের হাঁস-মুরগিকে টিকা দিচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে ভালো আয়ও করছেন। পাশাপাশি কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে চারটি গরু মোটাতাজা করার কাজও করছেন। গরুগুলো ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রির ব্যাপারে অনলাইন মার্কেটপ্লেস 'দারাজ' যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে। তিনি তার স্বামীকে একটি অটোভ্যান কিনে দিয়েছেন। সেটি থেকে অন্তত ২০ হাজার টাকার সংস্থান হচ্ছে। জাহেনূর-বাবুল দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা স্কুলে যাচ্ছে।

কথা হয় জাহেনূরের ছেলে মো. জাহিদ হাসান সাগরের সঙ্গে। সাগর জানায়, পাশের ধুবনি বাজারের মহিলা মার্কেট কর্নারে গিয়ে তার মা উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা ট্রাকে করে এখান থেকে সবজি নিয়ে যান।

মেয়ে বাবলী আক্তার বন্যা জানায়, তাদের সংসারে আর কোনো অভাব নেই। পরিবার ও সমাজে নানা সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও অংশ নিচ্ছেন তার মা। কৃষি কাজের পাশাপাশি জাহেনূর বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ স্ট্যান্ডিং কমিটি ও সিএসজি কমিটির সদস্যসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের সদস্য পদে আছেন।

এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সহযোগী সংস্থার সমন্বয়কারী কৃষিবিদ জামাল উদ্দিন বলেন, কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাত করতে পারেন এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিখতে পারেন, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে কৃষকদের যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গ্রামে জাহেনূর বেগমের মতো অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষিকাজসহ নানা রকমের ব্যবসায়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন তারা। তবে বিদ্যমান বাজারব্যবস্থা গ্রামীণ জনপদে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

একশনএইড বাংলাদেশের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, 'এলজিইডি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান। কাজেই এলজিইডি গ্রামীণ নারীদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করার সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নারীবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে এলজিইডি এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে গ্রামীণ কমিউনিটিতে নারীবান্ধব কালেকশন পয়েন্ট এবং গ্রামীণ বাজারে নারীবান্ধব মার্কেট শেড নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমাদের সবার প্রত্যাশা।'

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com