
নারী ফুটবলে স্বর্ণালি সময়
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ০১ নভেম্বর ২১ । ১৪:০৮ | প্রিন্ট সংস্করণ
গোলাম রাব্বানী ছোটন

দেশের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষমাত্রই জানেন, মেয়েদের ফুটবলে এখন স্বর্ণালি সময় যাচ্ছে। আমি খুব গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, এই যাত্রার শুরু থেকেই আমি জড়িত। তবে শুরুতে অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে আমাদের। একসময় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে দলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হতো অভিভাবকদের। তাদের বোঝানো ছিল অনেক কষ্টের। ছেলেরা যেখানে ফুটবল খেলছিল না ঠিকঠাক সেখানে মেয়েরা খেলবে ফুটবল? মানুষ কী বলবে, দর্শক কীভাবে নেবে? এমন হাজারো চ্যালেঞ্জ ছিল ফুটবল ফেডারেশনের সামনে। এখন সেইসব বাধার অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে ফেডারেশন। বোঝাতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রবেশ করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সেই প্রথম খেলার আগে থেকেই আমি নারী ফুটবলের দায়িত্ব পাই। বলতে পারেন প্রায় এক যুগের চেয়েও বেশি সময় মেয়েদের ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছি নিজেকে। তবে শুরু থেকে এখন অনেক উন্নতি হয়েছে আমাদের নারী ফুটবলারদের। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে এক যুগ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে কোচিং জীবন শুরু হয় আমার। কয়েকটি ক্লাবে কোচিং শেষে ২০০৬ সালে বাফুফের কোচ হিসেবে কাজ শুরু করি। তিন বছর পর ২০০৯ সালে মেয়েদের কোচ হই। শুরুতে মেয়েদের কোচিং করানোর কথা শুনেই কেমন জানি লেগেছিল। পরে নিজেকে অভয় দিয়ে কাজটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম। সত্যিই আমার জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। রাঙামাটি, নারায়ণগঞ্জ, যশোর ও সাতক্ষীরা থেকে বাছাই করা খেলোয়াড়দের নিয়ে ফুটবল প্রশিক্ষণ শুরু করি। তখন হ্যান্ডবল, ভলিবল খেললেও ফুটবলের সঙ্গে পরিচিত ছিল না মেয়েরা। ২০১০ সালে ঢাকা এসএ গেমস সামনে রেখে অনুশীলন শুরু করা দলটি ব্রোঞ্জ পেয়েছিল। আমি অবশ্য তাতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আসলে এর চেয়ে ভালো করাও তখন সম্ভব ছিল না। চার জেলার মেয়েদের আগ্রহের কারণে তাদের ফুটবলে নেওয়া হয়েছিল। তবে ফুটবলের সঙ্গে তাদের তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না আগে। সেটাও মেনে নিতে হয়েছিল। মেয়েদের ফুটবলের নিয়মকানুন থেকে সবকিছু তাদের শেখাতে বেশ কষ্টই হয়েছিল। সেবার আমরা তেমন সাফল্যও পাইনি। তবে হাল ছাড়িনি। কাজ করতে থাকি। বাড়িয়ে দিই পরিশ্রম। ২০১৫ সালে এসে বলা যায় নিয়মিত সাফল্য ধরা দিতে থাকে। সে বছর নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। পরের বছর তাজিকিস্তানে এই টুর্নামেন্টের শিরোপা ধরে রাখে অনায়াসে। এরপর সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৮ প্রতিযোগিতায় শিরোপা উৎসবে মেতে ওঠে বাংলাদেশের মেয়েরা। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাই পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অংশগ্রহণ করে মূল পর্বে।
২০১১ সালে শুরু হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। এই বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টকে বলা যায় আমাদের নারী ফুটবলের জন্য আশীর্বাদ। ফুটবলে এখন যেই সাফল্য পাচ্ছি আমরা তার অনেকটাই সম্ভব হয়েছে এই বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের কল্যাণে। যেই মেয়েরা ফুটবলের অনেক কিছুই জানত না, বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে খেলে তারা ফুটবলের বেসিকটা শিখে নিচ্ছে শুরুতে। এতে আমাদের সুবিধাই হয়েছে। নিয়মকানুন শেখাতে তাদের প্রতি বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে না। ফলে আমরা তাদের পরিচর্যা করে সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারছি।
এই প্রতিযোগিতা থেকে যারা উঠে আসছে তাদের নিয়ে দল গড়ে আমরা সাফল্য পেয়েছি, পাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও পাব। তাদের ঠিকঠাক নার্সিং করাই হচ্ছে এখন আমাদের কাজ। তাদের দলে ধরে রাখা আমাদের অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, ১৭ বা ১৮ বছরে পড়লেই গ্রামের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। সেই বিয়ে দেওয়ার তাড়া থাকে নারী ফুটবলারদের অভিভাবকদেরও। আমরা সেই অভিভাবকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। ফুটবল ফেডারেশনের প্রতি এবং নারী ফুটবলারদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজর থাকায় আমরা এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি।
নারী ফুটবলে সংকটের কথা বলতে গেলে ইতিবাচক দিকটাই ভেসে ওঠে চোখে। আগেই বলেছিলাম, একসময় সামাজিক ও পারিবারিক সংকটে আবদ্ধ ছিল নারী ফুটবল। তখন অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। নানান কথা শুনতে হতো। বিশেষ করে মেয়েরা ফুটবল খেলছে এটা অনেকেই ভালো চোখে নিত না। অভিভাবকদেরও শুনতে হতো নানা কথা। তবে আমাদের মেয়েরা ভালো খেলায় এখন সেটা অনেক কমে এসেছে। মেয়েদের টিভিতে দেখালে, পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে অভিভাবকরা এখন মেয়েদের নিয়ে গর্ব করে। জেলাভিত্তিক দলগুলোতেও এখন ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। বলা যায়, সারাদেশের মেয়েরাই এখন ফুটবলে আসছে। তাছাড়া ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক কিছু পরিকল্পনার কারণে আমরা নারী ফুটবলের পারিবারিক ও সামাজিক সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। দর্শকের সাপোর্ট এখন আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ অনেকটা সুগম করে দিয়েছে।
আর নারী ফুটবলে সম্ভাবনা কিন্তু অনেক। এটা এখন মুখের কথা নয়। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই বুঝতে পারবেন। বেশি না, মেয়েদের গত তিন বছরের ফলাফলে চোখ রাখলে যে কেউ সেটা বুঝতে পারবেন। আসলে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে সাফল্যের পর আমাদের চোখ এখন জাতীয় দলের দিকে। বর্তমানে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে যারা আছে তাদের ঠিকমতো পরিচর্যা করলে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আমরা একটা শক্তিশালী জাতীয় দল পাব। তাদের যেই ট্যালেন্ট তার বিকাশ ঘটাতে পারলেই জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টেও সাফল্য পাব আমরা। আমরা সাফ ফাইনাল খেলেছি। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা সাফ ফুটবলের শিরোপা ঘরে তুলব! শুধু সাফই নয়; আমাদের যেসব ফুটবলার উঠে আসছে তাদের দিয়ে অচিরেই আমরা দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের সেরার মুকুট পরতে পারব; দেশের ফুটবলপ্রেমীদের মতো এই প্রত্যাশা এখন আমিও করি!
লেখক
কোচ
বাংলাদেশ নারী যুব ফুটবল দল
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com