সার্বিক উন্নয়নে 'বিবেক প্রতিবন্ধিতা!'

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২১ । ১৫:৫৭ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২১ । ১৭:০৮

মো. তানজিমুল ইসলাম

কভিড-১৯-এর রোষানলে পড়ে বর্তমানে পুরো বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও চরম এক ক্রান্তিকাল পার করছে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থী আজ হতাশায় কাতর হয়ে বিপথে গমন করছে। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় অভিভাবকগণ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে যারপরনাই অস্থিরতা! পাড়ার বখাটে ছেলেদের উৎপাতে আতঙ্কগ্রস্ত থাকে পুরো পরিবার। আজ কত দিন হলো শিক্ষাঙ্গনের মুক্ত বাতাস থেকে বঞ্চিত এ সময়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। খবরের কাগজ খুললেই করোনায় নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আর মৃত্যুর মিছিল দেখে দেখে বুকের ভেতর থেকে কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

করোনার হাত থেকে রক্ষা পেতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই! অনেকটা অনন্যোপায় হয়ে গৃহবন্দি কাটাতে হচ্ছে প্রায় সব শ্রেণিপেশার জনগণকে। এ যে কতটা কষ্টের। এ যে ভয়ংকর শাঁখের করাত অবস্থা। বিত্তশালী ব্যক্তিগণকে জীবিকায়নের জন্য বাইরে না বেরোতে হলেও ঘরবন্দি অবস্থায় থাকাটা যে এক ধরনের শাস্তিও বটে! অনেক ক্ষেত্রে বন্দি নিবাসের বিনোদনহীন জীবনে অকারণেই পারিবারিক সহিংসতা সংঘটিত হচ্ছে। আর যারা ক্ষুধা-দারিদ্র্যে জর্জরিত তারা তো নিরুপায় হয়ে জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে বেরিয়ে পড়ে দূর-দিগন্তে! তাদের কাছে 'করোনা'র চেয়েও ভয়ংকর ভাইরাসের নাম হলো 'ক্ষুধা'! সরকারি আইন, বিধিনিষেধ কোনো কিছুতেই তাদের আপত্তি নেই বৈকি! কিন্তু দিনশেষে স্ত্রী-সন্তানসহ বৃদ্ধ মা-বাবা যখন ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাতে থাকেন, তখন কে-ই বা মানতে পারে ওই রাষ্ট্রীয় আদেশ। কতিপয় মানুষের কছে 'লকডাউন/ শাটডাউন' যেন একটি দেশের নিম্ন আয়ের বিশেষ করে দিনমজুরদের মতো জনসংখ্যাকে কষ্ট দিয়ে নিধন করার একটি কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। এমতাবস্থায় মধ্যম আয়ের দেশের সংজ্ঞা কি পাল্টে যাবে?

মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রাক্কালে আমাদের কেমন যেন টালমাটাল অবস্থা হয়ে গেল! ২০২০ সালে কিছুটা সহনীয় অবস্থায় এগোচ্ছিলাম; আর ২০২১ সালে এসে গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে কোথাও আর বাকি রইল না! সকল সম্ভাবনার এ দেশে, দরিদ্র হলেও দাম্পত্যজীবনে সুখী জনৈক নারীকে কলমের খোঁচায় অথবা যন্ত্রের কৌশলে 'বিধবা' অথবা 'স্বামী পরিত্যক্ত' বানিয়ে দেওয়া হয় রাতারাতি! কথিত রয়েছে, প্রতি তিন মাস পর পর 'বিধবা ভাতা' অথবা 'স্বামী পরিত্যক্তর ভাতা' এমনকি 'বয়স্ক ভাতার' একটা বড় অংশ ওই অদৃশ্য ছায়ার ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠীকে উপঢৌকন হিসেবে উপহার দিতে হয়। মোট কথা, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষিতজন কর্তৃক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রক্ত চুষে নেওয়ার একটি কৌশলের নমুনা মাত্র! করোনাকালে এই কঠিন সময়ে স্বল্প আয়ের মানুষের যে কী ভয়াবহ অবস্থা, তা আমরা প্রত্যেকেই জানি কমবেশি। পক্ষান্তরে, তাদের প্রতি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে প্রত্যেকেই যেন বেশ তৎপর! সুশীল সমাজের দৃষ্টিও যেন কেবল তাদের দিকেই! আমাদের মতো নিরুপায় মানুষের মন কেবলই ফুঁঁপিয়ে ফুঁঁপিয়ে কাঁদে নীরবে-নিভৃতে। কেউ কি নেই তাদের নিয়ে ভাববার?

আজকাল করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরেজমিনে কতিপয় প্রথম শ্রেণির নির্বাহী অফিসারগণও মাঠে নেমেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা রাষ্ট্রীয় আদেশ পালন করছেন। অন্তত জনগণকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত মহামারি থেকে রক্ষা করবার জন্য তাদের যে নিরলস প্রয়াস, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। একই সঙ্গে এমনও খবর পাওয়া যায়, যেখানে একজন ছোটখাটো চাল ব্যবসায়ীর দোকানের প্লাস্টিকের বস্তায় চাল রাখার অপরাধেই তাকে তৎক্ষণাৎ জরিমানা করা হয় একটি মোটা অঙ্কের টাকা! যে টাকা আয় করতে কারও হয়তো ছয় মাস লেগে যেতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই বস্তার চাল এসেছে ভারত থেকে এলসির মাধ্যমে! প্লাস্টিক ব্যবহার যদি নিষিদ্ধই হয়ে থাকে, তাহলে কীভাবে ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে এ দেশে ওইসব বস্তার অনুমোদন হলো?

করোনাকালীন সময় ছাড়াও ব্যাটারিচালিত অটো চার্জার রিকশাগুলোকে হঠাৎই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কখনও আবার নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নিম্ন আয়ের এ জনগোষ্ঠী যখন এই মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে নিজেরাও অবদান রাখার স্বপ্নে বিভোর, ঠিক সেই মুহূর্তে আইনের বেড়াজালে তাদের আটকে রাখা হচ্ছে! ঘটনাটি নিবিড়ভাবে বিশ্নেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, ওইসব চার্জার ব্যাটারিচালিত রিকশা বা এর যন্ত্রাদি বিদেশ থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আমদানি করা হয়। তবে কি এসব পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব কী কেবলই ওই নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর?

লোক দেখানো ত্রাণ বিতরণের নামে সেলফিবাজদের অভাব নেই! সময়ের ক্রমধারায় করোনার প্রকোপ থেকে এক দিন নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে এদেশের জনগণ! কিন্তু 'মানুষ' নামক 'ভয়ংকর ভাইরাসদের' হাত থেকে মুক্তি মিলবে কবে ও কীভাবে? এ রকম অপ্রত্যাশিত ও অস্থিতিশীল অবস্থার সাক্ষী আমরা প্রায় প্রত্যেকেই! বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নিশ্চয়ই এই আর্তনাদ ও আমাদের করণীয় সম্বন্ধে খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছি। কিন্তু কেন জানি মুখ খুলতে চাই না! দিনে দিনে আমাদের কেমন জানি প্রতিবন্ধিতা গ্রাস করেছে! হাত, পা, চোখ, কান, সবকিছুই সচল থেকেও যারা নির্বিকার, তারা আসলে শোষিত সমাজের এক কোণঠাসা জনগোষ্ঠী। আর যারা ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে তাদের রক্ত চুষে খেতে চরম পিপাসার্ত, তারা আসলে সুস্থ নন। তারা প্রজন্মকে পিছিয়ে দেওয়ার এক ভয়ংকর ভাইরাস! এ ভাইরাসের প্রকৃত নাম 'বিবেক প্রতিবন্ধী'! 'সার্বিক উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে এই বিবেক প্রতিবন্ধীদের নির্মূল করার সঠিক সময় এক্ষুনি! নয়তো মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে!



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com