আমার যা কিছু অতৃপ্তি সবই লেখালেখিকে ঘিরে: হাসান আজিজুল হক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২১ । ২৩:১৩ | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২১ । ২৩:১৬

অনলাইন ডেস্ক

হাসান আজিজুল হক (জন্ম: ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯ - মৃত্যু: ১৫ নভেম্বর, ২০২১)

সমকালীন বাংলা ভাষার প্রধান কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহী নগরীর চৌদ্দপাইয়ের বিহাসের নিজ বাসভবনে মারা গেছেন। তার আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন মুহিত হাসান- যা সমকালের কালের খেয়ায় ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি সমকাল অনলাইনের পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো:

প্রশ্ন: ২ ফেব্রুয়ারি আপনি বয়স ৭৯ বছর পূর্ণ করে ৮০'তে পা দেবেন। নিজের এই দীর্ঘ জীবনের দিকে পেছন ফিরে তাকালে আপনার কেমন উপলব্ধি হয়? আসা-যাওয়ার পথের ধারে হাতে কী রইল?

উত্তর: সাধারণত, আমি নিজের বয়স নিয়ে তেমন একটা খেয়াল রাখি না। প্রতিনিয়ত খেয়াল করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স এক বছর বাড়ল, কি আরেক দিন বাড়ল- এ নিয়ে মোটেও ভাবতে চাই না। জন্মদিন পালন করা বা হিসাব রাখার রীতি তো আমাদের সমাজে সেভাবে ছিল না। এটা পরে এসেছে। এমনকি জন্মদিন লিপিবদ্ধ করাটাও ছিল প্রায় দুর্লভ কাণ্ড। তবে ভবিষ্যতের ও ইতিহাসের জন্য এটা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা পরে সবাই বুঝতে পেরেছে। সে যাক, আমি নিজের বয়স সম্পর্কে ইচ্ছা করেই সচেতন থাকি না। যদি সচেতন থাকতাম, তাহলে মনে হয়, প্রতি মুহূর্তেই অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থা হতো। আয়ু কমে যাচ্ছে প্রতিক্ষণ- এই ভয়েই কাতর থাকতাম। তবে এসব তো একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কেজো কারণে যখন নিজের জন্ম তারিখ কোথাও লিখতে হয়, কাউকে জানাতে হয়, তখন তো খেয়াল করতেই হয়। আর ভাবি, আহ! অনেকটাই তো বয়স হয়ে গেল। ওই রকম সময় আমার বাবার কথা মনে পড়ে। তিনি আমার মতো বয়সে কী কী করতেন, সেসব স্মরণে আসে। আমার এক চাচা আমার মতো বয়সেই নির্দি্বধায় গৃহত্যাগ করেছিলেন; তার কথাও মনে পড়ে। মনটা স্বভাবতই তখন বিষণ্ণ হয়। আবার তা কেটেও যায় অবশ্য। বা কাটানোর জন্য বয়স বাড়া নিয়ে ঠাট্টাও তো কম করি না। সুকুমার রায়ের 'হযবরল'র ওই ঠাট্টাটা আমার খুব প্রিয় :'চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না- ঊনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে।' আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব সেভাবে করতে চাই না। জাগতিক কি বৈষয়িক- সাংসারিক জীবন নিয়ে তেমন কোনো অতৃপ্তি নেই। আমার যা কিছু অতৃপ্তি, সবই লেখালেখিকে ঘিরে।

প্রশ্ন: তাহলে জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের লেখালেখির জগৎকে কি নতুন করে সাজানোর কথা ভাবছেন? খুব লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু লেখা হয়নি- এমন কোনো কাজে হাত দিতে চান?

উত্তর: ওই যে বললাম- তৃপ্তি পাই না। প্রতিনিয়ত কিন্তু এটাই মাথার মধ্যে ঘোরে যে সবচেয়ে ভালোভাবে যা লিখতে পারতাম, একটি 'ফাইনেস্ট' গল্প কিংবা একটি উপন্যাস- তার কোনোটিই লিখতে পেরেছি বলে এখন অব্দি মনে হয় না। আজ অথবা এই মুহূর্ত পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি, তাকে আমার এখনও অকিঞ্চিৎকর বলেই মনে হয়। বারবার মনে হয়, আরও ক'টা ভালো গল্প তো লিখতে পারতাম। আরও লিখতে পারতাম একটি বৃহদাকৃতির, সর্বার্থে 'এপিক' কোনো উপন্যাসও। ত্রিকাল জড়িয়ে লিখতে চেয়েছিলাম, শৈশবেই তো জীবন ব্যাপক বিচিত্র অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে আমায়। এসব মিলিয়ে মিশিয়ে প্রেক্ষিতটা নেহাত কম বড় করতে পারতাম না। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে আকাঙ্ক্ষাটা এখনও মনের মধ্যে তুষের আগুনের মতো যে অল্প-বিস্তর জ্বলছে না, তা-ও তো নয়। দেখাই যাক!

প্রশ্ন: উপন্যাসের কথাই যখন উঠল, আরেকটু বিস্তারে যেতে চাই। আপনার এখন অব্দি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত দুটি উপন্যাসই এক হিসাবে নারীকেন্দ্রিক, এবং দুটিরই প্রেক্ষাপটে রয়েছে রাঢ়বঙ্গ। কিন্তু আপনার জীবন যে বিরাট বৈচিত্র্যের মধ্যেই কাটল- জন্ম হলো গ্রামে, কৈশোরেই স্বভূমিহারা হলেন, তারুণ্য কাটল রাজনীতির মাঠে, আর বাকি জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে- মাঝে আরও কত কী ঘটল! উপন্যাসের বিষয় হিসেবে বামপন্থি রাজনীতি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের প্রসঙ্গ তো আপনি বেছে নিতেই পারতেন। তা নেননি কেন?

উত্তর: না, ভাবিনি। এসব নিয়ে উপন্যাস লেখার মতো কোনো উপকরণ আমার হাতে আছে বলে মনে হয় না। কারণ, আমি তো আর সব ঘটনা কল্পনা করে নিয়ে লিখি না। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটে, তাই নিয়ে আমার আখ্যানের মূল জমিটুকু তৈরি করি। তুমি যে দুটি প্রসঙ্গের কথা বললে, সেসবের অন্তর্জগৎ আমি আগাপাশতলা গভীরভাবে চিনি বলে দাবি করতে পারি না। বরং আমি অন্য কয়েকটা বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, এখনও চাই। গ্রামজীবনের যে অন্তর্গত সংঘাত; বাইরে থেকে তা সেভাবে বোঝা যায় না; তার মধ্যকার বিবমিষা, ক্ষুধা, হারজিৎ, লড়াই- সব মিলিয়ে একটা গ্রামের রূপকে গোটা বাংলাদেশেরই গল্প বলার ভাবনা ছিল। আবার নদীর যে ভাঙাগড়া, তাকে ঘিরে মানুষের জীবনযাপন- এটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য একটা বিষয়। বারবার তাই নদীকে ঘিরে একটা উপন্যাস লিখতেও ইচ্ছা করে। বিভূতিভূষণের 'ইছামতী' বা মানিকের 'পদ্মানদীর মাঝি' এখনও আমাকে দারুণভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়। নদী কীভাবে এ জনপদের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে, তা লেখার চেষ্টা হয়তো করব। আমি শৈশবে নদী চিনতামই না। এই অপরিচয় আমার জন্য প্রাথমিকভাবে বিড়ম্বনার হলেও, পরে তা আবার নতুন আবিস্কারের সুযোগও এনে দিয়েছে। শৈশব থেকেই নদীকে দেখার সুযোগ হলে হয়তো এর মধ্যকার বাঁক ও ঘাত-প্রতিঘাত আমি সেভাবে বুঝতে পারতাম না। অতিপরিচয়ের আবরণ তা ঢেকে রাখত। দেশভাগের পর খুলনায় এসে আমি প্রথমবারের মতো নদীকে চিনতে শুরু করি, এবং আমার ধারণা, সেই চেনা অন্য অনেকের থেকেই আলাদা রকম।

প্রশ্ন: অনেক দিন তো পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্প লিখছেন না। সেই কবে 'বিধবাদের কথা' বেরুলো; তারপর যা বেরিয়েছে তার সবই তো নকশা জাতীয় আখ্যান...

উত্তর: বড় আকারের গল্প এখন একটা লিখছি। ওটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। এ বাদেও আমার তূণীরে আরও তীর আছে হে। বৃহদাকৃতির আরও গল্প লেখার পরিকল্পনা করছি। আর নকশা জাতীয় আখ্যানগুলো একত্র করে একটা বই বানিয়েছি। নাম দিয়েছি 'রাই কুড়িয়ে বেল'। এবারের বইমেলায় বেরুবে। এই জাতীয় রচনার ওখানেই ইতি।

প্রশ্ন:
দেশভাগের পর খুলনায় এসে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার প্রসঙ্গেই আপনার আত্মজীবনীর সমাপ্তি। একটু বেশি আগেই ইতি টেনেছেন বলে মনে হয়। আত্মকথাকে কি আরেকটু বিস্তারিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন?

উত্তর: এটা নিয়ে দোটানায় আছি। নিজের এক সময় মনে হয়েছিল, আর লিখে কী হবে! সবার তারুণ্য কি যৌবন তো এমন ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়, কিন্তু শৈশবটা প্রত্যেকেরই আলাদা। শৈশবে দু'জন মানুষের অবিকল এক অভিজ্ঞতা হয় না। সে জন্য শুধু শৈশব নিয়েই সবিস্তার লিখে সন্তুষ্ট ছিলাম। যদিও পরে অনেকেই বলছেন, আপনি এটা লিখে চলুন; থামবেন না। কিন্তু আমি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

প্রশ্ন: বাস্তবতা থেকে আখ্যানের মূল জমি তৈরির ব্যাপারে বলছিলেন। অনেক সময় আপনার গল্প-উপন্যাসের সাথে আপনার চার খণ্ডের আত্মকথার কোনো কোনো ঘটনার ব্যাপক মিল দেখতে পাই। যেমন, আপনার শৈশবস্মৃতির নিপীড়ক মর্দানা বুবুর সঙ্গে খুব মিলে যায় 'একটি আত্মসমর্পণের কাহিনী' গল্পের শিক্ষিকা চরিত্রটি...

উত্তর: ঠিক তেমন সচেতনভাবে এটা করি না। গল্পটির ওপর ওই স্মৃতির ছায়াটা পড়েছে মাত্র। লেখার সময় যে এটা মাথায় রেখেই লেখা শুরু করেছি, তেমনটা নয়। ঘটনাটা গল্পের জমিটুকু সরবরাহ করেছে এটা যেমন সত্যি, আর তার ওপর আমি কল্পনার বিস্তার ঘটিয়েছি. তাও তেমনি সত্যি। কথাসাহিত্যে কল্পনা বাদ দিলে বাস্তব পোক্ত হয় না; বাস্তব বাদ দিলে কল্পনা ডানা মেলে না। দুটোই সমান দরকারি। 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' লেখার নেপথ্য কাহিনীটা এখানে বলি। গল্পটা কোথায় ছিল? খুলনার ফুলতলার এক গ্রামে একটা বিলের কাছে লাগোয়া একটা কুঁড়েঘরে, দেশভাগের পর যখন সেখানে চলে এসেছি, একটা পরিবারকে দেখতে পাই। পরিবার বলতে এক বৃদ্ধ- তিনি শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল, আর এক কিশোরী। তারা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নি। তাদেরকে ঘিরে তখন এলাকায় নানা কানাঘুষা শোনা যেত। দেশভাগের পর ওপার থেকে প্রায় খালি হাতে এসেছে, খুব দরিদ্র অবস্থায় তারা দিন কাটায়। মামা ও নিজের পেটের ক্ষিদে নিবারণের জন্য মেয়েটিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শরীর বিক্রি করতে হয়। এলাকার কিছু বখাটে ছেলেপুলে লালসা মেটাতে ওই ঘরে নাকি নিয়মিত যায়। ওই মামার চরিত্রটি আমার গল্পে হয়ে গেছে বৃদ্ধ বাবার চরিত্র। মেয়েটিকে কারা ওই পথে এনেছিল, কেউ তাকে জোর করে ওই কাজে প্রথম বাধ্য করেছিল কি-না, আমি কিছু জানি না। ঘটনাটা জানার পর দুই কি আড়াই বছর পর, ওই ঘটনার কঙ্কালের সাথে কল্পনা ও প্রেক্ষিতের রক্ত-মাংস মিশিয়ে গল্পটি চূড়ান্তভাবে লিখে ফেলি। এর আগে দু-তিনবার চেষ্টা করলেও পারিনি। সময়ের দূরত্বটাই হয়তো লেখাটা সার্থকভাবে গড়ে দিতে সাহায্য করেছে।



প্রশ্ন: বরাবরই দেখেছি, আপনি খুব সামাজিক মানুষ। কিন্তু নিজের কাছে আবার খুবই একলা। এই যে সবাই ডাকলেই সভা-সমিতিতে যান, এমনকি একটা কথা চালু আছে- পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে সাহিত্যসভা বসিয়ে সেখানে আপনাকে ডাকলেও যেতে দ্বিধা করবেন না। কখনও এসব সভাতে যেতে বিরক্তি বোধ করেন না? আমার তো মনে হয়, এ কারণে আপনার লেখার সময়েরও অপচয় হতে পারে।

উত্তর: সভা-সমিতি আমার লেখাকে কোনোদিনই বাধাগ্রস্ত করেনি। একটা দিন বাইরে যাব, সেটা থেকেও তো শিখব। লেখা তো নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়। তুমি মনে করছ একটা বিষয় তুমি জানো, আসলে তো তা জানো না। অনেক কিছুই জানো না। এই জানা-বোঝা কি অবগত হওয়াটা ঘটে তখনই, যখন তুমি বাইরের মানুষের সঙ্গে মেশো; বহু রকম মানুষের সঙ্গে মেশো। এসি রুমে বসে লেখক হওয়া যায় না। কাজেই সভা-সমিতিকে আমি গুরুত্ব দিই। তবে আজকাল সভায়-অনুষ্ঠানে যেতে তেমন ইচ্ছা করে না দুটো কারণে। প্রথমত, শরীর আগের তুলনায় কিঞ্চিৎ দুর্বল। দ্বিতীয়ত, খুব বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা পাওয়ার সুযোগ আর ঘটছে না।

প্রশ্ন: আপনার জীবনকে ভাগ করে দেখলে মনে হয়, তিনটি ভূখণ্ড আপনার গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমটি আপনার জন্ম-ভূখণ্ড রাঢ় অঞ্চল, দ্বিতীয়টি দেশভাগের পর যেখানে আবাস খুঁজে নিলেন, সেই খুলনা এলাকা; আর তৃতীয়টি রাজশাহী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পরই যেন আপনার জীবনের বহিরঙ্গে একটা স্থিরতা এলো...একটা আর্কষণীয় বন্ধুবৃত্ত খুঁজে পেলেন, যারা প্রত্যেকেই একেকজন গুণী লেখক-কর্মী-চিন্তক...

উত্তর: রাজশাহীর এই বন্ধুবৃত্ত না থাকলে আমি সম্পূর্ণ হতাম না। বলতে পার, আমি বন্ধুকৃত্য করতে পারলে রীতিমতো বর্তে যাই। খুব পছন্দ করি তাদের, খুব ভালোবাসি। এরা যখন আসেন, গল্প করেন, কথা বলেন' দারুণভাবে উজ্জীবিত হই। কষ্টের বিষয়, এই বৃত্তের কয়েকজন আর নেই। প্রয়াত আলী আনোয়ার, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, নাজিম মাহমুদের কথা খুব মনে পড়ে। কয়েকজনকে আবার কাছে পাই না। গোলাম মুরশিদ লন্ডনে, শহিদুল ইসলাম ঢাকায়। হাতের কাছে আছেন একমাত্র সনৎকুমার সাহা। কাছে মানে নিকট প্রতিবেশীই আদতে। 'রণে বনে জলে জঙ্গলে' সর্বত্র তিনি আমার পাশে আছেন। আমার সব লেখার প্রথম পাঠক তিনি, আবার তার লেখারও প্রথম পাঠক আমি। আমাদের এই বন্ধুবৃত্ত বিষয়ে একটা কথা বলা যায়- ডব্থৎব ড়হব নঁঃ ব্থিৎব হড়ঃ :যব ংধসব. মানবিকতার শর্তে, শ্রেয়বোধের দিক থেকে আমরা সবাই এক, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের চিন্তার প্রক্রিয়া, লেখালেখি বা জীবনযাপনেও ভিন্নতা রয়েছে। এই বৈচিত্র্যের হারমোনিটাই আমাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়েছে। বন্ধুত্বকে এত নিবিড়, এত দৃঢ় করেছে। স্থানিক দূরত্ব যতই থাক, পরস্পরকে আমরা কখনোই মনের আড়াল হতে দিই না।

প্রশ্ন: আপনার পরিবারের প্রসঙ্গ নিয়ে একটু কথা বলি। একদম সাদামাটা প্রশ্নই হবে হয়তো। তারা কীভাবে আপনার বেড়ে ওঠা, লেখালেখিতে প্রভাব রেখেছেন?

উত্তর: আমার ছেলেবেলার যৌথ পরিবারের কথা প্রথমে বলি। আমার জীবনে তার অবদানও কম নয়। সেখানে আমি গায়ে মাটি মাখতে শিখেছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে শিখেছি, গ্রামজীবনকে ভালোবাসতে শিখেছি। আমার বাবা-মা ও অন্য গুরুজনরা কখনও সামনে কোনো দেয়াল তুলে দেননি। বরং উল্টোটাই করেছেন, তারা আমার চারপাশের সব দেয়াল ভেঙে দিয়েছিলেন। আমি রাখালদের সাথে দিনের পর দিন মাঠে কাটিয়েছি, বাবা বা মা কিছুই বলেননি। একটু ভ্রূকুঞ্চনও নয়। যখন বিয়ে করলাম, তখন ত্রাতা হয়ে এলেন আমার প্রয়াতা স্ত্রী। যেটা অনেকেই জানে না, তিনি খুব নির্ভুল বাংলা লিখতে পারতেন। লিখতে বসে কোথাও খেই হারিয়ে ফেললে তিনিই ধরিয়ে দিতেন। আর আমার ভেতরের একাকিত্ব, শিল্প সৃষ্টির সময় আমার ভেতরের যে দহন- সেটা তিনি ছাড়া আর কেউ বুঝতেন না। আমার ওপর রাগ করতেন শুধু একটা সময়েই, যখন আমি কোনো লেখালেখির কাজ না করে অলস সময় পার করতাম। বাড়িতে আড্ডা দিলে কিছু বলতেন না, উল্টো ক্ষণে ক্ষণে চা-শিঙ্গাড়া ইত্যাদি খাদ্যের জোগান দিয়ে সহায়তা করতেন। কখনও নিজেও আড্ডাতে যোগ দিতেন। কিন্তু যখনই আমি কিছু করছি না; রেডিওতে বিবিসির খবর শুনছি কি একটু টিভি দেখছি; অমনি তিনি খুব বিরক্ত হতেন। রাগ করে বলতেন, 'এসব করে সময় নষ্ট করছ কেন? লিখতে বসবে না?'

প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে কখনও কোনো রুটিন মেনে চলেছেন বা মেনে চলার কথা ভেবেছেন?

উত্তর: হ্যাঁ, মানি তো! সকাল ১০টায় লেখার ঘরে ঢুকি। বেলা দুটো কি আড়াইটা পর্যন্ত লেখাপড়ার কাজ করে স্নান-আহার শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত গান শুনি। তার পর একটু হাঁটাহাঁটি করে ৮টার পর আবার এসে লেখার টেবিলে বসলাম। এভাবে চলল ১০টা পর্যন্ত। তারপর খাওয়া আর ঘুম।

প্রশ্ন: হায়াৎ মামুদ একবার আপনাকে 'নিষ্ঠুর তান্ত্রিক' বলে বসেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের মূল্যায়ন কি বেশি একপেশে বলে মনে হয় না?

উত্তর: এ নিয়ে আমি আর কী বা মন্তব্য করতে পারি! সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রবিশংকর বল আমাকে একদিন টেলিফোনে একদম এর উল্টো কথা বলেছিলেন। তার কথা ছিল এমন :'আপনার লেখায় তো আমি কেবল রাগই পাই না, পাই স্নিগ্ধতাও। শুধু বিচ্ছিন্নতা বা নির্লিপ্ত আখ্যানই নয়; পাই মানুষে মানুষে সংযোগের কথাও।' তবে কী, আমি তো খুব আবেগপ্রবণ মানুষ; তাই নিজের কলমে একটা নির্লিপ্ততার আবরণ বসিয়ে রেখেছি। বলতে পার, আমার লেখায় এই নির্লিপ্ত ভাবটা আমি ইচ্ছা করেই বেশি এনেছি। লেখার কোথাও, কোনো লাইনে এই ব্যক্তি 'আমি'কে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়তে দিইনি। অথচ আড়ালে আড়ালে গভীরভাবে লেখার সাথে না জড়িয়ে থাকলে ওই নির্লিপ্ততার আবরণটুকু অর্জন করা যায় না।

ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নারকেলের খোলের মতো। মুশকিল যে, সবাই স্রেফ খোলটাই দেখে। খোলের ভেতরের শাঁসটুকু আবিস্কারে বড়ই অনীহা। নির্লিপ্ততা মানে তো আর আবেগহীনতা নয়। কিন্তু আবেগকে সংযম ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। যেন তা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে না যায়। ভাষার ব্যাপারেও একই রকম সংযম আমার প্রার্থিত। আমি তো সর্বনিম্ন পরিমাণে শব্দ ব্যবহার করে একটি বাক্য লিখতে চাই। কিছুতেই কোনো বিশেষণ বসাতে চাই না। এ ব্যাপারে আমি একটুখানি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের শিষ্য, বলতে পার। তিনি ওইভাবে লিখতেন। কিছুতেই ওভার-স্টেটমেন্টে যেতেন না, আন্ডার-স্টেটমেন্ট করতেন। অথচ লেখার মধ্যে ভায়োলেন্স ও মৃত্যু থই থই করছে।

প্রশ্ন: 'সাবিত্রী উপাখ্যান' উপন্যাসেও তো ভায়োলেন্স প্রচণ্ড পরিমাণে রয়েছে।

উত্তর: সেটা হেমিংওয়ের থেকে একদম আলাদা ধরনের ভায়োলেন্স। ওই বইটা লিখতে গিয়ে আমাকে অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। গোটা আখ্যানকে সামলানো আমার জন্য খুব কঠিন কাজ ছিল।

প্রশ্ন: কোনো বিশেষ লেখা শেষ করতে না পারার বা লিখতে না পারার খেদ আপনার আছে কি?

উত্তর: 'তরলাবালা' উপন্যাসটি এখনও শেষ করতে পারলাম না- এই খেদ আছে। ভেবেছিলাম, এটা শ'পাঁচেক পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস হবে; একশ' পাতা লিখে থেমে আছি। ভারত ভাগ বা বাংলা ভাগ নিয়ে একটি বড় উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। কীভাবে ইতিহাসকে চিরতরে এ ঘটনাটি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, তা নিয়ে লেখার কথা এখনও মাঝে মাঝে ভাবি। লিখতে পারলে তার মধ্যে একটা মহাকাব্যিক স্বভাব বিস্তারের চেষ্টা করতাম। কিন্তু জানি আর হবে না, কোনোদিন লিখতে পারব না সেই স্বপ্নের উপন্যাসটি। একদিকে অন্য অনেক লেখার কাজ পড়ে আছে- আর এর বিষয়কে আমি কতটুকু নির্লিপ্ততার সঙ্গে ধারণ করতে পারব, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। তাও এর ভাবনা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওই যে বলে না- ধন্য আশা কুহকিনী! আশার কুহক এখনও আমার পিছু ছাড়েনি।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com