প্রচ্ছদ

থাকে শুধু লোহিত ধারণাসমূহ

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আনোয়ার শাহাদাত

শূন্য :(ক)

সে বছর ঢাকায় এপ্রিল মাসের দিনক্ষণ ধরে এমন গরম পড়েছিল যে উত্তপ্ত পুকুর, নদী ও ঝিলের মাছেরা দাহ যন্ত্রণায় জলউপরিতলে ভেসে উঠেছিল। ভেসে ওঠা সে সবের কতিপয় হেঁটে ডাঙ্গায় উঠে এসে দূরে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল শীতল ছায়া পাবে বলে। এবং তার আবার অর্ধেক সংখ্যা অঝোর বৃষ্টির ও রক্তিম ঢলের পরেও এই স্থলভূমিতেই থেকে গিয়েছিল বলে বর্ণিত আছে। সেই একই বাংলা সন হিসাব ধরে 'সোনারগাঁয়ের' প্রাচীন উঁচু বৃক্ষগুলোর মগডাল ভরে গিয়েছিল মৌসুমি কোকিলদের কোলাহলে, তারা অবিরাম ভুল শিমুল-বসন্ত ফাঁদে পড়ে বেসুরেলা ডেকেও গিয়েছিল মধ্যরাতে ভ্রষ্ট প্রভাত হয়েছে ভেবে। হায় ভ্রান্ত পাখিসব। ঈসা খাঁ'র বারান্দা হতে অচীন খোরাসানি নারীর আচল ছোঁয়া পৌরাণিক পবন এসে কুহেলিকা সিক্ত করে দিয়েছিল কত মানুষের অদৃষ্ট ও কুটুম্বিতা! তখন ব্রহ্মপুত্র থেকে পানাম নগরমুখী মরা নদী শাখা ছেয়ে থাকা কচুরীপানার ঝাঁকেদের পাতায় ডিম পেড়েছিল অগনিত ডাহুকের পঙ্গপাল। ঠিক সমসময়ে পোড়া ইষ্টকের নগর হয়ে উঠেছিল বিষাক্ত তীর-ধনুকের গুদাম ও অস্ত্রাগার। সৌহার্দ্য ঘাতকতার অন্যায্য বিষমাখা বক্ষভেদী তীর ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল কোনো নির্মল হূৎ বরাবর তাক করে। ঢাকার চিত্রকরেরা এসব কাহিনি এঁকে রেখেছিল ধানমন্ডির 'সম্পর্ক' গুহার তমসাচ্ছন্ন স্যাঁতসেঁতে পরিখার দেয়ালে!

ধানমন্ডির সেই তমসাচ্ছন্ন স্যাঁতসেঁতে পরিখার দেয়ালেই আমাদের কখনও দেখা হয়েছিল। আমি সেই অলৌকিক সাঁঝকালে বাংলামটর থেকে হেঁটে কলাবাগানের শীর্ণ পথ ধরে ভূতের গলি পার হয়ে হেঁটে সবুজ সড়ক অতিক্রান্ত করে পরে গুহামুখে পড়লে মনে হতে থাকে এ এক অনন্তকাল হেঁটে আসা অন্ধকারের সামনে এসে দাঁড়ালাম ওই গুহায় খোদিত 'সম্পর্ক'-এর চিত্র-প্রাগচিত্র দেখতে। তখন তার পরিধানে রক্ত রঙের অম্বর আচ্ছাদন, মসলিন বা হতে পারে সুতোয় বোনা; সে আচ্ছাদন যেন নিজেও চিত্র সাঁটিয়ে থাকা চিত্র-কাপড় (ক্যানভাস)। সেই শাড়িতে অজস্র লটকে থাকা বিচিত্র সব রক্তরঙের ছোপ ও ছাপ; সেসব দেখে মনে হয় ছাপগুলো যেন রক্তে ভরা ডিমের খোল ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল দেয়ালে সাঁটানো এই পরিধানের ক্যানভাসে। কী এক অর্থদ্বিধার জবরদস্তি, লাল রঙের শাড়িতে, বহুবিধ লালচে তেলরং গড়িয়ে নেমেছিল। যেন পটুয়ার অসতর্কতায় অথবা নিরীক্ষায় চারশ পঁয়তাল্লিশ রকমের লাল লেপ্টে আছে। কিছু লাল ঠোঁট গড়িয়ে দাঁতেও লেপটানো, এক রক্তারক্তি রক্তিম সমাহার; স্কারলেট, ক্রিমসন, ম্যাজেন্টা, মেরুন, কারেট, বারগেন্ডি, কারডেনিয়াল, গারনেট, ভারমিলিওন, জনও ট্রাকোটা রঙের তুলির লেপন। যেন পাথরের ম্যানিকিন, যেন পরাবাস্তবিক নির্মম সন্ধ্যা এক।

যখন সে বছর তখন সেখানে তেমন সন্ধ্যা নেমেছিল যখন তুষারাবৃতের নীল রঙের মেরুর সন্ধ্যা সে মধ্যরাতের সূর্য্যসন্ধ্যা আসবে বলে একদিন। [অন্য অংশ- শূন্য.(খ)]

এক.

মা ও বাবা এক সময়ে উপলব্ধি করতে বাধ্য হন যে তাদের প্রিয় কন্যা তার প্রেমিক ও স্বামীর চাইতে আর কাউকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে না। ছেলের ক্ষেত্রেও তাই, প্রেমিকা ও বউ হয়ে ওঠে তার একমাত্র প্রিয় অবলম্বন। এভাবে কুটুম্বিতার নতুন অন্তরঙ্গতা মা-বাবার পরিবার ছেড়ে ভিন্ন নহরে বইতে থাকে।

দুই.

জন আপডাইকের একটা উপন্যাস পড়ছি 'মেমোরিজ অব দ্য ফোর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন', যার শুরুটা এ রকম- 'আমার মনে আছে, নিক্সনের পদত্যাগ দেখছিলাম টেলিভিশনে আমাদের পরিত্যক্ত বাচ্চাদের সঙ্গে বসে। আমার বউ ডেট করতে বাইরে গেছে, আমাকে বলেছিল বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে (ডেটের বাংলা জানা নেই আমার)। গত জুন থেকে আমরা পৃথককৃত হয়েছি। এটা ছিল অবশ্যই আগস্টে। নিক্সনের স্ম্ফীত মুখমণ্ডল এবং তার ভয়ংকর রকমের ভারসাম্যহীনতা দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। বাচ্চারা বা আমি এর আগে কোনোদিন প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দেখিনি; কেউই ইউনাইটেড স্টেটসের ইতিহাসে তা দেখেনি'। এখনও বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি, তবে পৃথক হয়েছে, সেও মাত্র দুই মাসে আগে; এরই মধ্যে স্ত্রী নতুন ডেটে গেছে, স্বামীই ভার পেয়েছে বাচ্ছা দেখাশোনা করবার।

তিন.

তিন বছর আগে আমাদের এক সামাজিক পারিবারিক বন্ধুর ব্রুকলিনের বাড়িতে এমন গ্রীষ্ফ্মের দিনে বেড়াতে গেছি। আমাদের নিমন্ত্রণ কর্তা ভদ্রমহিলা মিস আগাথা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যার বয়স ষাটের দশকের শুরুর কোনো সংখ্যায় হবে ধারণা করা যায়। খুব সীমিত অতিথি সমাবেশের আয়োজন। নিমন্ত্রণ কর্তা আগাথা সেখানে যে ভদ্রলোককে আমার সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারও বয়স সে রকম। ভদ্রলোক চোখের বিশেষ অসুস্থতায় কিছু বছর আগে দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধ হয়েছেন। আমার সঙ্গে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণ সদ্য অন্ধ হয়ে যাওয়া ভদ্রলোক বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ ও কৌতূহলী। তিনি শুনে থেকেছেন যে আমারও যেহেতু বিশ্ব রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির প্রতি আগ্রহ রয়েছে। আগাথা ককেশিয়ান [শ্বেতাঙ্গ] কিন্তু এই ভদ্রলোক, যার নাম মুস্তাফা, তিনি একজন আরব [সৌদি আরব]। ঠিক কৈশোরত্তীর্ণ যৌবনে আমেরিকায় পড়তে এসে কলেজে আগাথার সঙ্গে তার পরিচয় এবং পরিণতিতে তারা বিয়ে করেন। তাদের একটি ছেলে ও মেয়ে যারা অনেক আগেই বয়সপ্রাপ্ত হওয়ার পরে আলাদা বসবাস করে থাকে। ব্রুকলিনের এ বাসায় এখন তারা দু'জনই থাকেন। অন্ধ মুস্তাফা ঘরেই থাকেন আর ওই বিশ্ব রাজনীতির খোঁজ-খবরটাই প্রধানত রেখে বিনোদিত হয়ে থাকেন। অন্ধও হয়েছেন কয়েক বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, কাজ ছেড়ে দিয়েছেন অন্ধ হওয়ার পর। ওই দিনের দীর্ঘ সন্ধ্যা মুস্তাফার সঙ্গে আমার আলোচনা থাকে প্রধানত বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের রাজনীতি নিয়ে। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির দেখি মৌলিকটা জানেন। তার অবশ্য কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, যে তার পাকিস্তানের রাজনীতির প্রতি কৈশোর-যৌবনে আগ্রহ ছিল, সেই সুবাদেই বাংলাদেশেও তার আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়। তারও মনে হতে পারে যে, আমারও সৌদি আরব তথা মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে কম-বেশি পরিস্কার ধারণা আছে। মুস্তাফা ও আগাথার বিয়ে ভেঙে ছিল সেও প্রায় তখন থেকে ১৫ বছর আগে। গত ক'বছরে মুস্তাফার চোখের অবনতি হলে আগাথা বলেছেন, মুস্তাফা চাইলে তিনি এসে আগাথার সঙ্গে থাকতে পারেন। সেইভাবে মুস্তাফা এখন আগাথার বাসায় থাকেন, অতিথির মতন, মুস্তাফা- আগাথার সাবেক স্বামী। [কিছুদিন আগে আগাথা খবর দিয়েছেন যে মুস্তাফা এখন বিশেষ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সবকিছু দেখতে পান]।

চার.

প্যাট্রিক আর রেচেলও আমাদের দীর্ঘ দিনের পারিবারিক বন্ধু, সে প্রায় দুই দশক ধরে। রেচেলকে আমরা চিনি ওর সঙ্গে প্যাট্রিকের পরিচয় ও বিয়ের অনেক আগে। আমাদের সঙ্গে কোনোদিনই ওদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। রেচেলের মাধ্যমে আমরা জানি ওদের বিয়ে ঠিক প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছে না; সেও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে ওদের বিয়ে ভেঙে যায়। কিন্তু জানি প্যাট্রিকের সঙ্গে রেচেলের সামাজিক বন্ধুত্ব অটুট আছে। কখনোই মনে হয়নি রেচেল প্যাট্রিককে ঘৃণা করে কেবল এক ঘরে থাকা যায় না মতনই। ফলে ওরা আলাদা হয়ে যায়। শুনেছি প্যাট্রিক আবার বিয়ে করে, একটি মেয়ের বাবা হয় তার নতুন স্ত্রীর সঙ্গে। রেচেলের বিশেষ অসুবিধার কারণে সে কখনও জৈবিক মা হতে পারবে না, অথচ ওর মা হওয়ার ইচ্ছা, ফলে এর মধ্যে ও একটা পুত্রসন্তানের মা হয় দত্তক নিয়ে, তাও নিজের বর্ণের [সে নিজে শ্বেতাঙ্গ] নয় এক সন্তানকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। সেই নিয়ে আমরা পারিবারিকভাবে শুরু থেকে ওই ছেলের জন্মের আগেই জড়িত। তার নাম হবে জেফ্রি, জন্মের কতদিন পরে হসপিটাল থেকে জেফ্রিকে রেচেলের বাসায় আনা হবে, এসব সংবাদসহ সবই আমরা জানি। জেফ্রি এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, বড় হয়েছে। আমাদের সঙ্গে জেফ্রিরও বিশেষ বন্ধুত্ব; যেহেতু সে জন্মের পর থেকেই আমাদের সঙ্গে পরিচিত। আমাদের সব পারিবারিক অনুষ্ঠানে সে আজকাল মধ্যমণি। কিছুদিন আগে রেচেলের বাবা-মা তাদের একমাত্র সন্তানের জন্য বেশ দামি [দেড় মিলিয়ন ডলারে] একটি বাড়ি কিনে দিয়েছে, যাতে ছেলে জেফ্রিকে নিয়ে রেচেলের তেমন অসুবিধা পোহাতে না হয়। মস্ত সেই বাড়ির এক অংশে তারা অর্থাৎ রেচেলের মা-বাবা থাকবে, যাতে জেফ্রিকে সামান্য হলেও সাহায্য করতে পারে। যদিও রেচেলের মা-বাবা ওই অর্থে বয়স্ক, মধ্য ৮০ তে তাদের বয়স। আমরা কিছুদিন আগে নতুন বাড়িতে যাওয়ার আগেই জানি যে সেখানে প্যাট্রিক থাকবে এবং সেই আমাদের জন্য খাবার জোগাড় দেবে, আমাদের খালি গেলাশে ওয়াইন ঢেলে দেওয়াসহ। প্যাট্রিকের ইতালিয়ান খাদ্য রান্না করা শখ, ফলে আমাদের আতিথেয়তায় সব সময়ই প্যাট্রিক তৎপর। এর মধ্যে আমরা এও জানি যে প্যাট্রিকের যে নতুন বিয়ে সেটাও ঠিক মতন কাজ করছে না। রেচেলের বাবা-মায়ের সঙ্গে আবার প্যাট্রিকের ভালো সম্পর্ক, বিভিন্ন সময়ে তাদের দরকারে তারা প্যাট্রিককে অনুরোধ করে, প্যাট্রিক সেটা মহাউৎসাহে করে থাকে। রেচেলের সঙ্গেও তার গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ বন্ধু, সেও আমরা জানি। মাঝে রেচেল যখন ডেটে যায়- নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া হতে এমন কারও সঙ্গে দেখা করতে যেত তখন সে প্যাট্রিককেই অনুরোধ করত সে যেন রেচেলের ছেলেকে ওই সময়ে দেখাশোনা করে রাখে। ওই অর্থে এখন ওরা দু'জন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং যেখানে রেচেলের মা-বাবার সঙ্গেও প্যাট্রিকের রয়েছে বাড়তি বোঝাপড়া। কিছুদিন আগে আমরাও যখন রেচেলের নতুন বাড়িতে বেড়াতে গেলাম তখন রেচেল এক পর্যায়ে আমাদের তার নতুন বাড়ির ঘরগুলো দেখাচ্ছিল, 'এটা জেফ্রির ঘর, এটা আমার [রেচেল] ঘর, এটা প্যাট্রিকের ঘর'। আমরা আগেও জানতাম প্যাট্রিক এখন এ বাড়িতেই থাকে কিন্তু তার জন্য যে আলাদা কোনো ঘরও বরাদ্দ আছে সেটা আমাদের জানা ছিল না।

পাঁচ.

ম্যাক-আপেল ও আইফোনখ্যাত স্টিভ জবস কোনও দিনই মুহূর্তের জন্যও বাড়তি কোনো সহানুভূতি দেখাননি তার জৈবিক পিতার প্রতি। সন্তান হিসেবে সকল শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির প্রকাশ করেছেন তার পালক মাতা-পিতার প্রতি। এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না।

ছয়.

২০১৮তে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পোলিশ লেখক ওলগা তোকারচুকের একটা গল্প আছে 'জীবনের জন্য সংরক্ষিত', যেখানে ৪০ বছর বয়স্ক অকর্মণ্য পুত্র দিনরাত টেলিভিশন দেখায় আসক্ত, ঘরেই পড়ে থাকে, বৃদ্ধ মায়ের সে সব পছন্দ নয়। তিনি অভিযোগ করেন, ছেলের 'প্রেমিকা' নেই, বন্ধু-বান্ধব নেই, সমাজ নেই, জীবন নেই, সারা রাত টেলিভিশন দেখে, এ কোনো জীবন নয়। উচ্চ বিদ্যালয় কৃতকার্য হওয়া ছেলে কোনোদিন এসব কানে তোলেনি, নিজের মতো থেকেছে মায়ের ঘরে। সেই মা একদিন মরে গেলে যথানিয়মে ছেলেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে উপস্থিতদের মধ্যে কেবল ছেলের মতে মায়ের বুড়ো বন্ধুরা, যারা শেষকৃত্য অনুষ্ঠান বলে পুরোনো কোট, হাতে বানানো বিশেষ টুপি [বেরেট] পরে অনুষ্ঠানে আসে, সে সব কাপড়ে ন্যাপথালিনের 'উৎকট' গন্ধ পাওয়া যায়। মায়ের মৃত্যুর পর ছেলে এই প্রথম প্রতিরোধহীন এ বাড়িতে বসবাস শুরু করে এবং এরপর আবিস্কার করে যে, বাড়িটির সকল গোপন জায়গায় তার মা অজস্র বহুবিধ আচার বানিয়ে রেখেছেন। তিনি সেই সব আচারের নাম দিয়েছেন নিজের মতো করে। কখনও সেই সব আচারের নাম ও তা যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি তা বেশ উদ্ভট; যেমন একটাই- আচারের ওপরে লেখা 'টকের [সির্কা] ভেতর জুতার ফিতা!' বা 'টমেটো আচারে স্পঞ্জ' এমন আরও অনেক। এমনকি মা ফলের চাটনিও বানিয়ে রেখেছে, যা ছেলে 'মিষ্টান্ন' হিসেবে খাওয়া শুরু করে। ছেলে মনে করে তার জন্যে তার মা এসব বানিয়ে রেখেছে এবং নিয়ম করে ছেলে সেই সব আচার দিয়ে রাত হলে বিয়ার পান, আচার খাওয়া ও টেলিভিশন দেখা চালিয়ে যেতে থাকে। সেদিন পোল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের খেলা, সে আচার খেতে থাকে। ওই দিন মাশরুমের আচার খায় অনেক, কতটা খায় তার হিসাব ছিল না। ওদিকে একাধিক গোল হওয়ার উত্তেজনা, ওই আচার বৈয়ামের ওপরে লেখা ছিল মাশরুমের আচার। এরপর তাকে 'পায়খানায়' যেতে হয়। অবিরাম বমি হতে থাকে। তার মনে হয় মা আগের মতোই তাকে বকা দিচ্ছে, যদিও তার পরক্ষণে মনে পড়ে যে তার মা আর জীবিত নেই। হসপিটালে দেখা গেল মাশরুম আচারের বিষে তার যকৃৎ নষ্ট হয়ে গেছে। মরার পর দেখা গেল তার লাশের কোনো দাবিদার নেই। অবশেষে মায়ের সেই বন্ধুরাই ওই লাশ নিয়ে তাদের উৎকট গন্ধের কোট ও টুপি পরে করুণা মিশ্রিত শেষকৃত্য সম্পন্ন করল!

সাত.

জুলফিকার আলি ভুট্টোর নাতনি, বিখ্যাত লেখক মুর্তাজা ভুট্টোর কন্যা ফাতিমা ভুট্টো কোনোদিনই তার জৈবিক মা ফৌজিয়াকে [আফগানি] 'মা' হিসেবে গ্রহণ করেনি। সে মা হিসেবে তার সৎ মা লেবানিজ নারী জিনোয়া ভুট্টোকে মা হিসেবে গ্রহণ করেছে। জীবনে কেবল যখন সদ্য উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে ফাতিমা, তখন তার জৈবিক মা [বায়োলজিক্যাল] ফৌজিয়া ওই বিদ্যালয়ে এসেছিলেন মেয়েকে দেখতে, কিন্তু মেয়ে ফাতিমা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়নি একা। যদি তার সৎ মা সঙ্গে থাকেন তবেই যে সে কেবল তার জৈবিক মায়ের সঙ্গে দেখা করতে রাজি আছে। এরপর তার সৎ মা এসে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর দেখা হয়েছিল [স্মৃতি থেকে লিখছি তার বই 'সংস অব ব্লাড অ্যান্ড শোর্ড', সামান্য তারতম্য হতে পারে]।

আট.

মাস দুই-এক আগে ঢাকা থেকে আমার এক বাল্যবন্ধু [মুনিম] জানিয়েছে- 'জালাল নেই'। গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই জালাল যে নেই হয়েই থেকেছিল বলে আমি গ্রহণ করেছিলাম। এরপরও এই বেশি বছর আগে নয়, চল্লিশ বছরের তুলনায় সে ২০০৬ ও ২০০৮-এ আমাদের দেখা হয়। ২০০৬ ঢাকাতে আমার অপর বাল্যবন্ধু কাঞ্চনকে বলি- 'কাঞ্চন জালাল এভাবে চলে গেল'? কাঞ্চনই হতবাক হয়ে বলে- 'কী বলো, আমি তো জানি না, কে বলেছে?' আমাকে এ খবর কে দিয়েছিল তা আমার মনে ছিল না। পরদিন কাঞ্চন আমাকে ফোন করে ওর ঢাকা হাইকোর্ট চেম্বারে আসতে বলে এবং জানায় যে 'জালালের চলে যাওয়ার সংবাদটি সঠিক নয়, জালাল ঢাকাতেই আছে এখন, তুমি আমার এখানে আস, আমরা এখান থেকে ওর ওখানে যাব'। এ খবরের পর আমি যখন শাহবাগ ধরে একটা রিকশায় করে হাইকোর্টের দিকে যাচ্ছিলাম তখন মনে হয়েছিল ঢাকায় এর আগে কখনও এমন ফেব্রুয়ারি আর আসেনি, এমন বসন্ত আর নামেনি এই শহরে, যখন চারদিকে ফুল আর কোকিলদের ডাকে ঢাকা এত কোলাহলময় উঠতে পারে। সেই বিকেলে জালালের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমাদের জালাল, এমন মেধাবী, এমন শান্ত, এমন মৃদু হাসি, এমন বুদ্ধিমত্তা ঠিক (ঠাক) সবই, তারপরও আমরা বন্ধুরা সবাই জানি কোথায় যেন জালালের ঠিক নেই সব ঠিকের মাঝেও। জালাল অর্থনীতিতে পড়াশোনা রেখে দক্ষিণে খেপুপাড়া'র দিকে চলে গিয়েছিল। আমাদের সবার ভেতরে যখন উৎসবিপরীতমুখী যাওয়ার ব্যারাম ধরেছিল, জালাল সে ব্যাধি থেকে মুক্ত ছিল, ফলে অত সহজে কুয়াকাটার দিকে চলে যাওয়ার মতন হিম্মত ওর হয়েছিল। যদিও আমরা কেউই আজ এত যুগ পরেও বলতে পারব না, কোনটা ভালো বা কোনটা মন্দ। '৭৮, '৭৯, '৮১, '৮২তে আমি আর জালাল সাইকেলের রড বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম। ওর সে সময়ে একটা সাইকেল ছিল। দ্বিচক্রজান টই (টই) অভিযানে যে তা চালনার চাইতে রডে বসে থাকা আরও কঠিনতর যোগ্যতা, সেটাই আমরা তখন অনুধাবন করতে পারি, কেননা সেটাই আমরা দু'জনে মিলে দিনভর করে থাকতাম। এতে আমাদের দু'জনের যে সুবিধা ছিল তা হলো, আমি নিজে প্রায় অছাত্র মর্যাদার গোল্লায়গত বিবেচিত নিরীহ প্রাণী, যাকে প্রায় কেউ কখনও 'পড়াশোনা' করতে দেখেছে তেমন ঘটেনি, আর জালাল হলো এমন মেধাবী যে ওই জিনিস না করলেও ওর যা প্রত্যাশিত ফলাফল [পরীক্ষা] তা নিশ্চিত থাকে। ফলে যারা দেখে থেকেছে তারা দেখবে জালাল হয় সাইকেলে আমার সঙ্গে, আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, না হয় জালালের কানে একটা মাল্টি-ব্যান্ড শর্টওয়েভ রেডিও লেগে আছে, যথাসম্ভব উঁচিয়ে তার অ্যান্টেনা ওপরে তোলা যায় ততটাই অ্যান্টেনা উপড়ে ওঠায়। এই দুনিয়ায় জালালের আর কোনো কিছু থাকতে হতো না। পৃথিবীতে যেখানে যত ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, তার প্রতি ওভারের প্রতিটি বলের খবরাদি ঘাঁটাঘাঁটি করা, ছক্কা খুঁজে বেড়ানো, বোলড অথবা কট আউট এ সবই জালাল। আর তেমন কিছু নয় হচ্ছে আমাদের জালাল। এরপর যদিও আবার ২০০৮-এ আমাদের দেখা হয়েছিল। হতে পারে আমি গ্রাম থেকে ভাবলাম খেপুপাড়া যাব, জালালের সঙ্গে দেখা করে আসি। আমাদের দেখা হলো, আমি আগের মতোই, যেমন সাইকেলের রডে চড়ে আমরা দু'জনই ঘুরছি বরিশাল শহরময়। আর কিছু নয়। যদিও সেবার আমার মনে ভিন্ন একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল; তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আর কোনোদিন জালালের সঙ্গে 'বেঁচে থাকে জীবনে' দেখা হবে না। জালালের সঙ্গে সেবার সময় কাটানোর একটা পর্যায়ে আমার মনে হলো খুব সূক্ষ্ণভাবে সমাজ কোথায় যেন আমরা যারা উৎসবিমুখে ধাবিত হয়েছিলাম তাদের কথিত 'সফল' বিবেচনা করে থাকে। এই অনুভূতিটা আঁচ করতে পেরে আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছে কারও উপস্থিতিতে কারও অবস্থান খাটো হলে সে উপস্থিতির দায় আমি আর কোনোদিন নেব না। ফলে মুনিমের দেওয়া জালালের মরণের সংবাদে আমার আর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি; হওয়ার কথাও ছিল না। যার মরণ আমার কাছে এর আগেও হয়েছে। আমি তো সেটাই ধরে নিয়েছি সেই মানুষটির জন্য, জীবনে যে আমাকে সবচেয়ে নির্মল স্মৃতিটা উপহার দিয়েছিল। আমার পরিবারে অনেক উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত [আমি নিজেও তার পক্ষে]। ফলে এসএসসি পরীক্ষার বাংলা-ইংরেজির দ্বিতীয়পত্রের মাঝে যে বিরতি হয় সে সময়ে পরীক্ষার্থীদের আত্মীয়-স্বজন বাসা থেকে দাওয়াত খাওয়াবার মতন করে যে বিপুল খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়; জালাল জানত সেটা আমার ক্ষেত্রে ঘটবে না, কেননা আমার ওই অর্থে কেউ নেই যে আমার জন্য মফস্বল শহরের প্রথা অনুযায়ী খাবার নিয়ে আসবে। তো, প্রথম দিনের ওই বিরতিতে সকল পরীক্ষার্থী যেমন বাইরে আসে, আমিও তেমন করে বাইরে আসি; যেন বিচ্ছিন্ন হাঁটি, তখন দেখি জালাল আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, ওর হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার, ডাব আর বেকারি থেকে কেনা জিনিসপত্র। সেই আমার পৃথিবী ভেঙে পড়েছিল; এই তো জালাল, এই-ই আমার বন্ধু, যার সঙ্গে ইচ্ছে করে আর কোনোদিন দেখা হয়নি, তার আমরণ কালাবধি।

নয়.

আলবেয়ার ক্যামু'র আগন্তুক [দ্য স্ট্রেঞ্জার] উপন্যাসের ম্যারসো'র মনোজগতে জাগতিক দ্বন্দ্বের ফলে মৃত মায়ের শবাধার খুলে তার মুখ দেখবার প্রেরণাও ছিল তার মধ্যে অনুপস্থিত, সে নিয়ে কোনো অনুশোচনা হয়নি তার কখনও এবং এরপর তার জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো কিছুই সমাজ প্রত্যাশিত তৎপরতার মধ্যে পড়েনি। এমনকি নিজের মরণ হবে মানুষের ইচ্ছায় এবং তার আগে ধর্মযাজক যখন পরামর্শ দেন তিনি তার ঈশ্বরহীনতার বিশ্বাস থেকে সরে আসেন, ম্যারসো সেই আর্জি প্রত্যাখ্যান করেন। বরং যাজককে এ কথাই ঘোষণা করেন যে, এই যে তার 'জীবন এক অর্থহীন প্রক্রিয়া' মনে করবার তার এই ধারণাকেই তিনি [বিশ্বাস] সঠিক মনে করছেন এবং জাগতিক সব মোহময়তায় অনাগ্রহই হচ্ছে তার [ম্যারসো] কাছে অর্থপূর্ণ [অ্যাবসার্ডিটি!]। মানব অস্তিত্ব অর্থহীন।



দশ.

এই চেতনা ও বোধ [সম্পর্কের] কখনও একের সঙ্গে এক, একের সঙ্গে একাধিক, কখনও একাধিকের সঙ্গে একাধিক এবং তা স্বতন্ত্র [তথ্য-উপাত্ত, সংগঠনের নিয়ম হতে, ড্যাটা মডেলিং]।

এ শুধু 'সম্পর্ক'ই নয়, এ আপেক্ষিকতাও। ফলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বও কার্যত 'সম্পর্কে'র সম্পর্কিতা আপেক্ষিক নিয়মে [থিওরি অব রিলেটিভিটি]; সে হয় গতির সঙ্গে গতির আপেক্ষিকতা, সাধারণ আপেক্ষিকতা, বিশেষ আপেক্ষিকতা, মধ্যাকর্ষণ আপেক্ষিকতা, সময় সম্প্রসারণ আপেক্ষিকতা এবং দৈর্ঘ্য সংক্ষেপণ সম্পর্ক আপেক্ষিকতা, আলোর গতি, শক্তি সমতা [আরও অনেক]। হয়তো এ সব সম্পর্কও কম জরুরি নয় মানবজীবনে।

শূন্য.(খ)

সে বছর তখন ঢাকার সেখানে তেমন সাঁঝ নেমেছিল যখন, যেন এক আর্ক্টিক বৃত্তের সান্ধ্য ঊষার মুমূর্ষু আলোর বিচ্ছুরণে। সেই এক সামুদ্রিক সন্ধ্যার মেরু প্রভা ও পর্যায়ক্রমে এক রহস্য-রাত নেমেছিল ঢাকায় সেদিন; 'অ্যাবসার্ডিটি' রেস্তোরাঁয় পুড়ে যাওয়া শলতে জ্বলে যাওয়া থেকে সামান্য আলো, এবং তার সেই রক্তিম ছাপছোপের পরিধান, যার সবটাই ছিল অর্থহীনতার অর্থের অর্থহীনতা। দক্ষিণীয় প্রভা [অরোরা বোরালিস], উত্তরীয় প্রভা [অরোরা আস্ট্রালিস], অরোরা আলোর নীল রাত এসবের সবই ছিল সম্পর্কের মতন কেবল তা এক মহাশূন্যতালয়ে।

তখন এও শোনা গিয়েছিল যে, ওই রহস্য রাতে যখন রক্তিম পোশাকে তিনি বসেছিলেন অস্থির, তখন ঢাকা অবধি রক্তের জোয়ার বয়েছিল ভাটির দিকে। ভাটির জোয়ারের সেই রক্তের স্রোত উত্তর থেকে ঢাকার দিকে শীতলক্ষ্যা ধরে দক্ষিণে যেতে যেখানে বালু নদী শীতলক্ষ্যার মোহনায় মিলিত হয় তার আগেই ডেমরার মরা খাল ধরে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে বাসাবো, মুগদা, কমলাপুর, রমনা, নীলক্ষেত, পিলখানা, আজিমপুর হয়ে কামরাঙ্গিরচর ধরে বুড়িগঙ্গায় গড়িয়েছিল। ঠিক তার আগে পিলখানায় রক্তস্রোত কিছুটা সময়ের জন্য অভিশপ্ত হলে পরে চারদিকের নর্দমাগুলোতে ছড়িয়ে পড়লেও ঠিকই মরা খালের পথ পেয়ে আবার তা কামরাঙ্গীরচর হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছিল। তার আগের দিনের পরের দিন কাঁঠাল বাগানে ১৭৭/ক বাড়ির চিলেকোঠার [পেন্ট হাউসের] বাগানের ছাদে ডলবি অ্যাট্মোস শব্দযন্ত্রে সেবাস্তিয়ান বাখের সিলো সুইটের-১ এর জি মেজর রোম্যান্টিক বাদ্য বাজিয়ে সাঁঝ হতে মাঝরাত অবধি এক জোড়া 'কবুতর' নব্য বয়সপ্রাপ্ত হওয়ার আরোপিত অনুভূতিতে মহড়া দিতে থাকে কেমন করে তারা অনুগতদের বোঝাবেন যে 'সম্পর্ক', এবং তাতে 'রক্ত' ধারণা যে কত জরুরি। সেই জোড়ার এঁড়ে গোত্রীয়র ভাগে থাকে এই তর্ক যে 'শুক্রাণুই হচ্ছে কার্যত সম্পর্কের রক্ত' এবং সেই ধারায় 'রক্ত' ব্যাখ্যায় স্থিত থাকা। আর স্ত্রীলিঙ্গ গোত্রীয় সদস্যের ভাগে পড়ে এই 'তর্ক' যে কার্যত 'বীর্য বা শুক্রাণু' হচ্ছে একটা 'বিদেশি' মৌল মাত্র, যদিও সে অচেনা মৌল হলেও তা জরায়ুবান্ধব ছাড়া আর কিছু নয় এবং প্রকৃত অর্থে সম্পর্কের আসল অথবা আসলে সম্পর্ক হচ্ছে- একমাত্র 'জরায়ু', এবং তথা উৎপাদিত সন্তান বিচ্ছিন্নতায় ক্ষরিত রক্তই এবং ওই প্রচলিত বোধ 'নর'কেই [প্লাসেন্টা] এইভাবে পরিশেষে 'রক্ত' বলা যেতে পারে এবং এমন করে দ্বৈতযুগলজোড়া এই ভিন্নমতের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া বিক্ষণাগারে নিরীক্ষা করে থাকেন।

অধিকতর বিবৃত থাকে যে, নিরীহ সেই পাথর আকার মূর্তমান, সেই রক্ত ছোপ ক্যানভাস মোড়ানো মানবী প্রাণযুক্ত হয়েছিল- পরিধানের সেই মসলিন শাড়ি, জামা বা চুল, নাক, ঠোঁট কিংবা দাঁতে লেপে দেওয়া লোহিত লিপস্টিক সমেত; যে বিষয়ে ধারণা বিনিযুক্ত করা আছে; এই মর্মে যে তা কোনো এক আবাল অসতর্ক কাঁচা পটুয়ার হাতে দেওয়া রক্ত রঙের লেপন, উৎসারিত হয়েছিল প্রবঞ্চক মরদ তত্ত্বে, এবং এই বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল- এইসব রক্তবর্ণ 'লাল' রং-ই বয়ে বেড়ানোই হচ্ছে 'সম্পর্ক' নামান্তর।

তখন কথিত থাকে [আমার/আমি] প্রাণহীন মৎসের শূন্যতা লয়ে তাকিয়ে থাকি; নিজ বুকে পিঠে রক্তমাখা জামার আস্তিনের বিভাজিত প্রান্তের লৌহ বোতামে [কাফ্লিং] হাত রেখে নিজে এখনও বেঁচে আছি না মরে গেছি বুঝতে পারার চেষ্টায় নিবেদিত থেকে অনুচ্চারিত এক অস্ম্ফুৎ প্রশ্ন সে আমার থাকে 'তাই'? পৃথিবী ও বেঁচে থাকা যে কত অর্থহীন; এই বুঝিবা অথবা এরই নাম সম্পর্ক। তিনি সেটাই বুঝতে চান যে আমিও সেটাই বুঝি কিনা। যদিও আমি কেবল আমার মৃত-মৎস্য চোখের চাউনি দিয়ে তাকিয়েই থেকেছি কাফকাস্কিউ বা ইন্ডিফারেন্স ও অ্যাবসার্ডিটিসমূহের অর্থের অর্থহীনতা লয়ে। এবং অতঃপর হিমায়িত হয়ে থাকি আজীবনের জন্য সেই সব বিদীর্ণ রক্তিম মোড়ানো লালের ভেতর। মনে হয়েছে আহ! যদি এমন হতো আমি সেই সব ডাঙ্গায় হেঁটে যাওয়া মাছেদের মতন যারা জল ছেড়ে একদা কোনো এক নীল রাতের গরমে উত্তপ্ত জল ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে দূরে কোথাও ছায়া শীতল জলাভূমি খুঁজতে চলে গিয়েছিল। দূরে কোথাও শান্তি ছায়া অন্বেষণে জাগতিক সকল সম্পর্ক পেছনে ফেলে। হায়! সে সব হয় না।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com