
প্রাণিজগৎ
সিজারিয়ানে বাঁচল বিড়ালি
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২১ । ০২:১৭ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. আ ন ম আমিনুর রহমান

বশেমুরকৃবির ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালে জটিল অস্ত্রোপচার শেষে বিড়ালিটি- লেখক
আমি যখন অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলাম, তখন ড. অনুপ কুমার তালুকদার ও ড. জীবন চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির কাজ শুরু হয়ে গেছে। জীবাণুমুক্ত সার্জিক্যাল অ্যাপ্রোন, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে আমি ও ড. আতাউর রহমান সার্জারিতে যোগ দিলাম। কীসের অপারেশন ছিল এটি? একটি বিড়ালের জীবন রক্ষার অপারেশন! অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে দেখলাম, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছেন বিড়ালটির মালিক মহিলা। তার দিকে তাকালে যে কেউ মনে করবেন, তার কোনো নিকটাত্মীয়ের অপারেশন চলছে। আসলেই তাই। বিড়ালটি যেন তার আত্মীয়ের থেকেও বেশি কিছু; তার আরেকটি মেয়ে, যার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
৩০ বছর আগের কথা। তখন আমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম), অর্থাৎ প্রাণিচিকিৎসার ছাত্র। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি ক্লিনিকে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রাণীর নানা ধরনের সার্জারি করা হতো। কিছু প্রাণিপ্রেমী মানুষ তখনও দেখেছি। কিন্তু এই ৩০ বছরে এসব মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে বহু গুণ, তেমনি দেশে বেড়েছে ভেটেরিনারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ভেটেরিনারি চিকিৎসার মান। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় জেলা শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বেড়েছে; বিশেষ করে পোষা প্রাণী অর্থাৎ কুকুর, বিড়াল ও পাখির। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) ভেটেরিনারি টিচিং হসপিটাল (ভিটিএইচ) মাত্র দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলত বশেমুরকৃবির ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিভিএম শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে প্রাণিচিকিৎসা শেখানোর জন্য। ভিটিএইচে প্রাণিচিকিৎসার অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামসহ এক দল অভিজ্ঞ ও তরুণ প্রাণিচিকিৎসক রয়েছেন, যারা ভবিষ্যৎ প্রাণিচিকিৎসক তৈরির পাশাপাশি প্রাণীর চিকিৎসাসেবায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। হাসপাতালের প্রথম পরিচালক হিসেবে আমি গত ৩০ জুন দুই বছর পূর্ণ করে বিদায় নিলাম। এ দুই বছরে আমরা বেশ কিছু পোষা প্রাণীর চিকিৎসা করেছি, যার মধ্যে দেশি বিড়ালের সংখ্যাই বেশি। অবশ্য করোনা মহামারি না থাকলে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি হতো বলে আমার বিশ্বাস। সম্প্রতি হাসপাতালের অত্যাধুনিক এক্স-রে মেশিনের সাহায্যে বন বিভাগের সাতটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপের ডিম না পাড়ার কারণ উদ্ঘাটন করেছি আমরা।
প্রসববিঘ্ন বা ডিস্টোকিয়া মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রসবকালীন একটি জটিল সমস্যা। এতে মা ও নবজাতক উভয়েরই মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। তবে গবাদি ও অন্যান্য পোষা প্রাণীর তুলনায় বিড়ালে এ সমস্যা অনেক কম। দেশের বিভিন্ন ভেটেরিনারি বা প্রাণিচিকিৎসা হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিড়ালের বিভিন্ন রোগ চিকিৎসার তথ্য-উপাত্ত থেকে দেশি স্ত্রী বিড়াল, অর্থাৎ বিড়ালির জটিল প্রসববিঘ্ন সমস্যার ক্লিনিক্যাল কেস রিপোর্ট কিংবা গবেষণালদ্ধ তথ্য তেমন একটা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া এ বিষয়ে প্রাণিচিকিৎসকদের প্র্যাকটিসও সামান্য। প্রসববিঘ্ন সমস্যা সমাধানে সচরাচর প্রথমে ওষুধ প্রয়োগ, পরে অস্ত্রোপচারের সাহায্য ছাড়া হাতে বাচ্চা প্রসব করানোর চেষ্টা করা হয়। তবে এ পদ্ধতি ব্যর্থ হলে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারই (Caesarian section) শেষ ভরসা।
সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার সি-সেকশন বা সিজারিয়ান ডেলিভারি নামেও পরিচিত। এটি এক ধরনের শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি, যার ফলে তলপেট ছেদনের মাধ্যমে মায়ের জঠর (Uterus) বা গর্ভ থেকে এক বা একাধিক বাচ্চা বের করে আনা হয়। এটি সচরাচর তখনই করা হয়, যখন স্বাভাবিক উপায়ে যোনির মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত প্রসবকষ্ট, যমজ গর্ভাবস্থা, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভে বাচ্চা উল্টে থাকা, গর্ভফুল ও নাভি-সংক্রান্ত সমস্যা ইত্যাদির কারণে সিজারিয়ান করা হয়। সিজারিয়ান রোমান শাসনামল থেকেই প্রচলিত। সে সময় এটি মৃত মায়ের গর্ভ থেকে জীবিত বাচ্চা উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হতো।
শুরুতেই যা বলছিলাম, গাজীপুর জেলার সালনায় অবস্থিত বশেমুরকৃবির ভিটিএইচের এক দল বিশেষজ্ঞ প্রাণিচিকিৎসক সম্প্রতি জটিল প্রসববিঘ্নে আক্রান্ত বিড়ালির প্রথম বাচ্চা প্রসবের ৩৬ ঘণ্টা পর সিজারিয়ান করে তার জরায়ু থেকে দুটি মৃত বাচ্চা অপসারণ করে অবলা প্রাণীটির প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন। জানামতে, দেশি বিড়ালিতে আমাদের এই অপারেশন বিশ্বব্যাপী জটিল প্রসববিঘ্নের প্রথম সফল সিজারিয়ান অপারেশন, যার ফলাফল এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্স নামে একটি স্বনামধন্য গবেষণা সাময়িকীতে কেস স্টাডি হিসেবে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে।
এর কেস হিস্ট্রি নিয়ে দেখা যায়, বিড়ালিটি জরায়ুর অসাড়তার (Partial Primary Uterine Inertia) কারণে প্রসববিঘ্নে ভুগছিল। ফলে তার মালিক এটিকে স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জনের কাছে নিয়ে যান। সেখানে বিড়ালিটি একটি বাচ্চা প্রসব করলেও তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। কিন্তু এর পর ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও বিড়ালিটি আর কোনো বাচ্চা প্রসব করেনি। তা ছাড়া তার গর্ভফুলও (Placenta) আটকে ছিল। এ অবস্থায় সে বেশ কষ্ট পাচ্ছিল। তাই স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জন বিড়ালিটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বশেমুরকৃবির ভিটিএইচে নেওয়ার পরামর্শ দেন। আমাদের হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষায় বিড়ালিটির জরায়ুতে আরও দুটি মৃত বাচ্চার অস্তিত্ব ধরা পড়ে, যা আমরা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সফলভাবে বের করতে সক্ষম হই। এতে মৃতপ্রায় বিড়ালিটিও প্রাণে রক্ষা পায়। সিজারিয়ানের সময় জরায়ুতে পচন ধরার লক্ষণ দেখতে পাওয়ায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিড়ালিটির জরায়ু কেটে ফেলে দেওয়া হয়। তা না হলে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল। প্রসববিঘ্নের সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মৃত বাচ্চা বের করে মা বিড়ালকে প্রাণ বাঁচানোর বিশ্বব্যাপী এই প্রথম রেকর্ড নিঃসন্দেহে আমাদের অন্যান্য সার্জারি কাজে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
প্রাণী পোষা মানুষের প্রাচীনকালের সহজাত বৈশিষ্ট্য। তবে এ দেশে সার্বক্ষণিক পোষা প্রাণী হিসেবে এর আগে মূলত বিদেশি জাতের কুকুর-বিড়ালই বেশি পোষা হতো। সেগুলোর নিয়মিত টিকা প্রদান ও চিকিৎসা করা হতো। তবে আশার কথা, বর্তমানে এ দেশের মানুষের মধ্যে দেশি বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা, বিড়াল পোষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা যথেষ্ট বেড়েছে। এই পোষা প্রাণীগুলো রোগাক্রান্ত হলে ভেটেরিনারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে তারা এক মুহূর্তও দেরি করেন না। এদের টিকা প্রদান ও রোগ-চিকিৎসায় টাকা-পয়সা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। বেঁচে থাকুক প্রাণীদের প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা চিরকাল।
লেখক :অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com