
হাড়গোড় নিয়ে বাড়ি ফিরলেন স্বজনরা
রূপগঞ্জে অঙ্গার আরও ২১ লাশ হস্তান্তর
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ০৮ আগস্ট ২১ । ০২:৫৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
সমকাল প্রতিবেদক

রূপগঞ্জে কারখানায় আগুনে নিহত আরও ২১ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে শনিবার। এ সময় ঢামেক ও মর্গের সামনে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়-সাজ্জাদ নয়ন
অভাবের সংসারে অসুস্থ বাবা ফজলুর রহমান ১২ বছরের একমাত্র ছেলে মো. হাসনাইনকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় কাজে দিয়েছিলেন। ছেলের রোজগারে টেনেটুনে চলা সংসারে যদি কিছুটা স্বস্তি ফেরে! ওই কারখানায় ভয়াবহ আগুনে সে আশা তার আজীবনের কান্নায় রূপ নিয়েছে। নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ দিয়ে রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডির ঠিক এক মাস পর এই বাবা প্রিয় সন্তানের পোড়া হাড়গোড় ভরা কফিন নিয়ে গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাসনে ফিরেছেন।
গতকাল শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে ফজলুর রহমান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আগুন লাগার আগের দিন ফোনে হাসনাইনের সঙ্গে তার কথা হইল। পোলাডা কইল, ছয় দিন পর বাড়ি আইয়া পড়ুম। আমি কইলাম, লকডাউনের মধ্যে সাবধানে আইয়ু। এক মাস পর ওর কয়ডা হাড়গোড় লইয়া বাড়ি যাইতাছি।' তখন সাইরেন বাজানো অ্যাম্বুলেন্সে ছেলের কফিন ধরে বিলাপ করছিলেন হাসনাইনের মা নাজমা বেগম। বলছিলেন, 'নিজেরা খাইয়া-না খাইয়া পোলাডারে খাওয়াইছি। মোতালেব দালাল বয়স বাড়াইয়া তার আদরের ধনকে কারখানায় নিয়া গেছিল। অহন বাক্স ভরে পোলার কয়ডা হাড় পাইলাম!'
গত ৮ জুলাই হাসেম ফুডস কারখানায় লাগা আগুনে অন্তত ৫১ শ্রমিক নিহত হন। তাদের মধ্যে তিনজনের লাশ তখনই স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৪৮ শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় স্বজনরা তাদের শনাক্ত করতে পারেননি। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ৪৮টি ব্যাগে ভরে মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। পরিচয় শনাক্তের জন্য সিআইডির ফরেনসিক টিম মৃতদেহগুলো থেকে ডিএনএ নমুনা রাখে। এরপর দাবিদার স্বজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে তাদের মধ্যে ৪৫ জনের লাশ শনাক্ত করতে পারে। তিনজনের নমুনা কারও সঙ্গে মেলেনি।
শনাক্ত হওয়া ৪৫ জনের লাশের মধ্যে গত বুধবার পরিবারের কাছে ২৪ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়। গতকাল শনিবার আরও ২১ জনের লাশ হস্তান্তর করা হলো পরিবারের কাছে। ওই ২১ জনের একজন মো. হাসনাইন।
শিশু হাসনাইনের মতোই কারখানাটির আগুনে নিহত অধিকাংশ শ্রমিকই ছিল শিশু-কিশোর। স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরফ্যাসনের মোতালেব নামের এক ব্যক্তি তার এলাকা থেকে কিশোরদের এনে ওই কারখানায় কাজ দেন। এ জন্য তিনি টাকাও নিতেন। কিন্তু নিয়োগের সময়ে তাদের বয়স বেশি দেখানো হতো।
গতকাল মেয়ের লাশ নিতে এসে মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন ১৪ বছর বয়সী শান্তামনির মা সিমু আক্তার। তিনি বলছিলেন, ৮ বছর আগে তার স্বামী জাকির হোসেন মারা যান। এরপর কোলের দুই ছেলে আর মেয়েটাকে নিয়ে অভাবে পড়েন। নিজে একটি কারখানায় কাজ করলেও সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। মেয়েকে কোথায় রাখবেন, সেই চিন্তা থেকে পরিচিতজনের মাধ্যমে শান্তামনিকে কাজে দিয়েছিলেন। বুক খালি করে সেই মেয়েটা চিরতরেই হারিয়ে গেল!
আগুনে অঙ্গার হয়ে নিহত হয়েছিল ১৭ বছরের শেফালী রানী সরকারও। তবে স্বজনরা এতদিন কোথায়ও তার লাশের সন্ধান পাচ্ছিল না। ডিএনএ নমুনা দেওয়ার পরও তাদের অপেক্ষা করতে হয়। গতকাল শেফালীর বাবা মুইরাচরণ সরকার ও মা সীতা রানী সরকার হবিগঞ্জ থেকে এসেছিলেন মেয়ের লাশ নিতে। এই বাবা-মা বিলাপ করে বলছিলেন, বাক্সে করে শেষ স্মৃতিটুকু নিয়ে যাচ্ছি। আগুনে এমন অবস্থা করেছে, ফুটফুটে মেয়েটার আর কিছুই চেনা যাচ্ছে না।
গতকাল হাসনাইন, শান্তামনি ও শেফালী রানী ছাড়াও মাহমুদা আক্তার, মাহবুবুর রহমান, জিহাদ রানা, রহিমা আক্তার, মিনা খাতুন, মো. নোমান, আমেনা আক্তার, রাবেয়া আক্তার, রাহিমা ওরফে রহিমা, আকাশ মিয়া, নাজমুল হোসেন, কম্পা রানী বর্মণ, স্বপন মিয়া, আমৃতা বেগম, মো. শামীম, সেলিনা আক্তার, তাছলিমা আক্তার এবং ফাকিয়া আক্তারের লাশ বুঝে নেন পরিবারের সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের জন্য প্রত্যেকের জন্য ২৫ হাজার টাকা ও বাড়িতে লাশ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির নারায়ণগঞ্জ জেলার বিশেষ পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ৪৮টি মৃতদেহ শনাক্তের জন্য ৬৮ জন স্বজন ডিএনএ নমুনা দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৪৫ জনের সঙ্গে নমুনা মেলায় মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। অপর তিনজনের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com