গোপালগঞ্জ

চাকরি ছেড়ে মৎস্য চাষ

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মনোজ সাহা

অদম্য ইচ্ছা আর আপ্রাণ সাধনায় মানুষের জীবনে সাফল্য ধরা দেয়। বলছি, ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে মাছ চাষে সফল এক আত্মপ্রত্যয়ী যুবকের কথা। কঠোর পরিশ্রম সঙ্গে আত্মবিশ্বাস আর মেধার যুগলবন্দিতে সাফল্য এসেছে জীবনে। স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও স্থাপন করেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তার নাম নাম মো. এবাদত হোসেন মোল্লা। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা প্রয়াত মকবুল হোসেন মোল্লার ছেলে ৩৭ বছর বয়সী এবাদতের বার্ষিক আয় এখন ১৫ লাখ টাকারও বেশি।

এবাদত হোসেন মোল্লা শিক্ষাজীবন শুরু করেন চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর গাজীপুর থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি ও ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে আনার্স এবং ২০১৩ সালে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। লেখাপড়া শেষে ছোটেন চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে। পেয়েও যান কাঙ্ক্ষিত একটি চাকরিও। বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় যোগ দেন ইউনাইডেট কমার্শিয়াল ব্যাংকের অফিসার পদে। কিন্তু চাকরির সীমিত টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে থাকেন। এমতাবস্থায় একটা সময় সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু করবেন, হয়ে উঠবেন উদ্যোক্তা। ব্যাংকের চাকরি ছাড়ার সাহসী সিদ্ধান্তই তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে বলে জানান এবাদত।

২০১৬ সালে চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার নেশায় কর্মস্থল নরসিংদী থেকে গোপালগঞ্জে চলে আসেন। ওই বছর নিজের ৫২ শতাংশের পুকুরে পোনা উৎপাদনে নেমে পড়েন। প্রথম বছরই ৬ লাখ পোনা উৎপাদন করে বিক্রি করেন, যাতে লাভ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ ছাড়া কাজে নামলেও একটা সময় ভাবেন, এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা। ফলে জেলা ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে মাছ চাষের ওপর স্বল্পমেয়াদে প্রশিক্ষণ নেন। পরের বছর ২০১৭ সালে এবাদত মোল্লা ১০ একরের নয়টি পুকুর লিজ নিয়ে বড় পরিসরে মাছ চাষ শুরু করেন। সাহস, ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমের সমন্বয়ে সাফল্য ধরা দেয় দ্বিতীয় বছরেই। এরপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বর্তমানে তার আওতাধীন পুকুরগুলোর একটিতে করছেন পোনার চাষ। বাদবাকি নয়টি পুকুরে করছেন কই, শিং, রুই, কাতল, মৃগেলসহ কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ। মাছ উৎপাদনে ব্যবহার করেন মানসম্পন্ন ফিড ও মেডিসিন। পানি ও মাটির গুণগতমান ঠিক রেখে সারাবছরই মাছ চাষ করে থাকেন। ফলে তার পুকুরে উৎপাদিত মাছের আকার ও স্বাদ দুটোই থাকে ভালো। যে কারণে বাজারে তার উৎপাদিত মাছের চাহিদা ও দাম পাওয়া যায়। বছরে একবার পোনা ও একবার বড় মাছ বিক্রি করে থাকেন এই সাহসী উদ্যোক্তা।

মাছ চাষের পাশাপাশি পুকুর পাড়ে অব্যবহূত জমিতে করছেন শাকসবজির আবাদ। সেখানে তিনি কলা, পেঁপে, বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়োসহ বিভিন্ন মৌসুমি সবজি ও শাক উৎপাদন করছেন। যা দিয়ে তিনি তার নিজের পরিবার, প্রতিবেশী ও স্বজনদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত শাকসবজি বিক্রিও করছেন। এ খাত থেকেও সাপ্তাহিক আয় আসছে তার। এবাদত হোসেন মোল্লার এই উদ্যোগ তথা মৎস্য খামারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অন্তত ১৫ জনের। এই মানুষগুলো প্রায় সারাবছরই তার অধীনে খামারে কাজের মাধ্যমে সংসার চালাচ্ছেন। সংসারে তাদের এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য, নিজেদের ছেলেমেয়েদেরও স্কুলে পাঠাচ্ছেন। বাড়িঘরের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।

এবাদত হোসেন মোল্লার এই খামার পরিদর্শন করে গিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সিনিয়র সচিব, সচিব, পদস্থ কর্মকর্তা, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্তত ৫০ জন পদস্থ কর্মকর্তা। পরিচ্ছন্ন ও ছবির মতো সাজানো এই খামার দেখে নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন তারা।

নিজের উদ্যোগের বিষয়ে এবাদত মোল্লা জানালেন, 'ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে মাছ চাষ করে আজ আমি সফল হয়েছি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল সাহসের। সেই সৎ সাহস ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে সাফল্য এসেছে। করোনাকালের সময়ে যদিও প্রত্যাশিত লাভ হয়নি। পাশাপাশি সম্প্রতি মাছের খাবারের দামও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত দাম দিয়ে খাবার কিনে মাছ উৎপাদনে আর্থিক সংকট তৈরি হলেও আশা করি এ বছর এবং আগামী বছর সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব।' মাছ চাষের সম্ভাবনাকে আরও বেশি কাজে লাগানো এবং মৎস্য খাত থেকে অধিক আয়ের বিষয়ে তিনি মনে করেন, সম্ভাবনাময়ী মৎস্য চাষ সেক্টরে প্রণোদনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে এ খাতে কাজ করছেন যারা, তারা আরও বেশি উপকৃত হবেন। এ ছাড়াও তিনি বলেন, 'অক্সিজেন ফেল করে মাছের মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু কমাতে পুকুরে অ্যারোটার মেশিন বসানো প্রয়োজন। সরকার এই মেশিনের ব্যবস্থা করলে মৎস্যচাষিরা উপকৃত হবেন। মৎস্যচাষি আরও বেশি বেশি মাছ চাষে আগ্রহী হবেন। দেশের প্রোটিনের চাহিদা এ সেক্টর থেকে পূরণ করা সম্ভব হবে।

সমস্যার কথা বলতে গিয়ে এবাদত বলেন, গোপালগঞ্জে সরকারি হ্যাচারি রয়েছে। কিন্তু এখান থেকে সময়মতো পোনা পাওয়া যায় না। যশোর থেকে একটি পোনা এক টাকায় সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু গোপালগঞ্জের সরকারি হ্যাচারিতে কখনও কখনও পোনা পাওয়া গেলেও তিন টাকা দরে কিনতে হয়। এতে মৎস্যচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। গোপালগঞ্জের সরকারি হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করে পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হলে চাষিরা আরও লাভবান হবেন।

মাছ চাষে গোপালগঞ্জের বর্তমান সময়ের তরুণদের উৎসাহী হতে আহ্বান জানিয়ে এবাদত বলেন, 'নিম্ন জলাভূমিবেষ্টিত গোপালগঞ্জ জেলায় মাছ চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তরুণরা এই সেক্টরে আসতে পারেন। এটি লাভজনকও বটে। মাছ চাষের মাধ্যমে তারা নিজে যেমন স্বাবলম্বী হতে পারবেন, নিজ নিজ এলাকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করতে পারেন।'

লেখক: প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com