কভিড-১৯

তরুণ-তরুণীদের চাই মানসিক সমর্থন

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ১৮ জুলাই ২১ । ০২:৫৭ | প্রিন্ট সংস্করণ

মৌলি আজাদ

সমকালের ১ জুলাইয়ের 'চাকরির বাজারে করোনার থাবা' শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েছে, 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মইনউদ্দিন। ২০১৯ সালের মাস্টার্স ব্যাচের ছাত্র তিনি। সরকারি ৪টি দপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেছেন। মহামারি করোনার কারণে একটিরও নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি। একই কারণে তার একাডেমিক পড়াশোনাও শেষ হয়নি।'

১০ জুলাই আরেকটি জাতীয় দৈনিকে 'আঁচল ফাউন্ডেশন'-এর একটি জরিপ দেখতে পাই। যারা অনলাইনে ২০২৬ তরুণ-তরুণীর ওপর 'আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা' বিষয়ে জরিপ কাজ চালিয়েছিল। জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে তরুণ-তরুণীরা ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকিত্ব, পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, সেশনজট ও মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তিতে ভুগছে। মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার কথাও ভাবছে। মানসিক চাপে পড়ে ২৯ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী শারীরিক বা অন্যান্য উপায়ে নিজেদের ক্ষতি করছে।

এ দুটি রিপোর্ট পড়ার সময় ফিরে গেলাম আমার বিশ্ব্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনগুলোতে। আমাদের মতো দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মা-বাবারা অনেক কষ্ট করে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা করান এবং আশা করেন, সন্তান পাস করে একটি চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরবে। আর তাই আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। তাদের চিন্তার জগৎজুড়ে থাকে কেবল একটি চাকরি। সরকারি চাকরি সোনার হরিণ। বেসরকারি চাকরি পাওয়াও সহজ কথা নয়। সব দিকে বিরাট প্রতিযোগিতা ও টেনশন। এ দেশে ২৪-২৫ বছরের তরুণ-তরুণীদের জীবনের সুন্দর সময়ে চাকরি বা নানা দায়বদ্ধতার মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে হয়। তাদের নিজের চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে পারিপার্শ্বিকতা। তাদের কেউ যখন চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে ঘরে-বাইরে নানা কথা শুনতে হয়। কথাগুলো কোনোটাই মধুর নয়- আর কত দিন বসে বসে খাবি? এখনও চাকরি পেলি না! তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ওমুকে তোর বয়সে এস্টাবলিশ হয়ে গেছে; তুই এখনও পারলি না! এসব আমাদের দেশের অভিভাবকদের যেন কমন ডায়ালগ। এ কথাগুলো যাকে বলা হয়, তার হৃদয়টা যে কষ্টে দুমড়েমুচড়ে যায়, তা বোধ হয় অভিভাবকরা চিন্তাও করেন না। তরুণীদের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হয় বিয়ের চাপ। অনেক ক্ষেত্রে নারীর বিশ্ববিদ্যালয় পাসের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে না হলে তার বয়স-রূপ ইত্যাদি নিয়ে অভিভাবকসহ পাড়া-প্রতিবেশীরও ঘুম হয় না।

বর্তমানে করোনা মহামারির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা যে প্রবল মানসিক চাপে আছে তা ওপরের দুটি রিপোর্ট থেকেই বোঝা যায়। শিক্ষার্থীদের এমন মানসিক অস্থিরতার সময়ে কাকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে? প্রথমত তার পরিবার। পরিবারকে সেই তরুণ-তরুণীর মানসিক অবস্থা অনুভব করতে হবে। বুঝতে হবে, এতে তার কোনো দোষ নেই। এটা মহামারি, বৈশ্বিক সমস্যা। শুধু আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা নয়; বিশ্বের সব দেশের তরুণ-তরুণীরা শিক্ষা বা চাকরিতে পিছিয়ে গেছে। তাদের হাতে আগে যে কাজগুলো (টিউশনি ইত্যাদি) ছিল তা হারিয়ে যাওয়ায় নিজেরাই ভেতরে ভেতরে লজ্জিত। তাদের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে- এ ভেবেও তারা চিন্তিত।

তাদের পেছন থেকে আর খোঁচা দেওয়ার দরকার নেই। তাদের দরকার প্রবল মানসিক সাপোর্ট। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিন। দূর প্রত্যন্ত অঞ্চলের আপনার যে শিক্ষার্থী ছিল, তার শারীরিক বা মানসিক অবস্থা জানুন। আজকাল বলতে গেলে সবারই মোবাইল ফোন আছে। শিক্ষার্থীকে ফোন করে যদি দু-এক দিন খোঁজ নেন, দেখবেন তার মনোবল কতটা বেড়ে গেছে! যারা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, তারা বিনা মূল্যে এ সংকটে তাদের পরামর্শ দিন, তাদের পাশে থাকুন। কারণ এ রকম বাজে-অস্থির অবস্থা আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কাটিয়ে এসেছি।

তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে বলি, পৃথিবীতে সমস্যা আছে, থাকবে। কিন্তু কোনো সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। সমাধানের নানা পথও আছে। তাই এ সময়ে মনের অস্থিরতা বন্ধু বা কাছের কারও সঙ্গে শেয়ার করো। একা একা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিও না। যারা পজিটিভ মানসিকতার নয়, তাদের সঙ্গে যত কম মিশবে, ততই মঙ্গল। শরীরের যত্ন নিয়ে, বাসায় থেকে যতটা নিজেকে সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করা যায়, তাই করো। চাকরির চিন্তায় ডুবে না থেকে বিকল্প পথ খুঁজতে পার। নিজেকে নিজেই সাহস দাও। কারও কাছে কোনো কিছু পাবে- এ প্রত্যাশা করো না। পৃথিবীতে আসলে কেউ কারও নয়। জীবন তোমার- সিদ্ধান্ত তোমার। একটি পজিটিভ সিদ্ধান্তই একদিন তোমাকে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। ভবিতব্য কে জানে, বলো?

মনে রেখো, জীবনে হতাশার সময়টা কিন্তু খুব দীর্ঘ নয়। হতাশা দূর হবেই। আর এ দুঃসময়ে যে ভালোমন্দ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলে, তা কিন্তু অমূল্য।

লেখক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com