ধর্মীয় রাজনীতির নামে উন্মাদনা কেন

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সৈয়দ লুৎফর রহমান সৈলুর

গত ২৮ আগস্ট সমকালে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার 'বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠনের এখনই সময়' শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়ের প্রথম প্যারায় লিখছেন, '...গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্যতা ধর্মীয় রাজনীতি এসে ফের দখল করে নিতে চাচ্ছে।' আর নিবন্ধের শেষ প্যারার একেবারে শেষদিকে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত' কথাটি লিখছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা যারা ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখে এসেছি, করে এসেছি, তারা তো জানি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী! স্বাধিকার-স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র। গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান হলো জনগণের অধিকার তথা মানবাধিকার। মানবাধিকারগুলোর প্রধানতম দুটি হলো আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এ দুটোই এখন বাংলাদেশে প্রশ্ন তোলে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্নাত হতে পারিনি, দীক্ষিত হতে পারিনি। আজ শেষ বয়সে এসে এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আত্মবিলাপ ও হাপিত্যেশ করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা হলো- আইনের শাসন আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। আইনের শাসন হতে হবে গণতন্ত্রের পক্ষে ও স্বার্থে 'ভালো লোকের দ্বারা ভালো আইনের ভালো শাসন'। এই 'ভালো লোক' কারা? আমি ইসলাম ধর্মের দিক থেকে 'ভালো লোক' কথাটি নিয়ে আলোচনা করব।

আল কোরআনে আল্লাহ আমাদের এই বলে প্রার্থনা করতে বলছেন, 'হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের দুনিয়ার ভালো দান করুন এবং আখিরাতের ভালোটাও দান করুন।' এর ব্যাখ্যা হলো- দুনিয়াতে ভালো হওয়া ও ভালো থাকা এবং ভালো হতে চাওয়া ও ভালো থাকতে চাওয়া, যা প্রতিফলিত হবে আখিরাতের ভালো হওয়ায় ও ভালো হতে চাওয়ায়। অর্থাৎ দুনিয়ায় যিনি ভালো, আখিরাতেও তিনি ভালো। দুনিয়ার উপরিউক্ত 'ভালো লোক' কথাটির অনেক ব্যাখ্যার মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম ও প্রধান ব্যাখ্যাটি হলো-

১. সৎ নন, মিথ্যা বলেন, সত্য গোপন করেন, ভুল করলে স্বীকার করতে চান না ও সংশোধন করতে বা সংশোধিত হতে চান না, অন্যায় অনাচার নিজে করেন আর তাই অন্যরা করলে তা দেখেও আইন অনুযায়ী তার প্রতিরোধ-প্রতিবাদ করেন না, অন্যের আইনসম্মত অধিকারে ও ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে নিজের অধিকার ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চান, আইনকানুন অনুসারে নাগরিক কর্তব্য ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন না এবং প্রকৃতিসম্মত ও পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করেন না। এমন মানুষ নামাজি-রোজাদার হলেও অনুমেয়-অননুমেয়, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বত্রভাবেই সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। আবার এই একই ব্যক্তি যদি নামাজি-রোজাদার না হয়ে বেনামাজি ও বেরোজাদার হন, তা হলে তিনি যে সমাজের জন্য সর্বত্রভাবেই ক্ষতিকারক শুধু তাই নয়, উপরন্তু তিনি সমাজের জন্য সব দিক থেকেই অভিশাপ।

২. ঠিক তার বিপরীতভাবে, অর্থাৎ সৎ, মিথ্যা বলেন না, সত্য গোপন করেন না, ভুল করলে স্বীকার করেন ও সংশোধিত হন, রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অনাচার নিজে করেন না আর অন্যরা করলে তা দেখে আইন অনুযায়ী তার প্রতিকার-প্রতিরোধ করেন, অন্যের আইনসম্মত অধিকারে ও ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেন না, আইনকানুন অনুসারে ও তুলনামূলকভাবে নির্ভুল থেকে নাগরিক কর্তব্য ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন, শ্রম দিয়ে উপার্জন করেন, সৎকাজে অর্থবিত্ত, সময়, শ্রম ব্যয় করেন এবং প্রকৃতিসম্মত ও পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করেন, এমন মানুষ আপাতত বা মাঝেমধ্যে কিংবা কোনো কারণে বেনামাজি-বেরোজাদার হলেও অনুমেয়-অননুমেয়, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনোভাবেই সমাজের জন্য ক্ষতিকারক নন। আবার এই একই ব্যক্তি যদি বেনামাজি-বেরোজাদার না হয়ে সঠিকভাবে নামাজি ও রোজাদার হন, তা হলে তিনি যে সমাজের জন্য কোনোভাবেই ক্ষতিকারক নন শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু তিনি সমাজের জন্য সব দিক থেকেই আশীর্বাদ।

অতএব, উপরিউক্তভাবে 'দুনিয়ায় যিনি ভালো' লোক, তেমন লোকদের দ্বারা গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা হলে এবং ভালো আইনের ভালো শাসন করা হলে ধর্মীয় রাজনীতি এসে ফের দখল করে নিতে পারবে না। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও সমুন্নত থাকবে।

উত্তর বাসাবো, ঢাকা

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com