
আফগানিস্তান
নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে তালেবান
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোশতাক আহমেদ

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের তিন সপ্তাহ পর ৭ সেপ্টেম্বর তালেবান আফগানিস্তানে তাদের অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। যত দ্রুততার সঙ্গে তারা দেশটির ক্ষমতা দখল করেছিল, ততই ধীরতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে এই সরকার গঠন প্রক্রিয়া। তা-ও আবার অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তীকালীন। সরকার ঘোষণার পর আরও এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন সরকারের শপথ বা আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। সে কারণেই ডানা মেলতে শুরু করেছে হাজারো রকমের গুজব।
নতুন সরকারের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বা 'আমিরুল মোমেনিন' হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে মোল্লা হাইবাতুল্লাহ আখন্দজাদাকে। আর ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে মোল্লা হাসান আখুন্দকে। হাইবাতুল্লাহ যে আমিরুল মোমেনিনের মর্যাদা পাবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। ২০১৬ সালের মে মাসে মার্কিন ড্রোন হামলায় তালেবানের তদানীন্তন প্রধান মোল্লা আখতার মনসুরের মৃত্যুর পর হাইবাতুল্লাহ দলটির নেতৃত্বে আসেন। দলের প্রধান পদটির পাশাপাশি তিনি তালেবানের শরিয়াহ আদালতেরও প্রধান ছিলেন কিন্তু পরের পদগুলো নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে বলেই সরকার গঠন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
অনেক বিশ্নেষকের মতে, তালেবান প্রশাসনের দ্বিতীয় পদটির, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিলেন দু'জন- আব্দুল গনি বারাদার এবং সিরাজুদ্দিন হাক্কানী। দু'জনেরই রয়েছে দীর্ঘদিনের 'জিহাদি' অভিজ্ঞতা, যার শুরু গত শতাব্দীর আশির দশকে। অবশ্য মোল্লা বারাদার প্রথম থেকেই তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে সিরাজুদ্দিনের জিহাদে হাতেখড়ি তার পিতা জালালুদ্দিন হাক্কানির পদাঙ্ক অনুসরণ করে। মত আর পথেরও রয়েছে কিছু ভিন্নতা।
মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এক রহস্য পুরুষ বলেই পরিচিত। তালেবানের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সদস্য এই জিহাদি নেতা সম্পর্কে মোল্লা ওমরের 'ভায়রা ভাই'। তালেবান নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তালেবান-উত্তর প্রথম প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গেও গোপন সম্পর্ক রক্ষা করতেন এ জন্যই যে, তারা দু'জনই পপালজাই গোত্রের মানুষ। প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সময়ে তিনি গোপনে আফগান সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা জানতে পেরে পাকিস্তানি আইএসআই ২০১০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ আট বছর কারাগারে আটকে রাখে। ২০১৮ সালে মার্কিন মধ্যস্থতায় তিনি মুক্তি পান এবং তালেবান দোহা অফিসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
অন্যদিকে, সিরাজুদ্দিন হাক্কানি বরাবরই কট্টরপন্থি বলে পরিচিত। ২০১৫ (মতান্তরে ২০১৬) সালে তার বাবা হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর পর তিনি নেটওয়ার্কের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাবার বার্ধক্যজনিত কারণে সিরাজুদ্দিন অনেক আগে থেকেই এই নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে আসছিলেন। রাজনীতির চেয়ে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। গত দুই দশকে আফগানিস্তানে যে কয়টি বড় বড় আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটির পেছনেই রয়েছে তার নেটওয়ার্ক। সে জন্যই মার্কিন প্রশাসন তার মাথার দাম নির্ধারণ করেছিল ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর থেকেই বারাদার-হাক্কানি দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে চলতি মাসেরই প্রথম সপ্তাহে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব্ব সংঘাতে রূপ নেয়, তাও আবার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অভ্যন্তরে। 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া' পত্রিকার ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, ৩ সেপ্টেম্বর মোল্লা বারাদারের সঙ্গে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির ভাই আনাস হাক্কানির সংঘর্ষ ঘটে। তাতে মোল্লা বারাদার কিছুটা আহত হন। কথিত এই ঘটনার পরদিনই তালেবানের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানের গোয়েন্দাপ্রধান ফয়েজ হামিদ তড়িঘড়ি করে কাবুলে ছুটে আসেন। ফয়েজ হামিদ উভয় গ্রুপের সঙ্গে কথা বলে একটা মীমাংসার ফর্মুলা দেন, যাতে মোল্লা হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করে সিরাজুদ্দিনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আব্দুল গনিকে উপপ্রধানমন্ত্রী করা হয়। উল্লেখ্য, তালেবানের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হাসান আখুন্দ তালেবানের ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবেই আপাতত একটা দফারফা করা হয়।
যতই দফারফা হোক না কেন, তালেবান নেতৃত্বের মাঝে প্রবহমান দুটি ধারার দূরত্ব আদৌ কমেনি। একটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছে কান্দাহারকেন্দ্রিক আদি তালেবান বা কোয়েটা শূরা, আরেকটি ধারা হলো হাক্কানি নেটওয়ার্ক। তালেবান আন্দোলনের সূচনাই হয়েছিল কান্দাহার থেকে প্রয়াত মোল্লা ওমরের হাত ধরে। অন্যদিকে, হাক্কানি নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু তারও আগে, সেই সোভিয়েতবিরোধী জিহাদের সময়ে। গত শতাব্দীর আশির দশকের অন্যান্য সব জিহাদি গোষ্ঠীর মতো হাক্কানি নেটওয়ার্কেরও মূল দর্শন ছিল বিদেশি শক্তির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা। রাষ্ট্রিক দর্শন সেখানে মুখ্য ছিল না। কিন্তু তালেবানের জন্মই হয়েছিল একটা বিশেষ দর্শনকে সামনে নিয়ে। তা হলো, শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
ভৌগোলিকভাবে কান্দাহার ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোয় আদি তালেবান গোষ্ঠী বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী। অন্যদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাব বেশি। এর অন্যতম প্রধান কারণ এই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন হাক্কানির জন্ম পাকতিয়া প্রদেশে।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের বাইরেও আরও দুটি শক্তি তালেবানের অভ্যন্তরে কাজ করে চলেছে। এর একটি হলো, মনসুর নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কটি মূলত পাকতিয়া প্রদেশের অংশবিশেষ এবং গজনি প্রদেশে ক্রিয়াশীল। এর বাইরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের 'হিজবে ইসলামী'। এটি আসলে রাজনৈতিক দল হলেও ভেতরে ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে সেই ২০০১ সাল থেকেই। সারাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এই দলটির কিছু না কিছু সমর্থক রয়েছে।
উল্লিখিত সব চিহ্নিত দল ও গ্রুপ তালেবানকে ব্যবহার করেছে একটা 'আমব্রেলা' হিসেবে, যার চূড়ান্ত পরিণতি তালেবানের ক্ষমতারোহণ। এখন যখন তালেবান ক্ষমতায় এসেছে স্বাভাবিকভাবেই সব গ্রুপই ক্ষমতার ভাগ বসাতে চাচ্ছে। বাস্তব কারণেই হাক্কানি নেটওয়ার্ক এগিয়ে রয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তালেবান ঘোষিত মন্ত্রিসভার দিকে তাকালে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তালেবান তাদের ছাতার ভেতর যারা ঢুকে আছে, তাদের নিয়ে খুব একটা স্বস্তিতে আছে বলে মনে হয় না। এরই মাঝে চলছে গুজবের স্রোত। অনেকেই বলছে, হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা নাকি অনেক আগে থেকেই 'উধাও'। সে কারণেই এত বড় বিজয়ের পরও এখন পর্যন্ত তাকে আফগানিস্তানের মাটিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, মোল্লা গনি বারাদারকে রেকর্ডকৃত অডিও বার্তা প্রচার করে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তিনি সুস্থ আছেন। এমতাবস্থায় আদি কান্দাহারি তালেবান আর হাক্কানি তালেবানের মাঝে শেষ পর্যন্ত কে ছাতা নিয়ন্ত্রণ করবে তা-ই এখন দেখার বিষয়।
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা, আফগানিস্তান
নতুন সরকারের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বা 'আমিরুল মোমেনিন' হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে মোল্লা হাইবাতুল্লাহ আখন্দজাদাকে। আর ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে মোল্লা হাসান আখুন্দকে। হাইবাতুল্লাহ যে আমিরুল মোমেনিনের মর্যাদা পাবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। ২০১৬ সালের মে মাসে মার্কিন ড্রোন হামলায় তালেবানের তদানীন্তন প্রধান মোল্লা আখতার মনসুরের মৃত্যুর পর হাইবাতুল্লাহ দলটির নেতৃত্বে আসেন। দলের প্রধান পদটির পাশাপাশি তিনি তালেবানের শরিয়াহ আদালতেরও প্রধান ছিলেন কিন্তু পরের পদগুলো নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে বলেই সরকার গঠন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
অনেক বিশ্নেষকের মতে, তালেবান প্রশাসনের দ্বিতীয় পদটির, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিলেন দু'জন- আব্দুল গনি বারাদার এবং সিরাজুদ্দিন হাক্কানী। দু'জনেরই রয়েছে দীর্ঘদিনের 'জিহাদি' অভিজ্ঞতা, যার শুরু গত শতাব্দীর আশির দশকে। অবশ্য মোল্লা বারাদার প্রথম থেকেই তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে সিরাজুদ্দিনের জিহাদে হাতেখড়ি তার পিতা জালালুদ্দিন হাক্কানির পদাঙ্ক অনুসরণ করে। মত আর পথেরও রয়েছে কিছু ভিন্নতা।
মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এক রহস্য পুরুষ বলেই পরিচিত। তালেবানের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সদস্য এই জিহাদি নেতা সম্পর্কে মোল্লা ওমরের 'ভায়রা ভাই'। তালেবান নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তালেবান-উত্তর প্রথম প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গেও গোপন সম্পর্ক রক্ষা করতেন এ জন্যই যে, তারা দু'জনই পপালজাই গোত্রের মানুষ। প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সময়ে তিনি গোপনে আফগান সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা জানতে পেরে পাকিস্তানি আইএসআই ২০১০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ আট বছর কারাগারে আটকে রাখে। ২০১৮ সালে মার্কিন মধ্যস্থতায় তিনি মুক্তি পান এবং তালেবান দোহা অফিসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
অন্যদিকে, সিরাজুদ্দিন হাক্কানি বরাবরই কট্টরপন্থি বলে পরিচিত। ২০১৫ (মতান্তরে ২০১৬) সালে তার বাবা হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর পর তিনি নেটওয়ার্কের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাবার বার্ধক্যজনিত কারণে সিরাজুদ্দিন অনেক আগে থেকেই এই নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে আসছিলেন। রাজনীতির চেয়ে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। গত দুই দশকে আফগানিস্তানে যে কয়টি বড় বড় আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটির পেছনেই রয়েছে তার নেটওয়ার্ক। সে জন্যই মার্কিন প্রশাসন তার মাথার দাম নির্ধারণ করেছিল ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর থেকেই বারাদার-হাক্কানি দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে চলতি মাসেরই প্রথম সপ্তাহে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব্ব সংঘাতে রূপ নেয়, তাও আবার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অভ্যন্তরে। 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া' পত্রিকার ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, ৩ সেপ্টেম্বর মোল্লা বারাদারের সঙ্গে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির ভাই আনাস হাক্কানির সংঘর্ষ ঘটে। তাতে মোল্লা বারাদার কিছুটা আহত হন। কথিত এই ঘটনার পরদিনই তালেবানের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানের গোয়েন্দাপ্রধান ফয়েজ হামিদ তড়িঘড়ি করে কাবুলে ছুটে আসেন। ফয়েজ হামিদ উভয় গ্রুপের সঙ্গে কথা বলে একটা মীমাংসার ফর্মুলা দেন, যাতে মোল্লা হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করে সিরাজুদ্দিনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আব্দুল গনিকে উপপ্রধানমন্ত্রী করা হয়। উল্লেখ্য, তালেবানের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হাসান আখুন্দ তালেবানের ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবেই আপাতত একটা দফারফা করা হয়।
যতই দফারফা হোক না কেন, তালেবান নেতৃত্বের মাঝে প্রবহমান দুটি ধারার দূরত্ব আদৌ কমেনি। একটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছে কান্দাহারকেন্দ্রিক আদি তালেবান বা কোয়েটা শূরা, আরেকটি ধারা হলো হাক্কানি নেটওয়ার্ক। তালেবান আন্দোলনের সূচনাই হয়েছিল কান্দাহার থেকে প্রয়াত মোল্লা ওমরের হাত ধরে। অন্যদিকে, হাক্কানি নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু তারও আগে, সেই সোভিয়েতবিরোধী জিহাদের সময়ে। গত শতাব্দীর আশির দশকের অন্যান্য সব জিহাদি গোষ্ঠীর মতো হাক্কানি নেটওয়ার্কেরও মূল দর্শন ছিল বিদেশি শক্তির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা। রাষ্ট্রিক দর্শন সেখানে মুখ্য ছিল না। কিন্তু তালেবানের জন্মই হয়েছিল একটা বিশেষ দর্শনকে সামনে নিয়ে। তা হলো, শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
ভৌগোলিকভাবে কান্দাহার ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোয় আদি তালেবান গোষ্ঠী বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী। অন্যদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাব বেশি। এর অন্যতম প্রধান কারণ এই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন হাক্কানির জন্ম পাকতিয়া প্রদেশে।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের বাইরেও আরও দুটি শক্তি তালেবানের অভ্যন্তরে কাজ করে চলেছে। এর একটি হলো, মনসুর নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কটি মূলত পাকতিয়া প্রদেশের অংশবিশেষ এবং গজনি প্রদেশে ক্রিয়াশীল। এর বাইরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের 'হিজবে ইসলামী'। এটি আসলে রাজনৈতিক দল হলেও ভেতরে ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে সেই ২০০১ সাল থেকেই। সারাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এই দলটির কিছু না কিছু সমর্থক রয়েছে।
উল্লিখিত সব চিহ্নিত দল ও গ্রুপ তালেবানকে ব্যবহার করেছে একটা 'আমব্রেলা' হিসেবে, যার চূড়ান্ত পরিণতি তালেবানের ক্ষমতারোহণ। এখন যখন তালেবান ক্ষমতায় এসেছে স্বাভাবিকভাবেই সব গ্রুপই ক্ষমতার ভাগ বসাতে চাচ্ছে। বাস্তব কারণেই হাক্কানি নেটওয়ার্ক এগিয়ে রয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তালেবান ঘোষিত মন্ত্রিসভার দিকে তাকালে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তালেবান তাদের ছাতার ভেতর যারা ঢুকে আছে, তাদের নিয়ে খুব একটা স্বস্তিতে আছে বলে মনে হয় না। এরই মাঝে চলছে গুজবের স্রোত। অনেকেই বলছে, হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা নাকি অনেক আগে থেকেই 'উধাও'। সে কারণেই এত বড় বিজয়ের পরও এখন পর্যন্ত তাকে আফগানিস্তানের মাটিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, মোল্লা গনি বারাদারকে রেকর্ডকৃত অডিও বার্তা প্রচার করে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তিনি সুস্থ আছেন। এমতাবস্থায় আদি কান্দাহারি তালেবান আর হাক্কানি তালেবানের মাঝে শেষ পর্যন্ত কে ছাতা নিয়ন্ত্রণ করবে তা-ই এখন দেখার বিষয়।
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা, আফগানিস্তান
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com