
'কৃষক ভুবন'-এর উদ্যোগ
প্রতিটি গ্রাম পরিচিত হবে ফলের নামে
যশোর
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তৌহিদুর রহমান

ভিটামিন নি ভিলেজ গড়ার লক্ষ্যে বিতরণ করা হচ্ছে গাছ
যশোর সদরের হামিদপুর দক্ষিণপাড়ার আকাশ গামা। ২০২০ সালে কৃষক ভুবনের দেওয়া ১০টি কুলের চারা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন দেখেন কুলের বাগান করার। পাঁচটি বল সুন্দরী ও পাঁচটি কাশ্মীরি আপেল জাতের কুলের চারা পান, যা তার বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেন। গাছগুলোতে ভালো ফলও আসে। সিদ্ধান্ত নেন বাগান করার। এরপর রাস্তার পাশে ১৭ কাঠা জমিতে আরও ৯৩টি কুলের চারা রোপণ করেন। যেগুলোর বয়স বর্তমানে সাত মাস। আর প্রত্যেকটি গাছই ১০ থেকে ১৫ ফুট লম্বা হয়ে গেছে। আকাশ বলেন, কৃষক ভুবনের কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ আর ১০টি কুলের চারাই আমার বাগান করার উৎসাহ জুগিয়েছে। গাছগুলো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। প্রতিটি গাছেই প্রচুর ফল ধরেছে। গাছপ্রতি প্রায় দেড় মণ করে ফল পাওয়া যাবে। আশা করছি এই মৌসুমে কুল বিক্রি করে ভালো লাভবান হবো। শুধু আকাশই নয়, ওই গ্রামের অনেক তরুণ এখন কুল চাষে ঝুঁকছেন।
ওই গ্রামের আরেক তরুণ সৈকত হোসেন। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনিও কৃষক ভুবনের দেওয়া প্রশিক্ষণ ও কুলের চারা পেয়ে নিজের ১০ কাঠা জমিতে বাগান গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, তার ৪০টি কুল গাছে ভালো ফলন এসেছে। বিক্রি করে ভালো মুনাফার আশা করছেন এখন। বলেন, হামিদপুর গ্রাম ইতোমধ্যে কুলগ্রাম নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। এখানে ১০ থেকে ১২ জন মিলে প্রায় সাত বিঘা জমিতে এখন কুলের চাষ করছেন। আমাদের দেখাদেখি আরও অনেকে এখন কুল চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন।
যশোর সদরের ভায়না গ্রাম। ওই গ্রামে পাওয়া যাবে কদবেল। নাম হবে কদবেল গ্রাম। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে আছে চার থেকে পাঁচটি করে কদবেল গাছ। যখন সব গাছে ফল ধরবে তখন গ্রামটি কদবেল গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে যাবে। কথা হয় ওই গ্রামের রেজাউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কৃষক ভুবনের থেকে প্রত্যেক বাড়িতে কদবেলের চারা দিয়েছিল। গাছগুলো সব বেঁচে গেছে। সেগুলো এখন বড় হচ্ছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে যশোর সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন থেকে 'এক গ্রাম এক ফল' এই প্রতিপাদ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে কৃষক ভুবন নামে একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন। একদল কৃষক ও ছাত্র নিয়ে সংগঠনটি গঠন করেন ফতেপুর গ্রামের কৃষিবিদ ইবাদ আলী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক ফলের চারা বিনামূল্যে গ্রামের কৃষকদের মাঝে বিতরণ করছে কৃষক ভুবন নামের এই সংগঠন। প্রত্যেক গ্রামে প্রতিটি বাড়ির আঙিনা, অনাবাদি ও পতিত জমিসহ বিভিন্ন স্থানে এক জাতের ফল বা সবজির চাষ করে সেই গ্রামের নামকরণ করছেন সেই ফল বা ফসলের নামে। ইতোমধ্যে কৃষক ভুবনের ফলগ্রাম ইউনিয়ন ও উপজেলার সীমারেখা পার করে বিস্তারলাভ করেছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
এর আগে ইবাদ আলী যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বলরামপুর গ্রামে মাল্টার চারা বিতরণ করেন। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় এখন বেড়ে উঠছে মাল্টা গাছ। ওই গ্রামটি হবে মাল্টাগ্রাম। কথা হয় ওই গ্রামের শাহীন রেজার সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিটি বাড়িতে মাল্টার চারা দিয়েছেন ইবাদ আলী। চলতি মৌসুমেই এসব গাছ থেকে ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তিনি।
কৃষক ভুবনের সদস্যরা জানান, যশোর সদর উপজেলার সীতারামপুরে সাতশ পরিবারের মধ্যে বারোশ সিডলেস লেবুর চারা বিতরণ ও রোপণের মাধ্যমে গ্রামটির নাম দেওয়া হয়েছে 'সিডলেস লেবু গ্রাম'। হামিদপুরে ৬০০ কুল গাছ রোপণ ও উদ্বুদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে কুলের চাষ শুরু হয়েছে। আগামী বছর প্রায় ছয় হাজার গাছের কুল বাণিজ্যিকভাবে বিপণন সম্ভব হবে হামিদপুর থেকে। গ্রামটি বর্তমানে 'কুলগ্রাম' নামে পরিচিতি লাভ করেছে। সুলতানপুর গ্রামকে কমলা গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। ভায়না গ্রামে ছয়শটি কদবেল গাছের চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। সবকটি চারা খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। সুলতানপুর গ্রামে আড়াইশ' দার্জিলিং কমলার চারা বিনামূল্যে প্রদান ও রোপণ করা হয়েছে। গ্রামটির নাম হবে কমলা গ্রাম। এ ছাড়া বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনামূল্যে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের চারা বিতরণ করা হয়েছে। কৃষক ভুবন আশা করছে, অচিরেই এসব গ্রাম থেকে টন টন ফল বাজারজাত করা সম্ভব হবে।
ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার সাগান্না গ্রামে কৃষক ভুবন যশোরের রয়েছে একটি ফলগ্রাম। সেখানে বিনামূল্যে বারোশ ফলের চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে থাই পেয়ারা, কদবেল, জাম এবং কুল। চারাগুলো এখন পর্যন্ত সুস্থ-সবল আছে। দুই বছরের মধ্যেই চারাগুলো ফল ধরার উপযোগী হয়ে উঠবে। এই ফলগ্রাম থেকে প্রি বছর ৫-১০ লাখ টাকার ফল বাজারজাত করতে পারবে কৃষক।
মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া ইউনিয়নের দরিশলই গ্রামের নামটি ইতোমধ্যেই 'ভিটামিন সি' গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। সেখানেও আমলকী, আমড়া, কাগজি লেবু, বাতাবী লেবুসহ 'ভিটামিন সি' সমৃদ্ধ আটশ প্রজাতির ফলগাছ রোপণ করা হয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রজাতির ফল গাছ ফলন দিতে শুরু করেছে।
কৃষক ভুবনের সভাপতি কৃষিবিদ ইবাদ আলী বলেন, আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা চাই ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন ফল গাছ রোপিত হবে। এভাবে একটি গ্রাম এক প্রজাতির ফলে, অপর গ্রাম অন্য আরেক প্রজাতির ফলে ভরে যাবে। পাইকাররা সরাসরি নির্দিষ্ট গ্রামে এসে কাঙ্ক্ষিত ফল চাহিদা অনুয়ায়ী পাবে। এ প্রক্রিয়ায় দুই পক্ষই লাভবান হবে। মূলত দালালের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পাবে কৃষক। এর ফলে কৃষকের দোরগোড়ায় পাইকাররা থাকবে, কৃষক পাইকারদের দরজায় নয়। কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে, বাজার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। কৃষকই হবে জাতীয় বীর।
কৃষকদের কল্যাণে নিবেদিত নিরলস পরিশ্রমী কৃষিবিদ ইবাদ আলী ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ কৃষক ভুবন-এর মাধ্যমে মানুষকে ফল ও সবজি গ্রাম-এর জন্য নিয়মিত উৎসাহ প্রদান করে যাচ্ছেন। এতে করে অনেকেই এ ধারণা নিয়ে নিজের গ্রামকে ফল বা সবজিতে ভরে দিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ইবাদ আলী কৃষকদের কৃষিপণ্যের আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা, ফসলের রোগব্যাধি, বাজার ব্যবস্থা বিষয়ে বিনামুল্য পরামর্শ ও সেবা প্রদান করে আসছেন। আগামীতে ইবাদ আলী কৃষকদের জন্য একটি বিশেষ হাসপাতাল ও ফসলের জন্য পৃথক একটি কৃষি হাসপাতাল নির্মাণ করতে চান। এ ক্ষেত্রে কৃষক ভুবনের প্রতি সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের মনোযোগ আশা করছেন তিনি। া
লেখক: প্রতিনিধি, যশোর
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com