
প্রচ্ছদ
সম্পর্কের নতুন বিন্যাস
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ

পরিচিত এক কবি মাসে তিন মাসে দেখা হলে একথা সেকথার পরই জিজ্ঞেস করেন, 'লেখালেখি করেন তো, নাকি ছেড়ে দিছেন, লেখা তো দেখি না কোথাও অনেক দিন?' তার এ-কথার সরাসরি উত্তর দিতাম না কখনোই। কিন্তু দেখলাম যে এই একঘেয়ে ও একগুঁয়ে প্রশ্ন থেকে তিনি বের হতে পারছেন না। তো, একদিন সরাসরি বললাম, 'দেখা না দেখা আপনার ব্যাপার, আমি তো আপনাকে দেখানোর জন্য লেখি না বস। দুনিয়াকে দেখিয়ে বেড়ানোর জন্য লেখে বেড়ানো তো আমার কাজ নয়।' এই উত্তরের পরও কিন্তু তার প্রশ্ন বদলায়নি।
পরিচিত অনেককেই আমিও ফেলে এসেছি। গ্রামের মাঠে, গঞ্জের হাটে, মফস্বল শহর ও সদরের ফুটপাতে, দোকানে ও ঘাটে। বহুদিন পর তাদের সাথে দেখা হলে আমিও ভাবি তারা বোধহয় আগের মতোই আছেন। শুধু যে ভাবি তা নয়, তাদের সেই আগের মানুষটি মনে করে সেই রকম আচরণও করি।
পুরোনো সহপাঠী, সাবেক সহকর্মী, পুরোনো বন্ধু-বান্ধবী- এই রকম অনেকের ছবি ও স্বরূপ আমার ও আমাদের মনে আঁকা থাকে। বহুদিন পর দেখা হলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা হলে আমরা ভাবি সে বোধহয় আগের সেই সে-ই আছে। আচরণও করি সেই মতো। কিন্তু সেই আচরণ দেখে ওই বন্ধুও মনে মনে হাসে আর ওকে দেখেও আমার হুঁশ হয় না যে ও এক বদলে যাওয়া মানুষ। হুঁশ হয় ওর দিক থেকে ইতি বা নেতিবাচক বড়ছোট কোনো একটা ধাক্কা খেলে।
বছর পনেরো আগের এক সহকর্মীর সাথে হঠাৎ দেখা। তাকে অলস ও অকর্মন্য ভাবতাম মনে মনে। তারপরও একই কর্মস্থলে থাকার সময় আমরা বেশ আন্তরিক ছিলাম। বন্ধুর মতো সেই সাবেক সহকর্মী আজ বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা। সাক্ষাতের সময় সেই বন্ধুতুল্য সাবেক সহকর্মী সাবেকি আচরণটাই করছিল; আমিও যথারীতি সেই অতীতেই স্থিত ছিলাম। ঘণ্টাখানের কথাবার্তা, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং তাঁর অধীনস্তদের সাথে তাঁর আচরণ দেখে বুঝলাম সে আর সে নেই। সে-ও বুঝল যে আমি আর সেই আমি নেই। বুঝতে বুঝতেই আমাদের দু'জনের ভেতরে শুরু হলো পুরোনো সম্পর্ক, পুরোনো ব্যক্তিত্ব, পুরোনো আন্তরিকতা আর নতুন ব্যক্তিত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব পরস্পরের থেকে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি হলো, শুরু হলো আরেক দ্বন্দ্ব তার ও আমার।
আমরা সহজ হতে পারছিলাম না, আবার কঠিন হতে পারছিলাম না; আপন হতে পারছিলাম না, পরও হতে পারছিলাম না; আন্তরিক হতে পারছিলাম না, বিচ্ছিন্নও হতে পারছিলাম না।
আমাদের এই নতুন ও পুরোনো ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও সংরাগ দেখে এক পর্যায়ে আমরা হাসতে হাসতে কেঁদেই ফেললাম।
হালফিলের এক দক্ষিণী চলচ্চিত্র দেখছিলাম সেদিন অবসরে হালকা বিনোদনের জন্য। '৯৬' নামের সেই ছবির নির্মাতা সি প্রেমকুমার। প্রেমকুমারের ওই প্রেমের ছবিতে রামচন্দ্র কৈশোরে প্রেমে পড়েছিল কিশোরী জানকীর। জানকীর পরিবার হঠাৎ এলাকা ছেড়ে অন্য প্রদেশে চলে গেছে। তার দেখা পেতে কীই না করেছে রামচন্দ্র। পরিণত যৌবনে সে স্কুলমাস্টার হয়েছে, উদাসীন হয়েছে, মানবদরদি হয়েছে, কিন্তু আর কারও প্রেমে পড়েনি। ২২ বছর পর বন্ধুদের পুনর্মিলনীতে দু'জনের অজান্তেই দেখা হয়ে গেছে দু'জনের। তারপর কী হয় তাদের? তারা অনেক কথা বলে, অনেক বিষয়ে কথা বলে এবং একসাথে জীবন শুরু করে। এ তো সিনেমার বাস্তব। রোমান্টিকতার স্বার্থে। বাস্তবেরও এমন বাস্তব আছে। আবার সিনেমায়ও বিপরীত বাস্তব আছে। চলচ্চিত্রের বাইরে, কথাসাহিত্যের বাইরে বাস্তব জীবনে বিশ্বনন্দিত মার্কিন কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার প্রেমে পড়েছিলেন কৈশোরে। বহু ঘাটের জল খেয়ে শেষে আবার পাণি গ্রহণ করেছিলেন কৈশোরের সেই 'সুইটহার্টের'। এক কন্যার জননী সেই প্রেমিকা এস্টেল ওল্ডহ্যামকে নিয়ে ঘর হয়েছিল তাঁর। যদিও তিনি তাঁর 'সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি' উপন্যাসে বলছেন, 'প্রেমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার কী জানো জো, ভালোবাসা চিরকালের তো নয়ই, এমনকি হৃদয় ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটাও ক্ষণিকের।' এবং তিনি এ-ও জানতেন যে 'লেখালেখিতে তোমাকে অবশ্যই তোমার সব প্রিয়তমাকে হত্যা করতে হবে।'
বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য এক অর্থনীতিবিদ আছেন। ৭০ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছেন তারুণ্যের ভালোলাগা ভালোবাসাকে। পরিণত নয় শুধু, পরিপকস্ফ বয়সের সেই নারীও প্রখ্যাত এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। পরিপকস্ফ মননে সম্পর্কের কী দারুণ নবজাগরণ। এই বাস্তবের বিপরীতে আমরা যদি ফিরে দেখি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর প্রেমকাহিনি 'দেবদাস'-এর দিকে। প্রমথেশ বড়ুয়া, দিলীপ রায়, বিমল রায়, চাষী নজরুল ইসলাম, কিংবা হালের সঞ্জয় লীলা বানশালী- ১৯৩৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকেই নির্মাণ করেছেন 'দেবদাস' উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র। সম্পর্কের মধ্যে যে বিচ্ছেদ সেই বিচ্ছেদের যে শক্তি, যে শক্তি শরতের রচনার, তাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসই পেলেন না এই নির্মাতারা। তারা তো পারলেনই না, এমনকি একুশ শতকের সঞ্জয় লীলা বানশালীও তা পারলেন না। কেন পারলেন না?
আমার বন্ধুর সাথে দেখা না হওয়ায় যে বদল আমাদের সে বিষয়ে আমরা ওয়াকিফহাল ছিলাম না, কিন্তু দেবদাস তো পারুর পরিবর্তনগুলো ছয় মাস পরপর এসে দেখে ও কথা বলে বুঝতে পেরেছিলেন, তারপর তাদের সম্পর্কের পুনর্গঠন বা পুনর্বিন্যাসের যে বাধা ছিল সে কি নিতান্তই সমাজ, আর কিছুই কি নয়? তাদের সম্পর্কের একটা নতুন বিন্যাস তো তৈরিও করেছিলেন তারা, কিন্তু তা দু'জনের কারোরই মনমতো ছিল না, আবার মনমতো যে কেমন হলে হবে তাও তারা হয়তো জানতেন না। এই না জানার যে দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট সেটা দেবদাস ও পারুর জীবনে প্রচ্ছন্ন থেকেও প্রবল, নিবিড় কিন্তু নীরব।
১৯১৭ সালে শরৎবাবু রচনা করেছিলেন যে কাহিনি শতাব্দী পেরিয়েও কেন সেই কাহিনি আমাদের ভালো লাগে? যুগ তো বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষের মন, তারপরও কেন শত বছর আগের সেই কাহিনি আমাদের টানে? সে কি আমরা পুরোনো সম্পর্কের কাছে ফিরে যেতে চাই বলে? সে কি তবে আমাদের মাতৃজঠরে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মতো প্রবল কিছু, শেকড় ও স্বর্গের টান? নাকি রিরংসা? নাকি নিতান্তই অভ্যাস বা বদভ্যাস? নাকি লক্ষণাক্রান্ত সেই রাক্ষসনন্দিনী সূপর্ণখার মতো প্রত্যাখ্যানের জ্বালা ও কুহক। নাকি স্মৃতি ও রোমন্থনের রু রু হাওয়া এসে আমাদের ফুরফুরে গায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়? নাকি সেই প্রশ্নটা- 'যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে'- 'আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই গেছে, কিছুই নেই বাকি?' নাকি তাঁর 'একরাত্রি'র সেই 'অনন্তরাত্রি' যা 'তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা'র ভাব, বিভাব, পরাভব ও পরাক্রম মেনে বেঁচে থাকার বাসনায়, তাড়নায় 'শখের দুঃখ' যাপনের বিলাস নিয়ে, অনন্ত আনন্দের আস্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই 'হঠাৎ দেখা' কবিতা কিংবা 'একরাত্রি' গল্পের ভাব নিয়ে, আহা, কত ধরনের রচনাই না রচিত হয়েছে পৃথিবীর প্যাপিরাসে।
এই লেখা লিখতে লিখতে একটা পুরোনো শার্টের কথা মনে পড়ছে আমার। যে শার্ট নিয়ে আমার একটি কল্পনা সাজানো আছে। ২৫ বছর আগে একটি শার্ট পরতাম। তখন উঠতি বয়স। পাতলা কাপড়ের সেই শার্টের নীলচে সাদা জমিনে ছিল লাল ফুল আঁকা। পরতে পরতে পুরোনো হয়ে গেলে সেই শার্ট ফেলে দিই একদিন। বহুদিন পর পুরোনো জামা ঘাঁটতে গেলে আবার বেরিয়ে আসে সেই শার্ট। পরতে গিয়ে দেখি গায়ে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে যায়। খুলে রাখি, ফেলে রাখি সেই শার্ট। রাতে ঘুম আসে না। সকালে সেই শার্ট বড় করতে দরজির কাছে নিয়ে যাই। এই শার্ট নিয়ে, এই শার্টের স্বস্তি ও অস্বস্তি নিয়ে ২৫ বছর আছি আমি। আছে সেই শার্টও।
আমার নিজের শার্টের কথা তো বললাম। ওই লোকটার জামার কথাও তো বলতে হবে যে জামা বানানোর পর বেঁচে যাওয়া কাপড় থেকে রুমাল ও টুপি বানিয়েছিল। ওই জামা ছিঁড়ে গেলে তা থেকে আবার টুপি, গামছা, রুমাল ও বাচ্চাদের প্যান্ট ও নিজের আন্ডারওয়্যার বানিয়েছিল। সেগুলো ছিঁড়ে গেলে তা দিয়ে আসবাব মোছার ত্যানা বানিয়েছিল। তাও যখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেল তখন সেই কাপড়ের টুকরা দিয়ে ঢেলা ও কুলুখের কাজ চালিয়েছিল, বাকি অংশ ব্যবহার করেছিল রান্নার আগুনের ইন্ধন হিসেবে। হ্যাঁ, কোনো কোনো সম্পর্কে আশ মিটে যায়, তবুও আশ মেটে না, ফেলতে ইচ্ছে করে না, রেখে দিই আমরা যত্নে বা অযত্নে। আর কিছু সম্পর্কে ছিঁড়ে ছিবড়ে বানিয়ে শেষ করে দিয়েও আশ মেটে না আমাদের। এমনই অনিঃশেষ প্রেম ও প্রতিহিংসা আমাদের, এমনই সম্পর্ক আমাদের, এমনই সম্পর্কের টান।
সম্পর্ক নিয়ে, সম্পর্কের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস নিয়ে এলেবেলে কথা তো অনেক হলো বলা। এবার আবার না হয় তাকিয়ে দেখি একবার সম্পর্ক আসলে কী? 'সখী ভালোবাসা কারে কয়' না বলে বরং জিজ্ঞেস করে দেখি তাকে, সম্পর্ক আসলে কারে কয়? সম্পর্ক বিষয়ে অভিধান মোটের ওপর যে-কথাগুলো বলছে তা হলো- যেভাবে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি, বস্তু বা গোষ্ঠী যুক্ত হয় তাকে কিংবা যুক্ত থাকার অবস্থার সেই অবস্থা ও ব্যবস্থাকে সম্পর্ক বলে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা বস্তু যেভাবে পরস্পরকে বিবেচনা করে কিংবা পরস্পরের প্রতি যে আচরণ করে সেটিই সম্পর্ক। সম্পর্ক বিষয়টি স্থিতিশীল নয় কখনোই, সদা পরিবর্তমান, সচল, ভঙ্গুর ও বিচ্ছেদপরায়ণ।
সম্পর্কের খুব গভীর-নিবিড় জায়গাগুলো হলো প্রেম, কাম, দাম্পত্য, বন্ধুত্ব, রক্তের বন্ধন, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন। এই বলয়ের বাইরেও পেশাগত, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, দৈশিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক আছে আরও হাজার রকমের। এখানে সব সম্পর্কের বর্ণনা তো দূর, শুধু নাম উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। এই যে এত এত সম্পর্ক, সব সম্পর্কই নিয়ন্ত্রিত ও চর্চিত হয়-আবেগ ও স্বার্থ-মোটের ওপর এই দু'দিক থেকে। শুধু দাম্পত্য সম্পর্কে যে ধরনগুলো আছে সেগুলোর বর্ণনা দিলেও এ লেখার দফারফা হয়ে যাবে। সভ্যতা যত সামনের দিকে যাচ্ছে সম্পর্ক তত জটিল হচ্ছে এবং তত বহুবিচিত্র হচ্ছে। এতসব জটিল ও বিচিত্র সম্পর্কের সঙ্গে আমাদের নিজেদেরও সম্পর্কিত, সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত করে নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত নানাভাবে। এই সংযুক্তি-বিযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বদলে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ, মানসিকতা, চিন্তা-চেতনার পরিধি, সংস্কৃতি ও সমাজ। আবার কখনও সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্বব্যবস্থার চাপে বদলে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্কও।
বিশ শতকের মার্কিন লেখিকা উইলা ক্যাথার সেই কবে বলেছিলেন, 'হৃদয় এক অন্ধকার অরণ্য, তার কারও নিজের কাছে যত চেনাজানাই হোক না কেন।' উইলা ক্যাথারের মতো অনেকেই হারিয়ে গেছেন তার শতকের মধ্যেই। তাঁকে বা তাঁদের স্মরণের মিহি এক সম্পর্কে বেঁধে রেখে বিশ্ব একুশ শতকে এসে গড়ছে আরও আরও নতুন বন্ধন। আরণ্যক হৃদয়ের ভার এসে পড়ে সম্পর্কের ওপর কিংবা সম্পর্কের ভারে হৃদয় হয়ে ওঠে আরও আরও গভীর এক অরণ্যানী।
মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সম্পর্কের নতুন বিন্যাসের ক্ষেত্রে কখনও মিথ্যাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্ক ও আচরণের ক্ষেত্রে যেটাকে আমরা সৌজন্যবোধ বা শিষ্টাচার বলি সে তো আসলে মিথ্যাই। শৈল্পিক এক মিথ্যা। প্রয়োজনের ও সংযোগের সেই মিথ্যা খুবই যুক্তি ও ন্যায়সংগত। ইংরেজ লেখক গ্রাহাম গ্রিন বোধহয় এদিকটা লক্ষ্য করেই বলেছিলেন, 'মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহৃদয়তা এবং মিথ্যা হাজারও সত্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।'
ফরাসি দার্শনিক ও লেখক সিমোন দ্য বোভোয়ার ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমে পড়েছেন অন্য পুরুষের, কিন্তু সারা জীবন থেকে গেছেন দার্শনিক জ্য পল সার্ত্রের সাথেই। জীবনের বাঁকবদল আর সম্পর্কের উত্থান-পতন ও অস্থিতির কথা চিন্তা করেই উন্মুক্ত সম্পর্কের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন তারা। বোভোয়ার কিন্তু বলেও ছিলেন, 'স্বামী পাওয়া একটা শিল্প, আর তাকে ধরে রাখা একটা চাকরি।' ধরে রাখার এই কাজটার সাথে অনেক কিছু মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকে। ব্যাপার থাকে সম্পর্কের পাশাপাশি নিজের মনন-চেতন ও অভ্যাস-স্মৃতিকে গড়েপিটে নেওয়ার; গড়েপিটে নতুন বাস্তবতার সাথে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার।
এই সময়ের মার্কিন ক্লিনিশিয়ান স্টান টাটকিন আমাকে একটা গল্প শিখিয়েছিলেন। সেই গল্পটা এখানে বলি। আমার দুই বন্ধু ছিল কৈশোরের। একজনের নাম অভ্যাস আর একজনের নাম কৌতূহল। সাইকেল চালানো শিখতে গেলাম। অভ্যাস ও কৌতূহল আমাকে সাহায্য করল। কৌতূহল ভীষণ উৎসাহী। সবকিছু টুকে রাখত সে। আর সব কলাকৌশলগুলো সে আমাকে শিখিয়ে দিত। অভ্যাসের ছিল প্রখর স্মৃতি, সবকিছুকে একটা নিয়মে বেঁধে 'কাস্টমাইজ' করে নিত সে। সবকিছু অটোমেশনের মতো করে ফেলত, কোনটা কীভাবে করতে হবে তার একটা মডিউল তৈরি করে নিত সে। সাইকেল চালাতে গিয়ে কখন প্যাডেলে পা রাখতে হবে, কখন ব্রেকে হাত রাখতে তা আর খেয়ালেই রাখতে হতো না। এমনই অভ্যাসের গুণ। কিন্তু মুশকিল হলো একদিন যখন আমার সাইকেলের সামনে একটা কুকুর এসে পড়ল। কুকুরের ওপর দিয়ে সাইকেলটা চলে গেল আর আমি গিয়ে পড়লাম রাস্তার পাশের গভীর খাদে।
সেই থেকে বুঝেছি যে সম্পর্ক হচ্ছে সাইকেল বা গাড়ি চালানোর মতো। মুখস্থ বা অভ্যাসের বশে চালিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু কৌতূহলের সহযোগিতা থেকে সরে যাওয়া যাবে না। সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। এই কারণে সতর্ক থাকতে হয় যে, সম্পর্ক বদলে যায়, প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। এই বদলের বিষয়গুলো অভ্যাস বা স্মৃতি দিয়ে ব্যবস্থাপনা হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় কৌতূহল, উদ্দীপনা ও সতর্ক নজরদারি। নজরদারি শুধু পরের দিকে নয়, নিজের দিকেও।
তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের সম্মানে ১৯৪৫ সালে জাতির উদ্দেশে একটা বার্তা লিখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। সেই বার্তাই ছিল তার শেষ বার্তা। এর কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি মারা যান। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বলেছিলেন, 'সভ্যতাকে টিকে থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই মানবসম্পর্কের বিজ্ঞানের চর্চা করতে হবে।' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে 'একই বিশ্বে একত্রে শান্তিতে থাকার জন্য, একসাথে কাজ করার জন্য, সব মানুষের, সব ধরনের মানুষের, এই সামর্থ্য' খুব জরুরি বলে মনে করেছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায় আবার এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। আফগানিস্তানে কট্টরপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তালেবানদেরও নতুনভাবে ভাবতে হবে পুরোনো সম্পর্ক আর সম্পর্ক বিষয়ে তাদের বদ্ধমূল সংস্কারগুলো নিয়েও। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, সম্প্রদায় থেকে সমাজ, দেশ থেকে দেশ- সবক্ষেত্রেই সম্পর্কের এই এক রীতি। বিশ্ব জটিলতর হচ্ছে, আরও জটিল হচ্ছে মানুষের বহুবিধ সম্পর্কও, গড়ে উঠছে এমন সব অভিনব সম্পর্ক যেগুলোর বিবরণ আমাদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায়ও নেই। এসব সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, এই সব সম্পর্কের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরও আরও উজাড় ও উদার করার, নিজেকে আরও বেশি সহিষ্ণু, সহনশীল ও সম্প্রসারিত করার কোনো বিকল্প নেই।
পরিচিত অনেককেই আমিও ফেলে এসেছি। গ্রামের মাঠে, গঞ্জের হাটে, মফস্বল শহর ও সদরের ফুটপাতে, দোকানে ও ঘাটে। বহুদিন পর তাদের সাথে দেখা হলে আমিও ভাবি তারা বোধহয় আগের মতোই আছেন। শুধু যে ভাবি তা নয়, তাদের সেই আগের মানুষটি মনে করে সেই রকম আচরণও করি।
পুরোনো সহপাঠী, সাবেক সহকর্মী, পুরোনো বন্ধু-বান্ধবী- এই রকম অনেকের ছবি ও স্বরূপ আমার ও আমাদের মনে আঁকা থাকে। বহুদিন পর দেখা হলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা হলে আমরা ভাবি সে বোধহয় আগের সেই সে-ই আছে। আচরণও করি সেই মতো। কিন্তু সেই আচরণ দেখে ওই বন্ধুও মনে মনে হাসে আর ওকে দেখেও আমার হুঁশ হয় না যে ও এক বদলে যাওয়া মানুষ। হুঁশ হয় ওর দিক থেকে ইতি বা নেতিবাচক বড়ছোট কোনো একটা ধাক্কা খেলে।
বছর পনেরো আগের এক সহকর্মীর সাথে হঠাৎ দেখা। তাকে অলস ও অকর্মন্য ভাবতাম মনে মনে। তারপরও একই কর্মস্থলে থাকার সময় আমরা বেশ আন্তরিক ছিলাম। বন্ধুর মতো সেই সাবেক সহকর্মী আজ বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা। সাক্ষাতের সময় সেই বন্ধুতুল্য সাবেক সহকর্মী সাবেকি আচরণটাই করছিল; আমিও যথারীতি সেই অতীতেই স্থিত ছিলাম। ঘণ্টাখানের কথাবার্তা, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং তাঁর অধীনস্তদের সাথে তাঁর আচরণ দেখে বুঝলাম সে আর সে নেই। সে-ও বুঝল যে আমি আর সেই আমি নেই। বুঝতে বুঝতেই আমাদের দু'জনের ভেতরে শুরু হলো পুরোনো সম্পর্ক, পুরোনো ব্যক্তিত্ব, পুরোনো আন্তরিকতা আর নতুন ব্যক্তিত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব পরস্পরের থেকে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি হলো, শুরু হলো আরেক দ্বন্দ্ব তার ও আমার।
আমরা সহজ হতে পারছিলাম না, আবার কঠিন হতে পারছিলাম না; আপন হতে পারছিলাম না, পরও হতে পারছিলাম না; আন্তরিক হতে পারছিলাম না, বিচ্ছিন্নও হতে পারছিলাম না।
আমাদের এই নতুন ও পুরোনো ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও সংরাগ দেখে এক পর্যায়ে আমরা হাসতে হাসতে কেঁদেই ফেললাম।
হালফিলের এক দক্ষিণী চলচ্চিত্র দেখছিলাম সেদিন অবসরে হালকা বিনোদনের জন্য। '৯৬' নামের সেই ছবির নির্মাতা সি প্রেমকুমার। প্রেমকুমারের ওই প্রেমের ছবিতে রামচন্দ্র কৈশোরে প্রেমে পড়েছিল কিশোরী জানকীর। জানকীর পরিবার হঠাৎ এলাকা ছেড়ে অন্য প্রদেশে চলে গেছে। তার দেখা পেতে কীই না করেছে রামচন্দ্র। পরিণত যৌবনে সে স্কুলমাস্টার হয়েছে, উদাসীন হয়েছে, মানবদরদি হয়েছে, কিন্তু আর কারও প্রেমে পড়েনি। ২২ বছর পর বন্ধুদের পুনর্মিলনীতে দু'জনের অজান্তেই দেখা হয়ে গেছে দু'জনের। তারপর কী হয় তাদের? তারা অনেক কথা বলে, অনেক বিষয়ে কথা বলে এবং একসাথে জীবন শুরু করে। এ তো সিনেমার বাস্তব। রোমান্টিকতার স্বার্থে। বাস্তবেরও এমন বাস্তব আছে। আবার সিনেমায়ও বিপরীত বাস্তব আছে। চলচ্চিত্রের বাইরে, কথাসাহিত্যের বাইরে বাস্তব জীবনে বিশ্বনন্দিত মার্কিন কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার প্রেমে পড়েছিলেন কৈশোরে। বহু ঘাটের জল খেয়ে শেষে আবার পাণি গ্রহণ করেছিলেন কৈশোরের সেই 'সুইটহার্টের'। এক কন্যার জননী সেই প্রেমিকা এস্টেল ওল্ডহ্যামকে নিয়ে ঘর হয়েছিল তাঁর। যদিও তিনি তাঁর 'সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি' উপন্যাসে বলছেন, 'প্রেমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার কী জানো জো, ভালোবাসা চিরকালের তো নয়ই, এমনকি হৃদয় ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটাও ক্ষণিকের।' এবং তিনি এ-ও জানতেন যে 'লেখালেখিতে তোমাকে অবশ্যই তোমার সব প্রিয়তমাকে হত্যা করতে হবে।'
বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য এক অর্থনীতিবিদ আছেন। ৭০ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছেন তারুণ্যের ভালোলাগা ভালোবাসাকে। পরিণত নয় শুধু, পরিপকস্ফ বয়সের সেই নারীও প্রখ্যাত এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। পরিপকস্ফ মননে সম্পর্কের কী দারুণ নবজাগরণ। এই বাস্তবের বিপরীতে আমরা যদি ফিরে দেখি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর প্রেমকাহিনি 'দেবদাস'-এর দিকে। প্রমথেশ বড়ুয়া, দিলীপ রায়, বিমল রায়, চাষী নজরুল ইসলাম, কিংবা হালের সঞ্জয় লীলা বানশালী- ১৯৩৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকেই নির্মাণ করেছেন 'দেবদাস' উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র। সম্পর্কের মধ্যে যে বিচ্ছেদ সেই বিচ্ছেদের যে শক্তি, যে শক্তি শরতের রচনার, তাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসই পেলেন না এই নির্মাতারা। তারা তো পারলেনই না, এমনকি একুশ শতকের সঞ্জয় লীলা বানশালীও তা পারলেন না। কেন পারলেন না?
আমার বন্ধুর সাথে দেখা না হওয়ায় যে বদল আমাদের সে বিষয়ে আমরা ওয়াকিফহাল ছিলাম না, কিন্তু দেবদাস তো পারুর পরিবর্তনগুলো ছয় মাস পরপর এসে দেখে ও কথা বলে বুঝতে পেরেছিলেন, তারপর তাদের সম্পর্কের পুনর্গঠন বা পুনর্বিন্যাসের যে বাধা ছিল সে কি নিতান্তই সমাজ, আর কিছুই কি নয়? তাদের সম্পর্কের একটা নতুন বিন্যাস তো তৈরিও করেছিলেন তারা, কিন্তু তা দু'জনের কারোরই মনমতো ছিল না, আবার মনমতো যে কেমন হলে হবে তাও তারা হয়তো জানতেন না। এই না জানার যে দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট সেটা দেবদাস ও পারুর জীবনে প্রচ্ছন্ন থেকেও প্রবল, নিবিড় কিন্তু নীরব।
১৯১৭ সালে শরৎবাবু রচনা করেছিলেন যে কাহিনি শতাব্দী পেরিয়েও কেন সেই কাহিনি আমাদের ভালো লাগে? যুগ তো বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষের মন, তারপরও কেন শত বছর আগের সেই কাহিনি আমাদের টানে? সে কি আমরা পুরোনো সম্পর্কের কাছে ফিরে যেতে চাই বলে? সে কি তবে আমাদের মাতৃজঠরে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মতো প্রবল কিছু, শেকড় ও স্বর্গের টান? নাকি রিরংসা? নাকি নিতান্তই অভ্যাস বা বদভ্যাস? নাকি লক্ষণাক্রান্ত সেই রাক্ষসনন্দিনী সূপর্ণখার মতো প্রত্যাখ্যানের জ্বালা ও কুহক। নাকি স্মৃতি ও রোমন্থনের রু রু হাওয়া এসে আমাদের ফুরফুরে গায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়? নাকি সেই প্রশ্নটা- 'যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে'- 'আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই গেছে, কিছুই নেই বাকি?' নাকি তাঁর 'একরাত্রি'র সেই 'অনন্তরাত্রি' যা 'তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা'র ভাব, বিভাব, পরাভব ও পরাক্রম মেনে বেঁচে থাকার বাসনায়, তাড়নায় 'শখের দুঃখ' যাপনের বিলাস নিয়ে, অনন্ত আনন্দের আস্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই 'হঠাৎ দেখা' কবিতা কিংবা 'একরাত্রি' গল্পের ভাব নিয়ে, আহা, কত ধরনের রচনাই না রচিত হয়েছে পৃথিবীর প্যাপিরাসে।
এই লেখা লিখতে লিখতে একটা পুরোনো শার্টের কথা মনে পড়ছে আমার। যে শার্ট নিয়ে আমার একটি কল্পনা সাজানো আছে। ২৫ বছর আগে একটি শার্ট পরতাম। তখন উঠতি বয়স। পাতলা কাপড়ের সেই শার্টের নীলচে সাদা জমিনে ছিল লাল ফুল আঁকা। পরতে পরতে পুরোনো হয়ে গেলে সেই শার্ট ফেলে দিই একদিন। বহুদিন পর পুরোনো জামা ঘাঁটতে গেলে আবার বেরিয়ে আসে সেই শার্ট। পরতে গিয়ে দেখি গায়ে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে যায়। খুলে রাখি, ফেলে রাখি সেই শার্ট। রাতে ঘুম আসে না। সকালে সেই শার্ট বড় করতে দরজির কাছে নিয়ে যাই। এই শার্ট নিয়ে, এই শার্টের স্বস্তি ও অস্বস্তি নিয়ে ২৫ বছর আছি আমি। আছে সেই শার্টও।
আমার নিজের শার্টের কথা তো বললাম। ওই লোকটার জামার কথাও তো বলতে হবে যে জামা বানানোর পর বেঁচে যাওয়া কাপড় থেকে রুমাল ও টুপি বানিয়েছিল। ওই জামা ছিঁড়ে গেলে তা থেকে আবার টুপি, গামছা, রুমাল ও বাচ্চাদের প্যান্ট ও নিজের আন্ডারওয়্যার বানিয়েছিল। সেগুলো ছিঁড়ে গেলে তা দিয়ে আসবাব মোছার ত্যানা বানিয়েছিল। তাও যখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেল তখন সেই কাপড়ের টুকরা দিয়ে ঢেলা ও কুলুখের কাজ চালিয়েছিল, বাকি অংশ ব্যবহার করেছিল রান্নার আগুনের ইন্ধন হিসেবে। হ্যাঁ, কোনো কোনো সম্পর্কে আশ মিটে যায়, তবুও আশ মেটে না, ফেলতে ইচ্ছে করে না, রেখে দিই আমরা যত্নে বা অযত্নে। আর কিছু সম্পর্কে ছিঁড়ে ছিবড়ে বানিয়ে শেষ করে দিয়েও আশ মেটে না আমাদের। এমনই অনিঃশেষ প্রেম ও প্রতিহিংসা আমাদের, এমনই সম্পর্ক আমাদের, এমনই সম্পর্কের টান।
সম্পর্ক নিয়ে, সম্পর্কের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস নিয়ে এলেবেলে কথা তো অনেক হলো বলা। এবার আবার না হয় তাকিয়ে দেখি একবার সম্পর্ক আসলে কী? 'সখী ভালোবাসা কারে কয়' না বলে বরং জিজ্ঞেস করে দেখি তাকে, সম্পর্ক আসলে কারে কয়? সম্পর্ক বিষয়ে অভিধান মোটের ওপর যে-কথাগুলো বলছে তা হলো- যেভাবে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি, বস্তু বা গোষ্ঠী যুক্ত হয় তাকে কিংবা যুক্ত থাকার অবস্থার সেই অবস্থা ও ব্যবস্থাকে সম্পর্ক বলে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা বস্তু যেভাবে পরস্পরকে বিবেচনা করে কিংবা পরস্পরের প্রতি যে আচরণ করে সেটিই সম্পর্ক। সম্পর্ক বিষয়টি স্থিতিশীল নয় কখনোই, সদা পরিবর্তমান, সচল, ভঙ্গুর ও বিচ্ছেদপরায়ণ।
সম্পর্কের খুব গভীর-নিবিড় জায়গাগুলো হলো প্রেম, কাম, দাম্পত্য, বন্ধুত্ব, রক্তের বন্ধন, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন। এই বলয়ের বাইরেও পেশাগত, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, দৈশিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক আছে আরও হাজার রকমের। এখানে সব সম্পর্কের বর্ণনা তো দূর, শুধু নাম উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। এই যে এত এত সম্পর্ক, সব সম্পর্কই নিয়ন্ত্রিত ও চর্চিত হয়-আবেগ ও স্বার্থ-মোটের ওপর এই দু'দিক থেকে। শুধু দাম্পত্য সম্পর্কে যে ধরনগুলো আছে সেগুলোর বর্ণনা দিলেও এ লেখার দফারফা হয়ে যাবে। সভ্যতা যত সামনের দিকে যাচ্ছে সম্পর্ক তত জটিল হচ্ছে এবং তত বহুবিচিত্র হচ্ছে। এতসব জটিল ও বিচিত্র সম্পর্কের সঙ্গে আমাদের নিজেদেরও সম্পর্কিত, সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত করে নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত নানাভাবে। এই সংযুক্তি-বিযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বদলে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ, মানসিকতা, চিন্তা-চেতনার পরিধি, সংস্কৃতি ও সমাজ। আবার কখনও সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্বব্যবস্থার চাপে বদলে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্কও।
বিশ শতকের মার্কিন লেখিকা উইলা ক্যাথার সেই কবে বলেছিলেন, 'হৃদয় এক অন্ধকার অরণ্য, তার কারও নিজের কাছে যত চেনাজানাই হোক না কেন।' উইলা ক্যাথারের মতো অনেকেই হারিয়ে গেছেন তার শতকের মধ্যেই। তাঁকে বা তাঁদের স্মরণের মিহি এক সম্পর্কে বেঁধে রেখে বিশ্ব একুশ শতকে এসে গড়ছে আরও আরও নতুন বন্ধন। আরণ্যক হৃদয়ের ভার এসে পড়ে সম্পর্কের ওপর কিংবা সম্পর্কের ভারে হৃদয় হয়ে ওঠে আরও আরও গভীর এক অরণ্যানী।
মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সম্পর্কের নতুন বিন্যাসের ক্ষেত্রে কখনও মিথ্যাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্ক ও আচরণের ক্ষেত্রে যেটাকে আমরা সৌজন্যবোধ বা শিষ্টাচার বলি সে তো আসলে মিথ্যাই। শৈল্পিক এক মিথ্যা। প্রয়োজনের ও সংযোগের সেই মিথ্যা খুবই যুক্তি ও ন্যায়সংগত। ইংরেজ লেখক গ্রাহাম গ্রিন বোধহয় এদিকটা লক্ষ্য করেই বলেছিলেন, 'মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহৃদয়তা এবং মিথ্যা হাজারও সত্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।'
ফরাসি দার্শনিক ও লেখক সিমোন দ্য বোভোয়ার ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমে পড়েছেন অন্য পুরুষের, কিন্তু সারা জীবন থেকে গেছেন দার্শনিক জ্য পল সার্ত্রের সাথেই। জীবনের বাঁকবদল আর সম্পর্কের উত্থান-পতন ও অস্থিতির কথা চিন্তা করেই উন্মুক্ত সম্পর্কের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন তারা। বোভোয়ার কিন্তু বলেও ছিলেন, 'স্বামী পাওয়া একটা শিল্প, আর তাকে ধরে রাখা একটা চাকরি।' ধরে রাখার এই কাজটার সাথে অনেক কিছু মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকে। ব্যাপার থাকে সম্পর্কের পাশাপাশি নিজের মনন-চেতন ও অভ্যাস-স্মৃতিকে গড়েপিটে নেওয়ার; গড়েপিটে নতুন বাস্তবতার সাথে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার।
এই সময়ের মার্কিন ক্লিনিশিয়ান স্টান টাটকিন আমাকে একটা গল্প শিখিয়েছিলেন। সেই গল্পটা এখানে বলি। আমার দুই বন্ধু ছিল কৈশোরের। একজনের নাম অভ্যাস আর একজনের নাম কৌতূহল। সাইকেল চালানো শিখতে গেলাম। অভ্যাস ও কৌতূহল আমাকে সাহায্য করল। কৌতূহল ভীষণ উৎসাহী। সবকিছু টুকে রাখত সে। আর সব কলাকৌশলগুলো সে আমাকে শিখিয়ে দিত। অভ্যাসের ছিল প্রখর স্মৃতি, সবকিছুকে একটা নিয়মে বেঁধে 'কাস্টমাইজ' করে নিত সে। সবকিছু অটোমেশনের মতো করে ফেলত, কোনটা কীভাবে করতে হবে তার একটা মডিউল তৈরি করে নিত সে। সাইকেল চালাতে গিয়ে কখন প্যাডেলে পা রাখতে হবে, কখন ব্রেকে হাত রাখতে তা আর খেয়ালেই রাখতে হতো না। এমনই অভ্যাসের গুণ। কিন্তু মুশকিল হলো একদিন যখন আমার সাইকেলের সামনে একটা কুকুর এসে পড়ল। কুকুরের ওপর দিয়ে সাইকেলটা চলে গেল আর আমি গিয়ে পড়লাম রাস্তার পাশের গভীর খাদে।
সেই থেকে বুঝেছি যে সম্পর্ক হচ্ছে সাইকেল বা গাড়ি চালানোর মতো। মুখস্থ বা অভ্যাসের বশে চালিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু কৌতূহলের সহযোগিতা থেকে সরে যাওয়া যাবে না। সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। এই কারণে সতর্ক থাকতে হয় যে, সম্পর্ক বদলে যায়, প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। এই বদলের বিষয়গুলো অভ্যাস বা স্মৃতি দিয়ে ব্যবস্থাপনা হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় কৌতূহল, উদ্দীপনা ও সতর্ক নজরদারি। নজরদারি শুধু পরের দিকে নয়, নিজের দিকেও।
তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের সম্মানে ১৯৪৫ সালে জাতির উদ্দেশে একটা বার্তা লিখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। সেই বার্তাই ছিল তার শেষ বার্তা। এর কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি মারা যান। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বলেছিলেন, 'সভ্যতাকে টিকে থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই মানবসম্পর্কের বিজ্ঞানের চর্চা করতে হবে।' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে 'একই বিশ্বে একত্রে শান্তিতে থাকার জন্য, একসাথে কাজ করার জন্য, সব মানুষের, সব ধরনের মানুষের, এই সামর্থ্য' খুব জরুরি বলে মনে করেছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায় আবার এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। আফগানিস্তানে কট্টরপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তালেবানদেরও নতুনভাবে ভাবতে হবে পুরোনো সম্পর্ক আর সম্পর্ক বিষয়ে তাদের বদ্ধমূল সংস্কারগুলো নিয়েও। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, সম্প্রদায় থেকে সমাজ, দেশ থেকে দেশ- সবক্ষেত্রেই সম্পর্কের এই এক রীতি। বিশ্ব জটিলতর হচ্ছে, আরও জটিল হচ্ছে মানুষের বহুবিধ সম্পর্কও, গড়ে উঠছে এমন সব অভিনব সম্পর্ক যেগুলোর বিবরণ আমাদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায়ও নেই। এসব সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, এই সব সম্পর্কের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরও আরও উজাড় ও উদার করার, নিজেকে আরও বেশি সহিষ্ণু, সহনশীল ও সম্প্রসারিত করার কোনো বিকল্প নেই।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com