সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে যাক আমাদের ফুটবল

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ০১ নভেম্বর ২১ । ১৩:৫২ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাইফুল বারী টিটু

ঃফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা দীর্ঘদিনের। এক সময়ের অনন্য জনপ্রিয় খেলাটি এখন আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। দেশের ফুটবলের অবস্থা প্রতিবেশী দেশের ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ফুটবলে র‌্যাংকিং প্রকৃতপক্ষে এর বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে না। এটা অনেকটাই নির্ভর করে দলটি কতগুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে, কেমন পারফরম্যান্স করেছে, জিতেছে তার ওপর। এখন আমাদের ফুটবলের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, আমরা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কমই ভালো খেলোয়াড় তৈরি করতে পারছি। আমাদের সময় জনপ্রিয় একটা খেলার জন্য ভালো খেলোয়াড় খুঁজতে হতো না। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে ফুটবলার হয়ে উঠেছেন। পদ্ধতি ও কাঠামোর মাধ্যমে গড়ে ওঠা বিকেএসপির মতো অন্য প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলায় অধিক জোর দেওয়া হয়। এক সময়ের জনপ্রিয় খেলা হওয়ায় নিজের চেষ্টায় ভালো করার ইচ্ছাশক্তি জুগিয়েছে কিন্তু এখন যা কোনো ক্লাবনির্ভর হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত চেষ্টার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে না। ফলে এই সীমার বাইরে থেকে কোনো ভালো খেলোয়াড় আসছে না। ব্যক্তিগতভাবে দক্ষ হয়ে ওঠার প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। বিশ্ব ফুটবলের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের খেলার প্রতি আগ্রহী ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে কাজ করে, যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। ছোটবেলা থেকে খেলোয়াড়সুলভ হয়ে গড়ে না ওঠায় আমাদের দৌড়, বলের গতি, বল নিয়ন্ত্রণ, ফিনিশিংসহ অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হয়, কোচকে দলগত ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়, বিপক্ষের সঙ্গে লড়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হয়। প্রত্যেককে আলাদা করে শেখানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। ফলে ভালো ফল আসে না।

আমদের পর্যাপ্ত একাডেমি ও ক্লাবের অভাব রয়েছে। দীর্ঘ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন না থাকায় ফুটবলারদের পাইপলাইন তৈরি হচ্ছে না। একদল খেলোয়াড় ভালো করার পর আরেক দল খেলোয়াড় না আসায় সহজেই আমরা ধরে নিই ফুটবলারদের ধারবাহিকতা নেই। নিয়মিত ভালো ফল ও খেলোয়াড়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে একটি পাইপলাইন তৈরি করা প্রয়োজন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি। তৃণমূল থেকে কাজ করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন ভালো খেলোয়াড় হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত হবে, সে বিষয়টি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ। ফলে নিয়ত ভালো খেলোয়াড়ের অভাব দেখা দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে একটা ম্যানিয়া আছে, বিদেশি বাংলাদেশি নাগরিকরা টেকনিক্যালি ভালো খেলে। জামাল ভূঁইয়া এলো, তারপর তাদের কাজীসহ অন্যরা আসছে, ভালো খেলোয়াড় আমাদের বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে কিন্তু আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে না অথচ এরা কিন্তু এদেশেরই সন্তান। এমনসব বিষয় সরাসরি জাতীয় দলে প্রভাব ফেলছে।

একসময় জাতীয় দলে প্রত্যেকটি পজিশনের জন্য চার থেকে পাঁচজন প্রতিযোগিতা করত টিমে আসার জন্য। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকলে সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। এ বিষয়টি অনুপস্থিত থাকায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায়। কোচিংয়ে আমরা কিছুটা উন্নতি করেছি কিন্তু দেশি-বিদেশি কোচ যাই হোক, পুরো দেশে এই কোচিং ছড়িয়ে দিতে পারছি না। ফলে দেশে ছড়িয়ে থাকা ভালো খেলোয়াড়দের মূল দলে আনতে সক্ষম না হওয়ায় বিকেএসপির মতো কোচিং প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা পাহাড়ি খেলোয়াড়রা পাচ্ছেন না। স্যাটেলাইটের মতো একটি জালের মধ্যে সব খেলোয়াড়কে তৈরি করার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারলে ভালো খেলোয়াড় ধারাবাহিকভাবে বেরিয়ে আসতে বাধ্য। আমরা বিদেশি খেলোয়াড়দের দিকে নজর দিলে দেখতে পাই, তারা একাডেমি বা ক্রীড়াচক্রের মাধ্যমে তৈরি হয়ে আসছে কিন্তু আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। হলেও তা যথেষ্ট নয়। দেশের গুটিকয়েক ক্লাবগুলো বিশেষ প্রতিযোগিতার সময় দৌড়ঝাঁপ ও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলেও স্থায়ী সুফল ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে।

আমাদের একটি স্টাইল গড়ে উঠেছে। বড় দলগুলোর সঙ্গে খেলার সময় আমরা চেষ্টা করি গোল না খাওয়ার। এ বিষয়টি খেলতে নামার আগে থেকেই আমাদের মাথায় কাজ করে। রক্ষণাত্মকভাবে খেললে বিপক্ষ দলের কাছে বেশি সময় বল থাকে, শক্তিশালী একটি ভিত গড়ে তোলা সম্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রে এর সুফলও মিলেছে। কাতারের সঙ্গে, বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়িং ম্যাচে আমরা প্রায় জিতেই গিয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, অ্যাটাকিংয়ের সময় বিষয়টি বদলে যাচ্ছে, এতে বলটি আপনার আয়ত্তে থাকতে হয়। রক্ষণাত্মক হওয়া এবং অ্যাটাকিং খেলায় শুরু থেকে দক্ষতা ও কাঠামোগতভাবে তৈরি না হওয়ায় অনেক সময় ভালো খেললেও ভালো ফল বয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে গোল করেও পরে গোল খাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতে সক্ষম হয়নি। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ানোর মধ্যেই আমরা অনেক সহজ ভুল খেলে ফেলি। ফলে ফিনিশিংটা ভালো হচ্ছে না। জেমিডে প্রায় সাড়ে তিন বছর কোচের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ওস্কার ব্রুসোন এলেন। তিনি এ অবস্থা থেকে কিছুটা উত্তরণের জন্য চেষ্টা করেন। খেলার স্টাইল পরিবর্তন করার খুব বেশি সময় ও সুযোগ ছিল না। তিনি খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা লড়াকু মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছেন।

ক্লাব ফুটবলের সঙ্গে জাতীয় ফুটবলের পার্থক্য স্পষ্ট। ক্লাব ফুটবলে চারটা গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে আমরা চারজন বিদেশি খেলোয়াড় দিয়ে দিই। কিন্তু জাতীয় দলে এসব পজিশনে বিদেশি খেলোয়াড় খেলার সুযোগ নেই। জাতীয় দলে ক্লাবের ফুটবলাররা এ স্টাইল মেইনটেইন করতে পারেন না; ফলে খেলায় ছন্দপতন ঘটে। একদিকে নির্দিষ্ট ধরনের খেলায় অভ্যস্ততা, অন্যদিকে ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রাখা। সাফ ফুটবলে আগেরবার গ্রুপ পর্বে বিদায় হলেও এবার আমরা বিজয়ের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। ফাইনাল খেলার সুযোগ ছিল কিন্তু নেপালের সঙ্গে আমাদের ১০ খেলোয়াড় নিয়ে খেলতে হয়েছিল আবার কিছু সহজ ভুল হয়েছিল; ফলে আমরা প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গেলাম। এটা পুরোপুরি ব্যর্থতা বলব না কিন্তু আশপাশের দেশের ফুটবলে মানের তুলনায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে। আমরাও উন্নতি করেছি কিন্তু তারা আরও বেশি উন্নতি করেছে। ফলে পার্থক্যটা রয়েই যাচ্ছে। আমরা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছি, ভুটান, নেপালকে হারানোর সক্ষমতা রয়েছে। দশজন খেলোয়াড় নিয়েও আমরা ইন্ডিয়ার সঙ্গে ড্র করেছিলাম, এটি কম পাওয়া নয় কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সাফ গেমসের ক্ষেত্রে আমরা কিছু কিছু বিষয়ে ভাগ্যবান কিন্তু আশানুরূপ ফল আনতে পারিনি। ব্যর্থতাকে বড় করে না দেখে দুর্বলতা কাটিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি। তা না হলে আমরা মাঝে মধ্যে কিছুটা আলোর মুখ দেখলেও এমন ব্যর্থতা-ভুল হতেই থাকবে।

ভালো খেলোয়াড় তৈরি হওয়ার পেছনে মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের সময় ফুটবল অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা ছিল। ক্রিকেট, বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার তকমা লাগার পর থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফিফার দুই শতাধিক সদস্য দল ফুটবলের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ধাপে অংশ নেয়। বিশ্ব আসরে ফুটবলে জায়গা করে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। যে কোনো খেলাই একটি প্রোডাক্ট, এটা কীভাবে সেল করবেন তার ওপর নির্ভর করছে এর জনপ্রিয়তা। এভাবে দেখলে আমরা ফুটবলটাকে সেভাবে সেল করতে সক্ষম হইনি; ফলে এদেশের ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারিনি। আমি মনে করি, এখনও আমাদের ফুটবল অনেক জনপ্রিয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে মানের খেলা হতো, তা এখন নেই। বিশেষ করে বিশ্বকাপে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ফলে ফুটবলসহ অনেক খেলার জনপ্রিয়তাই কমেছে। এক সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন, সিনেমা হল ও খেলার মাঠ ছিল আমাদের বিনোদনের অন্যতম স্থান। তা এখন অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।

খেলোয়াড়দের মানসিক ডিসট্রাকশন কমিয়ে কাঠামেগত পদ্ধতিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টায় নিজেকে তৈরি করার মানসিকতাও গড়ে তুলতে হবে। ক্লাবগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। আমাদের ফুটবলকে ভালো করতে হলে যারা এ অবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়েছে তাদের দিকে তাকাতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর খেলোয়াড় বাছাইয়ের ধরন ও প্রক্রিয়ায় এগোতে হবে। সদিচ্ছা এবং সুন্দর পরিকল্পনা ছাড়া ফুটবলার ন্যাশন হিসেবে গড়ে উঠতে পারব না। কিন্তু হঠাৎ একটু ঝলক দেখাতে সক্ষম হবো মাত্র। বিদেশি কোচ ও খেলোয়াড় এলে আমাদের ফুটবলাররা উপকৃত হন। বিদেশি খেলোয়াড়রা দেশের খেলোয়াড়দের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়, রোলমডেল হিসেবে কাজ করে। তাদের খেলা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। কিন্তু অন্যকে অনুকরণ করে খেলার চেয়ে নিজেকে তৈরি করে নিজের সুপ্ত প্রতিভার প্রয়োগ করতে পারলে সেই দক্ষতা স্থায়ী হয়। দেশের ফুটবলে ভালো করতে হলে সংশ্নিষ্ট সবার একত্রে কাজ করতে হবে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পার্টনারশিপের ভিত্তিতে স্কুল পর্যায় থেকে ক্লাব করে ফুটবলার তৈরি করার দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত পরিকল্পনার মাধ্যমে আগামী দিনের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। সঠিক পরিকল্পনা, আর্থিক জোগান ও যোগ্য কর্মী থাকলে শুধু ক্লাব না তৃণমূল পর্যায়ে ক্লাব বা একাডেমি তৈরি করে পুরো বাংলাদেশকে ছোঁয়া সম্ভব হবে। দেশের আনাচে-কানাচে ফুটবলের উত্তাপ ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুটবলের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে বাস্তবায়ন সম্ভব।

সমকাল দেশ-বিদেশের খেলার খবর প্রকাশের অনন্য ভূমিকা আমি শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছি। দেশ ও বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সব খবর মানুষের মাঝে তুলে ধরুক। সমকাল ১৭ বছরে পদার্পণ করেছে। আমার পক্ষ থেকে সমকালের জন্য প্রাণঢালা অভিনন্দন। দীর্ঘ এই পথ চলা আরও সুগম হোক।

লেখক
প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার
বর্তমান ফুটবল কোচ

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com