
মিয়ানমার
জান্তার সংকটে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. দেলোয়ার হোসেন

মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে দেশটির যে কোনো পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, মিয়ানমারে ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটির পরিস্থিতি উত্তাল। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষের অব্যাহত ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছেই। পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা আমরা বুঝতে পারি, ৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাহায্যবিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথসের বক্তব্যের মাধ্যমে। মিয়ানমারের মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে তিনি সতর্ক করেছেন। সেখানে ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং পতনের মুখে থাকা অর্থনীতির কারণে ৩০ লাখ মানুষের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার প্রয়োজন। বলাবাহুল্য, সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল মিয়ানমার নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে বলেও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জান্তা সেনা জড়ো করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাজ্য। এমনকি ঘটনাটিকে চার বছর আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনে সংঘটিত নৃশংস কার্যকলাপের প্রতিফলন বলেও উল্লেখ করা হয়। এর আগেও মিয়ানমারকে কয়েক দফায় সতর্ক করে জাতিসংঘ।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সব চেষ্টা করছে। সেনা অভ্যুত্থানের সময় তারা মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি নেতা অং সান সু চিকে কারান্তরীণ করে। অথচ সু চি এবং তার দল গত বছরের নির্বাচনে মিয়ানমারে ব্যাপক ভোটে জয়লাভ করেন। মিয়ানমার দীর্ঘকাল সেনা শাসনের অধীনে থাকলেও এবার আমরা দেখেছি সেখানকার গণতন্ত্রকামী মানুষ সামরিক শাসন সহজে মেনে নিচ্ছে না। মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে ধারাবাহিক এক প্রচণ্ড ক্ষোভ স্পষ্ট। তারা রাজপথে আন্দোলন করছে। গুলি করেও আন্দোলনকারীদের দমানো যাচ্ছে না। এর ফলে সামরিক জান্তার একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের যে স্বপ্ন ছিল, সেখানে জনগণ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেখানে আন্দোলনে এগারো শতাধিক বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছেন। বলাবাহুল্য, কেবল অভ্যন্তরীণভাবেই মিয়ানমারের জান্তা সরকার বাধার মুখে পড়ছে না, একই সঙ্গে বহির্বিশ্ব থেকেও বহুমুখী চাপ দেশটির ওপর বাড়ছে।
এ ক্ষেত্রে আসিয়ানের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। গত মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক এ জোটের সম্মেলনে মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে বৈঠক থেকে বাদ দেওয়া হয়। ছয় মাস আগে শান্তি স্থাপনে মিয়ানমার যে রোডম্যাপে সম্মতি দিয়েছিল, তা উপেক্ষা করায় হ্লাইংকে আসিয়ানের বৈঠক থেকে বাদ দেওয়া হয়। আসিয়ানের পাঁচ দফা প্রস্তাব উপেক্ষা করায় মিয়ানমারের জান্তার তীব্র সমালোচনা করেন আসিয়ান নেতারা। এর আগে ১৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের কারণে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়। বলাবাহুল্য, মিয়ানমার ৭০ বছরের ইতিহাসে এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়নি। সেখানে এত অধিকসংখ্যক বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতারা সেনা শাসনের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছেন, যা অভূতপূর্ব। এমনকি মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী ঐক্য সরকার বা ছায়া সরকার বা এনইউজি ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান পাল্টিয়েছে।
মিয়ানমারের ঐক্য সরকার (এনইউজি) দেশটির সেনা শাসনের বিরুদ্ধে ৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেখানে এনইউজি সামরিক জান্তার বিপরীতে একটি পুলিশ বাহিনী গঠনে কাজ করছে, যাকে বলা হয় সিডিএম পিপলস পুলিশ। এনইউজে গঠিত বিশেষ কমিটি সিডিএম পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সমর্থনে কাজ করছে। জান্তাবিরোধী শক্তি যেমন যুদ্ধ করছে, তেমনি অন্যান্য লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছে। এক তথ্য অনুযায়ী, মাসখানেকের মধ্যে তারা সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত মাইটেল টেলিকম কোম্পানির ১২০ টেলিকম টাওয়ার ধ্বংস করেছে, তাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০.৩ মিলিয়ন ডলার।
এটা ইতিবাচক বিষয় যে, মিয়ানমারের ঐক্য সরকার (এনইউজি) আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে। গত মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মিয়ানমারের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে দেশটির ছায়া সরকার এবং তার সংসদীয় কমিটিকে সমর্থনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পেছনে সংগঠনগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনকারী আন্তর্জাতিক আইন সভা হিসেবে তারা এ সমর্থন দেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হামলার ঘটনাকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা দেশটির ধর্মীয় নেতাদের আটক-গ্রেপ্তারেরও নিন্দা জানায়। এর আগে ফ্রান্সের সিনেট মিয়ানমারের ছায়া সরকারকে সমর্থন দেয়। এমনকি অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনইউজির নেতারা বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এনইউজির দুই প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সুলিভান মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেন। তারা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান প্রচেষ্টা নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি দেশটির সেনাবাহিনীর নৃশংস সহিংসতার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভ্যুত্থানের জন্য জবাবদিহির প্রচার চালিয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, মিয়ানমারে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সামরিক সরকারকে এখন পর্যন্ত কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে মিয়ানমারের আসনটি ফাঁকা ছিল।
মিয়ানমারের ছায়া সরকারের আরেকটি বিজয় হলো, দেশটির নির্বাচিত সাবেক স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিয়াও মোয়ে তুনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর সেখানকার সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে সর্বোচ্চ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান মোয়ে তুন। তার বক্তব্যের জেরে কিয়াও মোয়ে তুনকে দেশটির সেনা শাসক বরখাস্ত করে। পরে মিয়ানমার আরেকজনকে জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে কিয়াও মোয়ে তুন আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়ে জাতিসংঘে পদস্থ হয়েছেন। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমার জান্তা সরকার এবং এনইউজি উভয়ের কোনো প্রতিনিধিকেই বক্তৃতা দিতে দেওয়া যাবে না।
তার মানে এটা স্পষ্ট, মিয়ানমারের সেনা শাসন দেশে এবং দেশের বাইরে উভয় দিক থেকেই গভীর সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে, মিয়ানমারে সেনা শাসনের নিপীড়নের কারণে সেখানে নিজেদের ভেতরকার যুদ্ধ স্পষ্ট। বলাবাহুল্য, এই সেনা শাসন দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অধিকার হরণ করেছে। বিশেষভাবে, তারা রোহিঙ্গাদের হত্যা, গণহত্যাসহ জাতিগত নিধনের চেষ্টা করেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে কিছু সামরিক নেতা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পরই বিশ্বকে দেখিয়েছে, তারা নিজেদের ক্ষমতার জন্য নির্বিচারে নিজেদের নাগরিকদেরই হত্যা করতে পারে।
তারপরও ১৯৬২ সাল থেকে টানা প্রায় পঞ্চাশ বছরের সমরিক শাসনের পর যে দেশটি গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই দেশটির পুনরায় উল্টো দিকে ধাবিত হওয়া যে বিশ্ববাসী ভালোভাবে নেয়নি, তা দেশ-বিদেশের বিরোধিতায়ই স্পষ্ট। এ পরিস্থিতিতে সেখানে সামরিক বাহিনীর স্বপ্ন পূরণ হবে বলে মনে হয় না।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যেভাবে অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃচাপে পিষ্ট তার ইতিবাচক দিক স্পষ্ট। সেখানে সামরিক শাসন বিদায় নিলে মিয়ানমারের ঐক্য সরকার (এনইউজি) বা ছায়া সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে। অং সান সু চি ও তার দল নিশ্চয়ই বুঝতে সক্ষম হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের আচরণ সঠিক ছিল না। একইসঙ্গে যে সামরিক বাহিনীকে মিত্র ভেবে সু চি তাদের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তাদের চরিত্রও স্পষ্ট হয়েছে। ফলে আমরা আশা করতে পারি, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসান হলে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি সমাধানের পথে এগোবে। এদিক থেকে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার সংকটে বাংলাদেশের পরোক্ষ লাভ রয়েছে নিঃসন্দেহে।
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com