স্বর্ণ গলানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে

নাটোরে আবাসিক এলাকায় স্বর্ণপট্টি

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২১ । ০৩:০৫ | প্রিন্ট সংস্করণ

নবীউর রহমান পিপলু, নাটোর

নাটোরের স্বর্ণপট্টি এলাকায় প্রকাশ্যে অ্যাসিডে স্বর্ণ গলানোর কারণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পরিবেশ - সমকাল

কয়েকদিন আগেও খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বুকভরে মুক্ত বাতাস নেওয়া যেত। নাটোর শহরের প্রাণকেন্দ্র লালবাজারে বাহাদুর শাহ পার্ক নামের একমাত্র ওই ফাঁকা জায়গায় এখন শোভা পাচ্ছে বহুতল ভবন। সেখানেই গড়ে উঠছে স্বর্ণের দোকান। ফলে বাড়ির ছাদে উঠে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। স্বর্ণ গলানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। এই ধোঁয়ায় এখন পুরো এলাকার বাতাসই দূষিত। কথাগুলো বলছিলেন লালবাজার এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী ভাস্কর বাগচী।

আরেক বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা স্বর্ণপট্টির মধ্য দিয়ে চলতে বড় কষ্ট হয়। সার্বিকভাবে এলাকার জনস্বাস্থ্য ব্যাপক হুমকিতে পড়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টির আংশিক এবং পাশের পিলখানা মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত তিন শতাধিক স্বর্ণের দোকান গড়ে উঠেছে। নাটোর স্বর্ণকারপট্টি নামে সুখ্যাতি রয়েছে এই স্বর্ণের বাজারের। অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেলেও সব পেশা ও শ্রেণির কয়েক হাজার মানুষ এখানে বাস করে। সম্প্রতি এসব এলাকায় নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। এসব ভবনে মানুষের বসবাসের পাশাপাশি স্বর্ণের গহনার শোরুমসহ কারখানাও গড়ে তোলা হয়েছে। এসব কারখানায় গহনা তৈরির জন্য প্রতিনিয়ত গলানো হচ্ছে সোনা-রুপা। এ কাজে ব্যবহার করা হয় অ্যাসিড। দোকানের সামনে রাস্তার ধারে এসব কাজ করায় জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়েছে। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।

চৌকিরপাড় এলাকার খোকন সাহা বলেন, স্বর্ণের কারখানার ব্যাপারে মালিক ও কারিগরদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়, এমন কোনো স্থানে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার দাবি করেন তিনি।

রসুলের মোড় এলাকার মুক্তার হোসেন বলেন, আবাসিক এলাকায় কারখানাগুলোর কারণে সিংহভাগ মানুষ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একজন শ্বাসকষ্টের রোগী পাওয়া যাবে। এ ছাড়া চর্মরোগ, হৃদরোগসহ আরও অনেক সমস্যায় ভুগছে এখানকার বাসিন্দারা। এ বিষয়টি সমাধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়। জেলা প্রশাসনকেও একইভাবে অবহিত করা হয়। তবে জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

নাটোর সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রবিউল আওয়াল বলেন, অ্যাসিডের ধোঁয়া মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এতে মানুষের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি ও চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি হৃদরোগসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে ক্যান্সারও। লালবাজার এলাকার স্বর্ণপট্টির বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে অ্যাসিডে স্বর্ণ গলানোর জন্য। হাসপাতালে আসা শ্বাসকষ্ট বা চর্মরোগীদের অধিকাংশই এই স্বর্ণপট্টি এলাকার বাসিন্দা বা স্বর্ণ কারিগর।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন বলেন, ক্রমেই দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। প্রায় দোকানের সঙ্গেই রয়েছে গহনা তৈরির কারখানা। তবে অ্যাসিড ব্যবহারের বিধিনিষেধ মানছে না কেউ। তিনি বলেন, ভবনের পেছন দিকে অ্যাসিডের ধোঁয়া নির্গমনের পাইপ সংযুক্ত করায় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে গোটা এলাকায়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে অনেকে অপরিকল্পিতভাবেও বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। এতে আগামীতে পানি নিস্কাশনসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে এই এলাকায়। তবে সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

লালবাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আনিসুল ইসলাম বলেন, বাহাদুর শাহ পার্কে অনেকেই শরীরচর্চাসহ মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতেন। আশির দশকে তৎকালীন পৌর পরিষদ সেখানে মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেয়। এলাকাবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ওই মার্কেট নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন পর বর্তমান পরিষদ সেখানে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছে।

তিনি বলেন, মা ও আমি শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়েছি। এই এলাকায় কেউ সুস্থ নেই। বর্তমানে অ্যাসিডের তীব্র ঝাঁজ ও গ্যাসে আসবাবও নষ্ট হতে শুরু করেছে।

নাটোর জেলা বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত জানান, জেলায় বর্তমান মালিক সমিতির সদস্য রয়েছে তিন শতাধিক। এই মালিকদের মধ্যে ডিলিং লাইসেন্স রয়েছে শতাধিক। যাদের ডিলিং লাইসেন্স নেই তাদের সমিতির পক্ষ থেকে লাইসেন্স তৈরি ও নবায়ন করার তাগাদা দেওয়া হয়। কোনো দোকান মালিক যদি লাইসেন্স না করেন অথবা নবায়ন না করেন তার দায়ভার মালিক সমিতির নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অ্যাসিড ব্যবহারের কারখানাগুলো স্থানান্তরের কথা ইতোপূর্বে শুনেছিলাম। নিরাপত্তার কারণেই হয়তো স্থানান্তর করা হয়নি। প্রশাসনিকভাবে যদি কারখানাগুলো স্থানান্তর ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে দোকানের কাছাকাছি কারখানা থাকলে ভালো হয়।

এ বিষয়ে বগুড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুফিয়া নাজিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কর্মস্থলে নতুন যোগদান করেছেন বলে জানিয়ে এই প্রতিবেদককে রাজশাহীর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। রাজশাহীর কার্যালয়ে কর্মরত সিনিয়র কেমিস্ট মিজানুর রহমান জানান, রাজশাহী অফিসের উপপরিচালক মাহমুদা পারভিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান বলেন, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করাসহ জেলা প্রশাসন ও জুয়েলারি সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হবে। এ ছাড়া এ নিয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে ব্যাপারে স্থানীয় বিশিষ্টজনেরও পরার্মশ নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, কিছুদিন হলো নাটোর কর্মস্থলে যোগদান করেছি। অনেক কিছুই এখনও অবগত নই। তবে আবাসিক এলাকায় অ্যাসিডে স্বর্ণ গলানোর বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এলাকাবাসীসহ বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপ করে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ জুয়েলারি মালিক সমিতিকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সার্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com