যাত্রা শুরুর দিন: ১ জুলাই ১৯২১

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সৈয়দ আবুল মকসুদ

১৯২১ সালের ১ জুলাই যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। একটি অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী, শওকত আলীদের নেতৃত্বে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনে তখন ঢাকা খুবই উত্তপ্ত। ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অভূতপূর্ব অবনতি ঘটেছিল। কংগ্রেস কর্মীদের জোর বেশি। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধীপক্ষও দুর্বল ছিল না। ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ প্রথমে ছিলেন দোদুল্যমান; পরে আন্দোলনের বিরোধী শিবিরে যোগ দেন। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন তিনি সমর্থন করেননি। অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন ফজলুল হক, মুক্তাগাছার জমিদার জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরী, শেরপুরের জমিদার রায়বাহাদুর চারুচন্দ্র চৌধুরী, মহারাজা শশীকান্ত আচার্য, বরিশালের খানবাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন, যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ, হাকিম হাবিবুর রহমান, রেবতী মোহন বর্মণ, প্রদ্যোৎ কুমার ঠাকুর, নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা, নবাব সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার প্রসার; ভারতে একটি স্বশাসিত ও আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা আবাসিক ও শিক্ষাক্রম একই সঙ্গে পরিচালনার জন্য ভারত সরকারের ইচ্ছা পোষণ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর থেকে শিক্ষার চাপ কমানো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শুরু থেকেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পূর্ব বাংলার সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ উপকৃত হয়েছে। বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে গ্রামীণ মুসলমান মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে ২৫ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলায় একটি নতুন হিন্দু-মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়, যারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ১ জুলাই ১৯২১ একটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন। বিশেষ করে বাঙালির আধুনিক উচ্চশিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন কার্যক্রম যতটা আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনায় হতে পারত, তা হয়নি। সেদিনের ঐতিহাসিক আনুষ্ঠানিকতা ছিল আনন্দ ও বেদনায় মিশ্রিত। পূর্ব বাংলা ও ঢাকার গণ্যমান্য অনেকেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। প্রধানত সরকারি কর্মকর্তারাই কার্জন হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক বিশিষ্ট নাগরিক যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এক অনাড়ম্বর কিন্তু ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নবাব হাবিবুল্লাহ, নবাব পরিবারের খানবাহাদুর খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়টি উপমহাদেশের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ক্রান্তিকাল। তখন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং শওকত আলী-মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন উত্তাল আকার ধারণ করেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। অনেকে সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভে অংশ নিয়ে কারাবরণ করছিলেন। ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ঢাকার হিন্দু-মুসলমান বহু নেতা কারাভোগ করেন। এমনকি রাজভক্ত ঢাকার নবাব পরিবারেরও কেউ কেউ কারাবরণ করেন।

যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়, সেদিন বাঙালি হিন্দু-মুসলমান বহু নেতা কারাগারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকার হিন্দু ও মুসলমান অনেক নেতাই যোগ দিতে পারেননি। 'বন্দে মাতরম' ও 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনিতে ঢাকার প্রতিটি পাড়া-মহল্লা মুখরিত সর্বভারতীয় নেতারা ঢাকা সফর করেন এবং হিন্দু-মুসলমান সম্প্র্রীতির ওপর জোর দেন। ১৯২০-এর ১৮ মার্চ করোনেশন পার্কে এক জনসভায় বিপিনচন্দ্র পাল হিন্দু-মুসলমানের মিলনে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এই বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী করতে হবে। তবে সেই বন্ধুত্ব ছিল স্বল্পস্থায়ী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনের অসহযোগ আন্দোলন থেকে নবাব হাবিবুল্লাহ, একে ফজলুল হক নিজেদের সরিয়ে নেন। ফজলুল হক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলমানরা। কারণ তারা এমনিতেই পিছিয়ে। এভাবে লেখাপড়া ফেলে রাজপথে আন্দোলন করলে এবং সে জন্য কারাভোগ করলে মুসলমানরা আরও পিছিয়ে পড়বে শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়; চাকরিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে খাজা ইউসুফের তৎপরতা ছিল অসামান্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ফজলুল হকের অবদান অসামান্য হলেও ১৯২০-২১ সালে তার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো ছিল না। কারণ তিনি সে সময় কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশ করছিলেন সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি সরকারকে পূর্ণ সহায়তা দেন।

শিক্ষক নিয়োগের আগে উপাচার্য হার্টগ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে বাছাই কাজটি করেছিলেন তিনি সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার সঙ্গে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সাক্ষাৎকার নেন প্রার্থীদের। তারপর নেন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ। তার নীতি ছিল- সংখ্যায় কম হলেও সবচেয়ে যোগ্যদেরই তিনি নিয়োগ দেবেন।

একটি কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের চেয়ে সরকারি কলেজের ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস (আইইএস) ও বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসের (বিপিইএস) অধ্যাপকদের বেতন ছিল বেশি। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ইস্তফা দিয়ে সরকারি কলেজের অধ্যাপক হয়েছেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন বাংলার খ্যাতিমান পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ। নিষ্ঠাবান গবেষক। জনশিক্ষা বিভাগেও তার চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃতের প্রধান অধ্যাপক এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। বিরাট তার পাণ্ডিত্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্য বিষয়ে। তাকে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রফেসর নিযুক্ত করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটিই ছিল উপমহাদেশে অনেকটা নতুন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা। অবকাঠামোগত দিক থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এখানে উন্মুক্ত জায়গায় থাকবে বড় বড় সুরম্য ভবন, খেলাধুলার জন্য সবুজ মাঠ; থাকবে সুপরিসর পাঠাগার, মূল্যবান গ্রন্থসমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রভৃতি। নগরের কোলাহলমুক্ত ছাত্রাবাসগুলোতে বাস করবেন শিক্ষার্থীরা; জ্ঞানচর্চা করবেন নির্বিঘ্নভাবে সুযোগ্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে যা কিছু ভালো তা গ্রহণ করে এখানকার শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলবেন তাদের জীবন।

প্রথম তিন দশকে সেভাবেই এগোচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ছিলেন অতি মেধাবী ও পরিশ্রমী। মাঝারি মানের শিক্ষার্থীর জন্যও খোলা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা। কারণ শুধু অল্প কিছু অতি মেধাবীকে দিয়ে একটি মহৎ জাতি গঠিত হয় না। প্রথম পর্যায়ে তারা নৈতিক দিক থেকেও ছিলেন আদর্শস্থানীয়। এখান থেকে বেরিয়ে যারা কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, তারা সততা ও কর্তব্যপরায়ণতায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন; সবাই না হলেও বিপুল অধিকাংশ। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে তারা নৈতিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। এখান থেকে বেরিয়ে যারা ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য গেছেন, সেখানেও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। বয়ে এনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সুনাম।

'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা' গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com