শোকের মাস

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও আমাদের ব্যর্থতা

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২১ । ০২:৫৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

শরীফ আজিজ, পিএসসি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গভবন থেকে আমরা তিনজন ছুটে গিয়েছিলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। আমরা ছিলাম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হক, ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ ও লেফটেন্যান্ট রাব্বানী। প্রথম জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক সচিব আর অপর দু'জন বঙ্গবন্ধুর এডিসি। আমাদের লক্ষ্যস্থল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি হলেও সেখানে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। গণভবন থেকে আসা বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলও পারেননি। ১৫ আগস্টের খুব সকালে অভ্যুত্থানকারীরা কর্নেল জামিলকে হত্যা করে। তবে বঙ্গভবন থেকে আসা আমাদের তিনজনকে অভ্যুত্থানকারীরা প্রাণে মেরে না ফেললেও গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে এবং আটকে রাখে। আমাদের সেই তিনজন সামরিক কর্মকর্তার মধ্যে আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আজিজই এখনও বেঁচে আছি।

১৫ আগস্ট যে এরকম একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। স্বপ্টেম্নও কখনোই ভাবিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে এরকম নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে। বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ৩২ নম্বর রোডের বাসায় থাকবেন না, গণভবনে থাকুন। তিনি বললেন, ৩২ নম্বর রোডের বাসাতেই তিনি থাকবেন। এরপর আর কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। মনে আছে, তার মৃত্যুর তিন-চার দিন আগে হত্যাকারীদের একজন কর্নেল ফারুক কোনো এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে ছিলেন। তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল! ডিজিএফআই, এনএসআই কেউই জানল না, এটি কীভাবে সম্ভব হলো। এটা ছিল আমাদের চরম ব্যর্থতার জলজ্যান্ত একটি ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি, এ ব্যর্থতা গোটা জাতির। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় পিজিআরের বাইরে বেসামরিক নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও ছিলেন। আজ এত বছর পর এসে মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। কর্নেল ফারুক ও রশিদ চক্র এ পরিকল্পনা করেছে, তার কিছুই আমরা টের পাইনি কেন? এসব প্রশ্ন আমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়াবে। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুকে হয়তো সতর্ক করে থাকতে পারে। কিন্তু আমার অনুযোগ, দেশের ভেতরে এত গোয়েন্দা সংস্থা, এত বাহিনী, কেউই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র টের পেল না? ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) প্রতিষ্ঠিত হলেও, ওই রেজিমেন্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসা একটি সেনা গোলন্দাজ ইউনিট। মোট কথা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সবাইকেই দায়ী করা যায়। এটি ছিল সংশ্নিষ্টদের অবহেলা, যা হয়তো ইচ্ছাকৃত নয়। তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আমরা যারা পারসোনাল স্টাফ ছিলাম- তাদের 'নিরাপত্তা' বিষয়ে কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না। নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় চিফ সিকিউরিটি অফিসারের ওপর এবং তখনকার গার্ড রেজিমেন্টের ওপর।

ঘটনার দিনই আমরা তিন এডিসির দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সকালবেলা ৬টার দিকে গণভবনের ফখরুল ইসলাম নামের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা গণভবন থেকে আমাকে টেলিফোন করে জানায়, 'ধানমন্ডি ও মিরপুর রোডের দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আপনারা কিছু শোনেননি?' আমি বললাম, না, শুনিনি। এর মধ্যে আরও কারও কারও কাছ থেকে দুঃসংবাদের খবর নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অন্য কোনো চিন্তা বা কোনো কিছুর ভ্রূক্ষেপ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হককে জানালাম। তিনি বললেন, তিনিও যাবেন। গাড়িতে ওঠার আগে তিনি আমার হাতে একটি পিস্তল দিয়ে সঙ্গে রাখতে বললেন, আমি অপর এডিসি যিনি আমার পাশের রুমে থাকতেন, লে. রাব্বানীকেও ঘটনা বললাম। তিনিও যাওয়ার কথা বললেন। আমরা তিনজনই ছিলাম সিভিল পোশাকে। এর পর আমরা বঙ্গভবন থেকে একটি গাড়ি নিলাম, পুরোনো ভক্সওয়াগন। রাজা মিয়া নামের একজন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রধান রাস্তা এড়িয়ে আজিমপুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কিছুক্ষণ পর যে অনুষ্ঠান হবে তার প্রস্তুতি দেখে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যাব। এরপর যখন নিউমার্কেট পার হয়ে ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে এলাম, তখন কালো ইউনিফর্ম পরা কোরের (ট্যাঙ্ক বাহিনী) লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা জানালাম, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। ওরা বলল, তাকে তো হত্যা করা হয়েছে। আমরা বললাম, কী বলছ? তোমরা কি পাগল? আমরা তাদের বাধা পেরিয়ে সামনে এগোলাম। এরপর কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে ফের আরেক দল আমাদের আটকাল। নানা কৌশলে দ্বিতীয় বাধাও পার হলাম।

তখন রাস্তায় কোনো সাধারণ লোকজন ছিল না। কেননা তখন তো কারফিউ চলছিল। বিদ্রোহী সেনাদের তৃতীয় দল আমাদের বাধা দিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে, সাংহাই চীনা রেস্তোরাঁর কাছে ওরা আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে টেনেহিঁচড়ে লেকের পাড়ে নিয়ে আটকে ফেলল। আমাকে পিঠে ও পেটে বিশাল জোরে কতগুলো ঘুষি দিল, কেননা আমার পকেটে ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুলের দেওয়া ছোট পিস্তলটি। এরপর তারা আমাদের সবার চোখ বেঁধে ফেলল। ওদের কথাবার্তায় টের পেলাম, কর্মকর্তা গোছের কেউ কেউ ওখান দিয়ে আসা-যাওয়া করছিল। তাদের প্রশ্নের উত্তরে সেনারা বলল, 'তিন গাদ্দারকে ধরেছি।' একবার কর্নেল ফারুকও ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেনারা তাকে আমাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করল, তারা আমাদের কী করবে? তিনি আমাদের দু'জনকে না চিনলেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হককে চিনলেন। কর্নেল ফারুক বললেন, 'এদেরকে ধরে রাখো।' এভাবে আমাদের চোখ বেঁধে সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা রাখা হলো। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বোনজামাই মরহুম মেজর শহীদুল্লাহ অবস্থা দেখে আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করলেন এবং গণভবনে নিয়ে গেলেন।

এরপর ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান হলো। সেটি একটি অন্যরকম স্মৃতি। তবে আমরা চেয়েছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সফল হোন। খুনিরা পালিয়ে গেল। তার আগে একটি বৈঠকে তো একজন সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে সে সময় ওই বৈঠকে আমরা পুরোনো এডিসিদের মধ্যে কেউ উপস্থিত ছিলাম না। চারদিকে থমথমে অবস্থা। বঙ্গভবনের বাইরে অরাজকতা চলছিল। নভেম্বর মাসের ৬-৭ তারিখে 'সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই' বলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলো। ইতোমধ্যে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো। কিন্তু জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যা সম্পর্কে আমরা পুরো অন্ধকারে ছিলাম। পরে যখন জেনেছি তখন খুনিরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। জেলহত্যার বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিচারপতি আবু সাদাত সায়েম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলে আমাদের বদলির আদেশ বাতিল করা হয় এবং সেনা সদরের আদেশক্রমে পূর্ববর্তী (এডিসি) কার্যক্রমে ফিরে যাই।

এই মহাবিষাদের ঘটনা শেষ করার আগে বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে কিছু বিশেষ কথা বলতে চাই। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের একজন মানুষ। এডিসি হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যের মতো ছিলাম। সকালে বঙ্গভবন থেকে ৩২ নম্বরে আসতাম, রাতে ফিরে যেতাম। প্রতিদিন বাসায় গেলে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব আমাদের খেতে বলতেন। তার মাতৃসুলভ ডাকে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে আসতে পারতাম না। খেতে না চাইলেও বঙ্গবন্ধু খেয়ে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতেন। তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল পিতা ও পুত্রের মতো। তার সঙ্গে যারাই কাজ করেছেন, তিনি তাদের সবার পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী থেকে বঙ্গবন্ধুর আরও দু'জন এডিসি ছিলেন। আমাদের তিনজনকেই তিনি খুব ভালোবাসতেন।

আমার স্মৃতিচারণে যেসব তথ্য দিলাম এর সমর্থন পাওয়া যাবে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বই 'লিগ্যাসি অব ব্লাড' এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কর্নেল মহিউদ্দিনের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লিখেছেন, 'মিরপুর রোড ধরে শেখ মুজিবের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একদল ল্যান্সারের আহ্বানে কর্নেল ফারুকুর রহমান সেখানে নামেন এবং দেখতে পান যে, আমাদের তিনজনকে ধরে অত্যন্ত শক্তভাবে বেঁধে রেখেছে। উত্তেজিতভাবে তারা বলছে, মুজিবের বাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করায় তারা আমাদের পাকড়াও করেছে।' তারা কর্নেল ফারুকের কাছে জানতে চায়, 'আমাদের খতম করে দেবে নাকি?' কর্নেল ফারুক আমাদের মধ্যকার কমবয়সী দু'জনকে চিনতে না পারলেও দেখামাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হককে চিনে ফেলেন। কর্নেল ফারুক তার সেনাদের শান্ত করলেন এবং বললেন, আর কোনো খুনের প্রয়োজন নেই।

২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে উপনীত হয়েছি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীনতার রূপকার, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তিনি দেশকে কীভাবে দেখতে চাইতেন। আমার মনে হয় তিনি আমাদের এই বিভক্তি কোনো মতেই মেনে নিতে পারতেন না। দেশের অনেক উন্নতি হলেও ধনী-গরিবের বৈষম্য তাকে বিচলিত করত। দুর্নীতি রোধে যে আমরা ব্যর্থ তা তাকে লজ্জিত করত। যে কোনো অবস্থাতেই হোক না, গণতন্ত্রকে যেভাবে আমরা উপেক্ষা করছি, তা দেখে তিনি হতবাক হতেন। গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করি। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড

sharif@elitebd.com

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com