হুন্দাইর নতুন ইঞ্জিনে প্রথম যাত্রাতেই ট্রেন বিকল

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২১ । ০১:৪৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল প্রতিবেদক

ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে কেনা আলোচিত সেই ১০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভের (ইঞ্জিন) প্রথম যাত্রাতেই ট্রেন বিকল হয়েছে। এই ইঞ্জিনের একটিতে (৩০০৩) গতকাল বৃহস্পতিবার 'চট্টগ্রাম মেইল' ঢাকায় আসার পথে তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন নষ্ট হয়। চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সংযোজন না করে ৩২৩ কোটি টাকায় কেনা এই ইঞ্জিনগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তবে প্রকল্প পরিচালক হাসান মনসুর সমকালকে বলেছেন, ইঞ্জিন নয়, বগির কারণে ট্রেন বিকল হয়েছে। ৩০০৩ নম্বর ইঞ্জিনেই বৃহস্পতিবারই 'চট্টলা এক্সপ্রেস' কমলাপুর থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। নতুন ইঞ্জিন বিকল হওয়ার খবরকে মিথ্যা আখ্যা দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী সমকালকে বলেন, ৩০০৩ নম্বর ইঞ্জিনে বুধবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা করে 'চট্টগ্রাম মেইল'। পথে প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ট্রেনে সমস্যা দেখা দেয়। পরে তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেনটি থেমে যায়।

এই লোকোমোটিভ নিয়ে গত ৪ মার্চ সমকালে 'নিম্নমানের ইঞ্জিনই নিতে চায় রেল!' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গত বছরের আগস্টে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসে। রেলের সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ না থাকায় ইঞ্জিনে ত্রুটি রয়েছে। প্রকল্পের আগের পরিচালক এ কারণে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু রেলের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ইঞ্জিনগুলো খালাস করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ তোলা প্রকল্প পরিচালককে বদলি করে দেওয়া হয়। প্রায় এক বছর পাহাড়তলীতে নানা রকম পরীক্ষা এবং বসিয়ে রাখার পর গত ৩ অক্টোবর থেকে চলতে শুরু করেছে ইঞ্জিনগুলো।

বর্তমান প্রকল্প পরিচালক সমকালকে বলেন, সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই ইঞ্জিনগুলো চালানো হচ্ছে। ইঞ্জিনগুলো ত্রুটিপূর্ণ এটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে একটি পক্ষ খুশি হয়। তারাই সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে, ইঞ্জিন বিকল হয়েছে।

গতকাল ট্রেন বিকল হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, এর সঙ্গে ইঞ্জিনের সম্পর্ক নেই। ট্রেনের ১৬ এবং ২৫১ নম্বরের বগির ভ্যাকুয়াম সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এতে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এর সঙ্গে ইঞ্জিন ভালো-খারাপ হওয়ার সম্পর্ক নেই। অনেক চেষ্টাতেও ভ্যাকুয়াম মেরামত করা যায়নি। পাঁচ ঘণ্টা বিলম্বে ভ্যাকুয়াম 'কাট' করে 'চট্টগ্রাম মেইল' ট্রেন কমলাপুরে আনা হয়। এরপর ৩০০৩ ইঞ্জিন দিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে আরেকটি ট্রেন রওনা করে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। ওই ট্রেন চলাচলে কোনো সমস্যা হয়নি।

রেলের বিভাগীয় ট্রাফিক কর্মকর্তা খায়রুল কবির সমকালকে বলেছেন, তারা শুধু ট্রেনের চলাচল দেখভাল করেন। ইঞ্জিন না বগিতে সমস্যা হয়েছে তা মেকানিক্যাল বিভাগ বলতে পারবে। প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী বোরহার উদ্দিন সমকালকে বলেছেন, এখনও খবর পাননি কী কারণে ট্রেন বিকল হয়েছিল।

এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

রেল সূত্রে জানা গেছে, লোকোমোটিভগুলোতে দরপত্রের কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান (ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট) ইঞ্জিন, অল্টারনেটর ও ট্রাকশন মোটর সংযোজিত হয়নি। তদন্তেও তা প্রমাণিত হয়েছে।

গত ৩ মার্চ রেলমন্ত্রী ও সচিবের উপস্থিতিতে সভায় ইঞ্জিনগুলোর সক্ষমতা খতিয়ে দেখতে 'যাচাই কমিটি' গঠন করা হয়। অথচ চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলে সিঙ্গাপুরে আরবিট্রেশন হওয়ার কথা। কিন্তু রেলওয়ের সাবেক কর্মকর্তা আহসান জাকিরের মাধ্যমে 'রিভিউ' করে ইঞ্জিনগুলোকে উপযুক্ত দেখিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এই ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ ডলারে কিনেছে রেল। ট্যাক্স ও ভ্যাটসহ প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। করোনার কারণে ইঞ্জিন দেশে আনার আগে প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন (প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন) হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী ইএমডিএস-৮-৭১০জি৩বি-টি১ মডেলের ইঞ্জিন সংযোজন করার কথা। দেশে আনার পর দেখা যায়, দেওয়া হয়েছে ইএমডিএস ৮-৭১০জি৩বি-ইএস মডেল। টিএ১২-সিএ৯ মডেলের অল্টারনেটর সংযোজনের শর্ত থাকলেও দেওয়া হয়েছে টিএ৯-১২সিএস৯এসই মডেলের। এ২৯০৯-৯ মডেলের ট্রাকশন মোটর সংযোজনের শর্ত ছিল। দেওয়া হয়েছে ২৯০৯ মডেলের ট্রাকশন মোটর। লোড বক্সসহ ১১ ধরনের যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়নি। ইঞ্জিনের সক্ষমতা পরীক্ষায় লোড বাক্স আবশ্যিক যন্ত্র। অভিযোগ রয়েছে, লোড বক্স না দেওয়ায় ইঞ্জিন কখনোই পুরোপুরি পরীক্ষা করা যায়নি।

চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ না পাওয়ার অনিয়মে রেলের তৎকালীন মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর-উল-আলমও জড়িত বলে লিখিত অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু মঞ্জুর-উল-আলমকেই তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়। পরে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের আপত্তিতে কমিটি পরিবর্তন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনেও আসে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়নি। তবে হুন্দাই রোটেম দাবি করে, তারা যেসব যন্ত্রাংশ দিয়েছে সেগুলো আরও ভালোও।

ইঞ্জিন খালাস না করে সমুদ্রবন্দরে ফেলে রাখলে জরিমানা গুনতে হবে- এই যুক্তিতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের নির্দেশে ইঞ্জিন গ্রহণ করা হয়েছিল। খালাসের পর হুন্দাই রোটেমের দেশি এজেন্ট সিসিআইসি দুই ধরনের পিএসআই সার্টিফিকেট দিয়েছিল। একটিতে দাবি করা হয়, ইঞ্জিনগুলোর টেস্টিং, ট্রায়াল রান ও কমিশনিং সন্তোষজনক। পরে একই তারিখে এসব বাদ দিয়ে আরেকটি সার্টিফিকেট দেয়।



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com