বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা সমীপে এক অম্লান অভিজ্ঞতা

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২১ । ১১:৫৮

ড. রফিকুল ইসলাম

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ঘটনাটি ঘটেছিল।
বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। তারপর চলেছিল একের
পর এক সংবর্ধনা। শুধু রাজনৈতিক বা ছাত্র সংগঠন নয়, সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও তাদের প্রিয় নেতার সংবর্ধনা আয়োজন করেছিল। এই
আয়োজনকারীদের মধ্যে কতিপয় ভোল পাল্টানো ব্যক্তিও ছিলেন। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে
কৌতূহলোদীপ্ত যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা নিম্নরূপ: ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র
মৃত্যুবার্ষিকীর আগে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে পাকিস্তানের
তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশন থেকে
রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক
আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান এবং আমি সক্রিয় হয়ে উঠি।
আমাদের প্রয়াসে প্রায় তেরোশ বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতির মাধ্যমে পাকিস্তান
সরকারের ওই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

আমাদের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান সরকারের ওই ঘোষণার সমর্থনে প্রথম ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ড. হাসান জামান, ড. মোহর
আলী প্রমুখ পাঁচ শিক্ষক এবং পরে ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনের চল্লিশ কর্মকর্তা ও
শিল্পী এক বিবৃতি দেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর কাগজে দেখলাম, এই চল্লিশজনের
অনেকে মিলে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনার আয়োজন করেছে। এই সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে আমি
বাংলা বিভাগের তদানীন্তন ছাত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
পরদিনই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করি।

আমি যথাসময় ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি এবং ওই সংবর্ধনার
আয়োজনকারীদের নামের তালিকা পত্রিকা থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখাই। আমি তাকে
সংবর্ধনায় না যেতে অনুরোধ জানাই। বঙ্গবন্ধুর তালিকায় স্থান পাওয়া দালাল
শিল্পী-সাহিত্যিকদের নাম দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে
বলেন, 'আমি কাল ওই সংবর্ধনায় যাব, আপনিও যাবেন, মজা দেখবেন।' এরপর তিনি শেখ
হাসিনাকে ডেকে বললেন, 'তোমার স্যারকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।' হাসিনা
আমাকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বসার ঘর থেকে আর একটি ঘরের ভেতর দিয়ে অন্দর মহলে
নিয়ে গেলেন। ওই ঘরে সারি সারি চৌকি পাতা। হাসিনা তার মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে
আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বেগম মুজিব অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে একটি চেয়ারে
বসে ছিলেন। তার সামনে একটি টেবিল। সেখানে নানা রকম খাবার সাজানো। আমি বেগম
মুজিবকে সালাম জানিয়ে তার কথা মতো টেবিলের ওপাশের চেয়ারে মুখোমুখি বসলাম।
এই আমি প্রথম বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে সামনা-সামনি দেখবার ও আলাপ করার
সুযোগ পেলাম। তাকে দেখে চার বছর আগে হারানো আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
আমার মনে হলো তিনি একজন চিরন্তন মূর্তিময়ী 'বাঙালি মা'। আমার দিকে তিনি
সস্নেহে তাকিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন এবং আমার বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। আমি
তাকে বললাম, 'আপনার ঘরে আসার সময় সারি সারি চৌকি দেখলাম, ওখানে কারা
থাকেন?' তিনি বললেন, 'হাসুর বাবার মুক্তির পর থেকে বাংলাদেশের দূর-দূরান্ত
থেকে কর্মীরা ছুটে আসছেন। তাদের মধ্যে যারা রাত হয়ে যাওয়ার পর ফিরে যেতে
পারছেন না, তারা থেকে যাচ্ছেন, ফলে বাড়িটা একটা বাজারে পরিণত হয়ে গেছে।'

তিনি এরপর আমার আপ্যায়নের দিকে মনোযোগ দিলেন। টেবিলের ওপর বিচিত্র সব
খাবার। সবই ঘরে তৈরি পিঠা-পায়েস। তিনি আমাকে নিজ হাতে প্লেটে তুলে দিতে
লাগলেন এবং টিপে টিপে খাওয়ালেন আমার মায়েরই মতো। মজার বিষয় এই যে,
বঙ্গবন্ধুর মতো বঙ্গমাতাও আমাকে 'আপনি' সম্বোধনে কথা বলেছিলেন। কারণ আমি
তাদের মেয়ের শিক্ষক। কিন্তু তাদের আচরণে আমার প্রতি যে স্নেহ ঝরে পড়েছিল তা
আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছিলাম। এমন সস্নেহ আচরণ আমি জীবনে খুব কম
পেয়েছি।

বেগম মুজিব আমাকে বললেন, 'আপনি তো সব দেখে গেলেন, এর মধ্যেই হাসুকে লেখাপড়া
করতে হয়, আপনি যদি ওর পড়াশোনায় একটু সাহায্য করেন তাহলে ভালো হয়।' আমি
বললাম, 'আপনি চিন্তা করবেন না, ওর প্রতি বিভাগের সব শিক্ষকই সহানুভূতিশীল।'
এরপর আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কিন্তু তার স্মৃতি আজও অম্লান।





© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com