
বিশ্ব ব্যবস্থা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ ও বাংলাদেশ
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মৌলি আজাদ

প্রযুক্তির সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাদের কাছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব টার্মটি খুব পরিচিত হলেও আমজনতার কাছে এটি খুব একটা পরিচিত নয়। টার্মটিকে আমরা অনেক জটিল ভাবি এবং এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ পাই না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করার পর মনে হলো, এ যেন এক বিস্ময়। এর সুফল নেওয়ার জন্য রীতিমতো ব্যাকুল হলাম।
প্রথমত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো মূলত আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের জন্য একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কারের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল। যার ফলে যান্ত্রিকীকরণের প্রচলন হয়। প্রথম শিল্পবিপ্লবের পর আমরা পেরিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে। এর ঠিক অব্যবহিত আগে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে আমরা দেখা পাই ইন্টারনেটের। আমরা জানি, একটি ইন্টারনেট ছাড়া মোবাইল, আরেকটি ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইলের মধ্যেই রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তাই দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের যুগে বেশ ভালোভাবেই ঢুকে গেছে, যা আমরা করোনার সময়ে প্রতিটি মুহূর্তে উপলব্ধি করেছি। ডিজিটালাইজেশনের ফলে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া, অফিসের নথির কাজ করা, সদাইপাতি কেনা, পরিবহন সেবা পাওয়াসহ বিভিন্ন সুবিধা আমরা নিয়েছি। করোনা মোকাবিলাও কিন্তু আমরা নানান ডিজিটাল অ্যাপসের মাধ্যমে করছি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল এর চেয়েও অ্যাডভান্স এবং অধিকতর সুবিধা দেবে। বিভিন্ন সেক্টরে সেবা প্রদানে পাওয়া যাবে প্রযুক্তির ছোঁয়া। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিঙ্কস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য প্রযুক্তির সমন্বয় হবে।
২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে শিল্পকারখানা হয়ে পড়বে পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর। এর ফলে ৭৫ মিলিয়ন জব পরিবর্তিত হলেও ১৩৩ মিলিয়ন নতুন জবের সৃষ্টি হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে কিছু পেশায় অনেক নতুনত্ব ও দ্রুতগামিতা আসবে। যথার্থ যোগ্যতা ও দক্ষতা না থাকলে সেসব কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ কঠিন হবে বৈকি! বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এ বিপ্লবে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে। এ ক্ষেত্রে আমরা কতটা প্রস্তুত?
ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্টম্ন নয়, পুরোপুরি বাস্তব। আমরা ইতোমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যক্রমে ঢুকে গিয়েছি, কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেন আরও বেশি কিছু। উদাহরণস্বরূপ যখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম, তখন চাইলাম কাজের সুবিধার্থে ডাটা সংগ্রহ করতে। সেই ডাটা আমরা অটোমেশন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতাম। কিন্তু আগামীতে ডাটা এমনভাবে উপস্থাপিত হবে যে, ডাটাই আমাদের পরবর্তী কাজের পথনির্দেশ করবে। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অনেক বেশি ফাস্ট। উন্নত দেশগুলো তাদের সব সেক্টরেই এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এর সুবিধা নিতে হলে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখনও প্রচুর কাজ করা বাকি।
যদি শুধু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের কথাই ধরি, তাহলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিড বেজড নানা বিভাগ ও ল্যাব তৈরি করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীর হাতেকলমে কাজ শেখার সুবিধা থাকবে। আমরা জানি, শিল্পবিপ্লবে শিক্ষায় চারটি ধাপ হলো : লেকচার মেমোরাইজেশন, নলেজ প্রডিউশিং এডুকেশন, ইন্টারনেট ইনেবলড লার্নিং এবং ইনোভেশন প্রডিউশিং এডুকেশন। ইনোভেশন প্রডিউশিং এডুকেশন চালু রাখতে হলে আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষগুলো প্রযুক্তি শিক্ষার উপযোগী করে তুলতে হবে, যেখানে শেখানো হবে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ প্রযুক্তির নানা বিষয়।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা নিতে হলে দেশের মেধাবী, দক্ষ ও ক্রিয়েটিভ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। পুরোনো সামান্য প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে এ কাজ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা চার কোটি ৭৬ লাখ। আমাদের দেশে আগামী ৩০ বছরজুড়ে তরুণ/উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। জ্ঞানভিত্তিক এই বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদের বেশি প্রয়োজন হবে। এ জন্য তরুণদের গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দরকার হবে।
দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করা সম্ভব হলে জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দেশ থেকেই বেশি উপযুক্ত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল নিতে হলে প্রযুক্তি সংযুক্ত যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তাদের কোর্স/কারিকুলামে পরিবর্তন তথা আপডেট থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত ব্যাপক গবেষণা এবং মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে হবে। অনেকের ধারণা হতে পারে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে হয়তো বিজ্ঞানের জয়কার হবে এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাই কেবল সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। তা কিন্তু নয়। মনে রাখতে হবে, হিউম্যান স্টাডিজ ছাড়া এর পরিপূর্ণ সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞান ও হিউম্যান স্টাডিজ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে কাজে যেমন গতিশীলতা আসবে, তেমনি আসবে স্বচ্ছতা। উদাহরণস্বরূপ, যদি ব্লকচেইন টেকনোলজি সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করা যায় তবে সার্টিফিকেট/দলিল জালিয়াতি রোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব হবে। যার সুফল ভোগ করবে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। যার গতি, দৌড় ও ক্ষমতা আমাদের চিন্তার বাইরে। আমরা ডিজিটাইজেশনে আছি, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ডিজিটাইজেশন ও ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন। আমাদের এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে, টিকে থাকতে হবে। তাই এখনই সময় তরুণদের প্রযুক্তির এ শাখায় দক্ষ করে প্রস্তুত এবং যথাযথ পলিসি তৈরি করা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে- এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। তার জন্য দরকার সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাওয়া।
লেখক
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com