হাতি খুঁজছে নতুন পথ

চলাচলের ১৫ পয়েন্টে 'ডেথ জোন'

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২১ । ০১:৪০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

পুরোনো পথে বাধা তৈরি হওয়ায় নতুন রুটে হাতির চলাচল- ফাইল ছবি

বাঁচার জন্য চলাচলের নতুন পথ খুঁজছে হাতি। চুনতি অভয়ারণ্যের অর্ধশত হাতি এত দিন চলাফেরা করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের ১২টি করিডোর দিয়ে। কিন্তু সম্প্রতি এসব হাতির একাংশ চলাচলের জন্য বেছে নিয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার মহাদেবপুর হয়ে বরুমছড়ার পাশ দিয়ে বাঁশখালীর নতুন পথ। আরেকটি অংশ পুরানগর-দোহাজারীর লালুতিয়া-গড়দুয়ারা হয়ে আসছে বোয়ালখালীর পাহাড়ে।

কিন্তু কেন নতুন পথ বেছে নিতে হচ্ছে চুনতির হাতিদের? এর পেছনে রয়েছে মূলত তিনটি কারণ। প্রথমত. পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ১৯৩ কিলোমিটার সীমান্তপথে ভয়ংকর মাইন পুঁতেছে মিয়ানমার। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশে হাতি চলাচলের পথে বসেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তৃতীয়ত. নতুন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন যাচ্ছে হাতি চলাচলের ২১টি পয়েন্টের ওপর দিয়ে। এসব কারণে চলার পথে বাধা পেয়ে লোকালয়ে চলে আসছে হাতির দল। মৃত্যুফাঁদে হারাচ্ছে প্রাণ। বন বিভাগের হিসাবে 'ডেথ জোন' হয়ে ওঠা এমন স্পট রয়েছে ১৫টি।

চলাচলের জন্য বেছে নেওয়া নতুন রুটে হাতিদের যাতে কোনো বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য ৫০টি 'বিশেষ উদ্ধার টিম' গঠন করছে বন বিভাগ। এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে ২৭টি। প্রতিটি টিমে সদস্য রয়েছেন ১০ জন। হাতি লোকালয়ে এলে বিশেষ কৌশলে তাকে আবার বনে ফিরিয়ে নিতে কাজ করবেন এসব টিমের সদস্যরা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) রফিকুল ইসলাম চৌধুরী এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, এসব টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। অচিরেই আরও ২৩টি টিম গঠন করা হবে। এ টিমের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে আইইউসিএনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমীন চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে চলাচল করা হাতিরা ভীষণ বিপদের মধ্যে আছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন এ বিপদ আরও বাড়াবে। কারণ, এই রেললাইন যাচ্ছে সংরক্ষিত বনের এমন বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে, যেগুলো দিয়ে হাতিরা নিয়মিত চলাচল করে। এর আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে হাতির চলাচল সংকুচিত ও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণে হাতি লোকালয়ে চলে আসছে, চলাচলের নতুন রুট খুঁজছে।'

হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার। তিনি বলেন, 'একটি হাতি একবার হাঁটতে শুরু করলে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার হেঁটে থাকে। এটা তাদের অভ্যাস। কিন্তু মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখায় এখন আর সেদিকে হাতির দল যেতে পারছে না। আবার বাংলাদেশেও দেখা দিয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। বাধ্য হয়ে হাতিরা নতুন করিডোর খুঁজছে। কিছু হাতি চট্টগ্রামের আনোয়ারায় নতুন করিডোরে আসছে। বোয়ালখালীর দিকে আরেকটি বিকল্প পথ তৈরি করতে চাইছে চুনতি অভয়ারণ্যের হাতিরা।' হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসনকে আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

হাতি হত্যার ঘটনা বেশি ১৫ পয়েন্টে :মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত আছে কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায়। চুনতি অভয়ারণ্যের হাতি দেশের এই তিন জেলার পাশাপাশি চলাচল করে মিয়ানমারেও। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে আছে হাতির তিনটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে- উখিয়া-ঘুনধুম, তুলাবাগান-পাথেরছড়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে হাতি ব্যবহার করে পাঁচটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে- গমারিয়াঘোনা-রাজঘাট, তুলাতুলি-বিটঘর, ঘণ্টাখালী-মেধা কচ্ছপিয়া, খাসিয়াখালী-চাইরাখালী ও খাসিয়াখালী-মানিকপুর। চুনতি অভয়ারণ্যের চট্টগ্রাম অঞ্চলে আছে হাতির চারটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে- চুনতি-সাতঘর, লালুতিয়া-গড়দুয়ারা, সুখবিলাস-কোদালা ও নারিচ্ছা-কোদালা।

এসব করিডোরে হাতির দল এত দিন নির্বিঘ্নেই চলাচল করত। কিন্তু রেললাইন প্রকল্প হাতির এ পথে ডেকে এনেছে বিপদ। এদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৫টি পয়েন্টে গত পাঁচ বছরে হাতি হত্যার ঘটনা ঘটছে বেশি। এগুলো হলো- বাঁশখালীর বৈলছড়ি ও অইব্যারখীল বনাঞ্চল, চকরিয়ার ফুলছড়ির রাজঘাট, দুর্গম পান্ডাছড়ি, কাইস্যারঘোনা ও গোয়ালিয়া পালং, ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনা, উখিয়া, টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লামার ফাঁসিয়াখালীর কুমারী ও ফাঁসিয়াখালী।

দোহাজারী-কক্সবাজারে নতুন বিপদ :দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধা কচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে প্রায় ২৭ কিলোমিটার রেলপথ বসানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার জানান, হাতির চলাচলের পথ শনাক্ত করার জন্য তিনটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসন্ত ও শরৎকালে দুটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় তিনটি বনাঞ্চলে ২১টি স্থানে হাতির আবাসস্থল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৩টি স্থান চুনতিতে, সাতটি ফাঁসিয়াখালীতে এবং একটি মেধা কচ্ছপিয়ায়। চুনতিতে ১১টি, ফাঁসিয়াখালীতে সাতটি ও মেধা কচ্ছপিয়াতে দুটি ক্যামেরা বসানো হয়। সাত মাস ধরে এসব ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারে রেললাইন নেওয়ার পথে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে পড়বে ১৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ১০ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং মেধা কচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কে রেললাইন পড়বে দশমিক ৯ কিলোমিটার। এ তিনটি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতি চলাচল করে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে।

মিয়ানমারে যেতে না পেরে নতুন রুট :সীমান্তে মিয়ানমার মাইন পুঁতে রাখায় বাঁচার জন্য নতুন পথ খুঁজছে অভয়ারণ্যের হাতিরা। চলাচলের জন্য নতুন করিডোর খুঁজছে তারা। হাতির নতুন করিডোর হলো আনোয়ারার মহাদেবপুর হয়ে ৬ নম্বর রাবখাইন ইউনিয়নের জিবাসী স্কুলের পাশ দিয়ে ফাজিল খাঁর হাট হয়ে খাটখালী খাল অতিক্রম করে ৫ নম্বর বরুমছড়া আনসার চেয়ারম্যানের মৎস্য প্রকল্পের পাশ দিয়ে তৈলার দ্বীপ শঙ্খ নদ পার হয়ে বাঁশখালীর পাহাড়। সম্প্রতি বন্যপ্রাণী প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও একদল গবেষক এ করিডোর শনাক্ত করেন। হাতি গবেষক রায়হান সরকার ধারণা করছেন, আরেকটি নতুন করিডোর হয়ে উঠেছে পুরানগর-দোহাজারীর লালুতিয়া-গড়দুয়ারা হয়ে বোয়ালখালীর পাহাড়। তিনি জানান, মিয়ানমারে প্রবেশ করতে না পেরেই হাতিরা বিকল্প করিডোরে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও।



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com