
বিশেষ লেখা
ভালোবাসা ও স্নেহের পরশে সন্তানকে শৃঙ্খলা শেখাতে হবে
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২১ । ০২:৫০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. মেহতাব খানম

সমাজে একটা পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে মানুষের জীবনধারাও বদলে গেছে। যন্ত্রের মাধ্যমে বেশি যোগাযোগ হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা কম হচ্ছে। ইন্টারনেটে খুব দ্রুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, যেগুলো খুব স্থায়ী সম্পর্ক নয়। বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে একটা অবক্ষয় ঘটেছে। এর প্রভাব বাচ্চাদের ওপরেও পড়ছে। এর ওপর করোনার ধকলও পার করতে হচ্ছে। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের ঘুরে বেড়ানোর কথা। কিন্তু তারা ঘরে বন্দি ছিল। গবেষণা বলছে, টিনএজ বয়সে তারা যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা পূরণ করতে অনেক সময় লেগে যাবে।
আত্মহত্যার পেছনে হতাশা, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও একাকিত্ব কাজ করে। বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তা আমাদের সবারই কমবেশি হয়। কিন্তু যখন এটি ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে কিংবা অসুস্থতার পর্যায়ে চলে যায়, তখনই সমস্যা। পেছনে যদি কোনো কষ্টের ঘটনা থাকে তখন অনেকেই মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন।
অনেক পরিবার সন্তানকে মূল্যবান মনে করে না; সেভাবে আমরা তাদের বড়ও করি না। বড় হওয়ার পর তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সন্তানকে স্নেহের পরশে রাখতে হবে। তাকে ভালোবাসতে হবে। কিন্তু আমরা সন্তানকে কষ্ট দিয়ে মানুষ করতে চাই। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলা শেখাতে হবে। কীভাবে লালন-পালন করলে সুন্দর মানুষ হতে পারবে, তা অনেক পরিবারই জানে না। পড়াশোনার দিকে মনোযোগ দেওয়া হলেও ভালোমানুষ করার চেষ্টা কম থাকে। বাচ্চারা নিজেকে মূল্যবান মনে করে বড় হয় না। বেশিরভাগ সন্তান আত্মমর্যাদা নিয়ে বড় হতে পারে না। ছোটদেরও সম্মান করতে হবে। তার মতামত নিতে হবে।
এ বিষয়ে আমাদের স্কুলগুলোতেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। উন্নত দেশগুলোতে স্কুলকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারখানা। সেখানে যিনি সবচেয়ে বেশি শিশুর বিকাশ ঘটাতে পারবেন, তিনি শিক্ষকতা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে ওই রকম প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর জীবন-দক্ষতা অর্জন হচ্ছে না। এখন স্কুলগুলোতে বেত দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে।
একজন মানুষ যখন মানসিকভাবে আঘাত পায় বা ব্যর্থ হয়, তখন তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পরিবার-বন্ধুদের সহমর্মিতা প্রয়োজন। পিতামাতাকে শিশুদের মানসিকভাবে সহযোগিতা দিতে হবে। আর মানসিক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া শিখতে হবে। যদি কোনো অভিভাবক দেখেন তাদের সন্তানের আচরণ হঠাৎ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তখন তাদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। এ ছাড়া এই সময়ে অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব স্কুল-কলেজপড়ূয়া সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া।
মানুষের যখন আত্মহত্যার প্রবণতা হয়, তখন তারা সাহায্য খোঁজে। আগের মতো কেউ পরিবার নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায় না, গল্প করে না। মানুষে মানুষে যোগাযোগ এখন যন্ত্রের মাধ্যমে একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আগে এটা সরাসরি হতো। পরিবারে হয়তো চারজন মানুষ আছে। বাসায় ফিরে চারজনই চারটি মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করছে। কেউ যদি খিটখিটে মেজাজের হয়, হয়তো বেশি খাচ্ছে বা কম খাচ্ছে। ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা, অল্পতেই রেগে যাওয়া, মানুষকে আঘাত করা, দৈনন্দিন কাজে ধীর গতি, উদ্বেগ- এ সবই বিষণ্ণতার লক্ষণ। বাবা-মার মধ্যে নেতিবাচক সম্পর্কের কারণেও সন্তান বিষণ্ণতায় ভোগে। আবার বিয়ে বিচ্ছেদের কারণে দুই পরিবারের সম্পর্কের অবনতিতে শিশুদের সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানসিকভাবে চাপে পড়ে শিশুরা।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বাংলাদেশে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ নিয়ে কয়েকটা 'ইনস্টিটিউশন' বা সংগঠন আছে, তবে তা অপ্রতুল। ঢাকার বাইরে নেই বললেই চলে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আরও ইনস্টিটিউট দরকার।
লেখক: অধ্যাপক, এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com