
স্মরণ
মাকে পড়ে মনে
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২১ । ০১:০১ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবদুল মান্নান
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর রাত ২টা। হঠাৎ চট্টগ্রাম থেকে আমার ছোট ভাইয়ের ফোন। রাত-বিরাতে ফোন এলে ধরে নিই- কোনো একটা দুঃসংবাদ। ঠিক তাই। ছোট ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, 'মা আর নেই!' আমার মমতাময়ী মা আর নেই- তা চিন্তাই করতে পারছি না। সবার বড় সন্তান হিসেবে আমার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা তো সবচেয়ে বেশি। মা অনেক দিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। বয়স ৯৩ বছর। বাড়িতে থাকা আমার ছোট ভাই ও তার পরিবার মাকে দেখাশোনা করছিল। মাঝেমধ্যে আমরা ঢাকা থেকে যাই। শেষের দিকে মা কাউকে তেমন চিনতে পারতেন না। কিন্তু ঠিকই আমাদের ভাইবোনদের চিনতেন। যাহোক, সকালে বাড়ি পৌঁছে দেখি, বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশী। মাকে সাদা চাদরে ঢেকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মায়ের মুখটা দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের দাফন-কাফনের তদারকি শুরু করলাম। বড় ছেলে হলে দায়িত্বটা অনেক বেশি। সব শেষ করতে করতে দিনের আলো নিভু নিভু।
সবার মা-ই বিশ্বের সেরা মা। আমাদের মা তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মার জন্ম সেই ইংরেজ আমলে। মায়ের জন্মের কিছুদিন পর নানির মৃত্যু হয়। মায়ের বড় আমাদের বড় মামা। দু'জনের মাঝে ১৩ বছরের ব্যবধান। মাকে খুব স্নেহ করতেন। মায়ের মুখে শুনেছি, তিনি চাক্তাই খাল আর নানাবাড়ির দীঘিতে জাল দিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় মাকে গামছা অথবা কাপড় দিয়ে পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে মাছ ধরতে যেতেন। মা তা বড় হয়ে শুনেছেন। আমার বাবা আর মা দু'জনেই খুব পরিশ্রমী ছিলেন। তা আমার নিজের চোখে দেখা। আমরা ঠিক অসচ্ছল ছিলাম, বলা যাবে না, তবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মা ছিলেন ভালো গৃহস্থ। হাঁস-মুরগি আর দুধেল গরু পালতেন। বাড়ির পেছনে একটি ছোট সবজির বাগান ছিল। নিজের উদ্যোগে একটি ছোট পুকুর কাটিয়েছিলেন। পুকুর না বলে সেটিকে ডোবা বলাই সমীচীন। তাতে তেলাপিয়া মাছ ছাড়া অন্য কিছু হতো না। হাঁস-মুরগি ডিম পাড়লে তা বিক্রি করে দিতেন। পাড়ার মহিলারা এসে তা মায়ের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। এক টাকায় ১৫-১৬টা ডিম। এখন তা অনেকে বিশ্বাস করবেন না। গরুর দুধ পাড়ায় বিক্রয় হতো এক টাকায় পাঁচ পোয়া, যদিও অন্যরা বিক্রি করত টাকায় দেড় সের। আমাদের দুধের দাম একটু বেশি হওয়ার কারণ- তা ছিল খাঁটি। ভোরবেলায় এই দুধ পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে দিয়ে আসার কাজটি ছিল আমার। খুব ভোরে পাড়ার লুলু মিয়া এসে দুধ দুয়ে দিতেন। গরুপ্রতি মাসে দুই টাকা পারিশ্রমিক। পাড়ায় দুধ দিয়ে এসে স্কুলের বাস ধরতে রওনা দিতাম। মাঝেমধ্যে মা আমাদের দুধ খেতে দিতেন। সপ্তাহে হয়তো একটা ডিম ভেজে ছয় টুকরা করে আমাদের ভাইবোনদের মা খেতে দিতেন। খাওয়া হতো মাটিতে চটের ওপর পিঁড়িতে বসে। সকালের নাশতা দেড় পিস রুটি অথবা মায়ের হাতে বানানো রুটি আর সুজির হালুয়া। খাওয়া নিয়ে কোনো নালিশ করা মা পছন্দ করতেন না।
আমাদের পাড়ায় দু'জন নারী ভোরে পাড়ার ছেলেমেয়েদের লম্বা পাটি বিছিয়ে আরবি পড়াতেন। একজন আমার মা, অন্যজন আমার দূর-সম্পর্কিত দাদি। মায়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা পঞ্চাশের কম ছিল না। সেই আমলে মেয়েদের সাধারণত প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। মা-ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারপরও আমাদের সব ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছে মায়ের কাছে। তিনি তার জন্য একটা ছোট ব্ল্যাকবোর্ডও বানিয়েছিলেন। বোর্ডটা এখনও আছে। স্কুলজীবনের সন্ধ্যা কেটেছে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সামনের মাঠে। ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা। খেলা শেষে পাড়ার মসজিদের পুকুরে কিছু সময় সাঁতার কাটা। যা-ই করি না কেন, মাগরিবের আজানের আগে বাড়ি ফিরতেই হতো। না ফিরলে মায়ের বকুনি তো ছিলই। তবে মায়ের সবচেয়ে বড় শাস্তি ছিল আমার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলা। তেমনটা হলে তা ছিল আমার কাছে চরম শাস্তি। মায়ের মান ভাঙাতে পেছনে পেছনে ঘুরতাম। যখন প্রাইমারি লেভেলে পড়ি; মার স্ট্রোক হয়ে তিনি চলাচলে অক্ষম হয়ে গেলেন। তখন আমার তিন ছোট ভাইবোনের দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ওপর। তাদের গোসল করানো থেকে শুরু করে ফিডারে দুধ বানিয়ে খাওয়ানো- কোনো কিছুই বাদ গেল না। তারপর আমার স্কুল তো আছেই। তখন আমাদের পরিবারে থাকতে এলেন পাড়ার এক ফুফু আর দাদি। তারা নিজ উদ্যোগেই আমাদের পরিবারের সব দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। এমন একটি উদাহরণ বর্তমান সময়ে চিন্তাই করা যায় না। মা সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে প্রায় এক বছর লেগে গেল।
বাবাকে যেসব বায়নার কথা বলতে পারতাম না, তা অকপটে বলতাম মাকে। মা বলতেন বাবাকে। বাবা অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। আমাদের একটা রেশন দোকান ছিল। সিভিল সাপ্লাইয়ের গুদাম থেকে গরুর গাড়িতে চালের বস্তা দোকানে এলে তা নামাতে আড়াই মণের বস্তাপ্রতি পারিশ্রমিক দু'আনা। তা বাঁচাতে প্রায় সময়ই দেখেছি বস্তা নামানোর কাজটা বাবাকে করতে। বাবার ছিল একটি সাইকেল। কোথাও যেতে হলে ওটাই তার একমাত্র বাহন।
মায়ের শৃঙ্খলাবোধ ছিল একেবারে জিরো টলারেন্স। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও একই অবস্থা। প্রতি ঈদের আগে বাড়ির সবকিছু ধুয়ে-মুছে তকতকে রাখতেন। বাড়িটা যেহেতু বাঁশের বেড়ার ছিল, মা ঈদের আগে বেড়াগুলো নিজ হাতে ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলতেন। একটি অলিখিত নিয়ম ছিল- বাড়ি থেকে বের হলেই মাকে বলে যেতে হবে। মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই রেওয়াজ আমি ভাঙিনি। আর চট্টগ্রামের বাইরে গেলে মা বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসতেন। এখনও যখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাই; ভুলে যাই- মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আজ চার বছর। মাকে 'বাইরে যাচ্ছি' বলতে গেলে দেখি মায়ের বিছানাটা খালি। তখন মনের মধ্যে হুহু করে ওঠে। মা, তুমি যেখানে থাকো, ভালো থেকো। আমাদের সবার সব অর্জনের পেছনে তো তুমিই। মা ছাড়া পৃথিবীটা অসম্পূর্ণ মনে হয়।
সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সবার মা-ই বিশ্বের সেরা মা। আমাদের মা তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মার জন্ম সেই ইংরেজ আমলে। মায়ের জন্মের কিছুদিন পর নানির মৃত্যু হয়। মায়ের বড় আমাদের বড় মামা। দু'জনের মাঝে ১৩ বছরের ব্যবধান। মাকে খুব স্নেহ করতেন। মায়ের মুখে শুনেছি, তিনি চাক্তাই খাল আর নানাবাড়ির দীঘিতে জাল দিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় মাকে গামছা অথবা কাপড় দিয়ে পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে মাছ ধরতে যেতেন। মা তা বড় হয়ে শুনেছেন। আমার বাবা আর মা দু'জনেই খুব পরিশ্রমী ছিলেন। তা আমার নিজের চোখে দেখা। আমরা ঠিক অসচ্ছল ছিলাম, বলা যাবে না, তবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মা ছিলেন ভালো গৃহস্থ। হাঁস-মুরগি আর দুধেল গরু পালতেন। বাড়ির পেছনে একটি ছোট সবজির বাগান ছিল। নিজের উদ্যোগে একটি ছোট পুকুর কাটিয়েছিলেন। পুকুর না বলে সেটিকে ডোবা বলাই সমীচীন। তাতে তেলাপিয়া মাছ ছাড়া অন্য কিছু হতো না। হাঁস-মুরগি ডিম পাড়লে তা বিক্রি করে দিতেন। পাড়ার মহিলারা এসে তা মায়ের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। এক টাকায় ১৫-১৬টা ডিম। এখন তা অনেকে বিশ্বাস করবেন না। গরুর দুধ পাড়ায় বিক্রয় হতো এক টাকায় পাঁচ পোয়া, যদিও অন্যরা বিক্রি করত টাকায় দেড় সের। আমাদের দুধের দাম একটু বেশি হওয়ার কারণ- তা ছিল খাঁটি। ভোরবেলায় এই দুধ পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে দিয়ে আসার কাজটি ছিল আমার। খুব ভোরে পাড়ার লুলু মিয়া এসে দুধ দুয়ে দিতেন। গরুপ্রতি মাসে দুই টাকা পারিশ্রমিক। পাড়ায় দুধ দিয়ে এসে স্কুলের বাস ধরতে রওনা দিতাম। মাঝেমধ্যে মা আমাদের দুধ খেতে দিতেন। সপ্তাহে হয়তো একটা ডিম ভেজে ছয় টুকরা করে আমাদের ভাইবোনদের মা খেতে দিতেন। খাওয়া হতো মাটিতে চটের ওপর পিঁড়িতে বসে। সকালের নাশতা দেড় পিস রুটি অথবা মায়ের হাতে বানানো রুটি আর সুজির হালুয়া। খাওয়া নিয়ে কোনো নালিশ করা মা পছন্দ করতেন না।
আমাদের পাড়ায় দু'জন নারী ভোরে পাড়ার ছেলেমেয়েদের লম্বা পাটি বিছিয়ে আরবি পড়াতেন। একজন আমার মা, অন্যজন আমার দূর-সম্পর্কিত দাদি। মায়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা পঞ্চাশের কম ছিল না। সেই আমলে মেয়েদের সাধারণত প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। মা-ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারপরও আমাদের সব ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছে মায়ের কাছে। তিনি তার জন্য একটা ছোট ব্ল্যাকবোর্ডও বানিয়েছিলেন। বোর্ডটা এখনও আছে। স্কুলজীবনের সন্ধ্যা কেটেছে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সামনের মাঠে। ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা। খেলা শেষে পাড়ার মসজিদের পুকুরে কিছু সময় সাঁতার কাটা। যা-ই করি না কেন, মাগরিবের আজানের আগে বাড়ি ফিরতেই হতো। না ফিরলে মায়ের বকুনি তো ছিলই। তবে মায়ের সবচেয়ে বড় শাস্তি ছিল আমার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলা। তেমনটা হলে তা ছিল আমার কাছে চরম শাস্তি। মায়ের মান ভাঙাতে পেছনে পেছনে ঘুরতাম। যখন প্রাইমারি লেভেলে পড়ি; মার স্ট্রোক হয়ে তিনি চলাচলে অক্ষম হয়ে গেলেন। তখন আমার তিন ছোট ভাইবোনের দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ওপর। তাদের গোসল করানো থেকে শুরু করে ফিডারে দুধ বানিয়ে খাওয়ানো- কোনো কিছুই বাদ গেল না। তারপর আমার স্কুল তো আছেই। তখন আমাদের পরিবারে থাকতে এলেন পাড়ার এক ফুফু আর দাদি। তারা নিজ উদ্যোগেই আমাদের পরিবারের সব দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। এমন একটি উদাহরণ বর্তমান সময়ে চিন্তাই করা যায় না। মা সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে প্রায় এক বছর লেগে গেল।
বাবাকে যেসব বায়নার কথা বলতে পারতাম না, তা অকপটে বলতাম মাকে। মা বলতেন বাবাকে। বাবা অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। আমাদের একটা রেশন দোকান ছিল। সিভিল সাপ্লাইয়ের গুদাম থেকে গরুর গাড়িতে চালের বস্তা দোকানে এলে তা নামাতে আড়াই মণের বস্তাপ্রতি পারিশ্রমিক দু'আনা। তা বাঁচাতে প্রায় সময়ই দেখেছি বস্তা নামানোর কাজটা বাবাকে করতে। বাবার ছিল একটি সাইকেল। কোথাও যেতে হলে ওটাই তার একমাত্র বাহন।
মায়ের শৃঙ্খলাবোধ ছিল একেবারে জিরো টলারেন্স। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও একই অবস্থা। প্রতি ঈদের আগে বাড়ির সবকিছু ধুয়ে-মুছে তকতকে রাখতেন। বাড়িটা যেহেতু বাঁশের বেড়ার ছিল, মা ঈদের আগে বেড়াগুলো নিজ হাতে ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলতেন। একটি অলিখিত নিয়ম ছিল- বাড়ি থেকে বের হলেই মাকে বলে যেতে হবে। মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই রেওয়াজ আমি ভাঙিনি। আর চট্টগ্রামের বাইরে গেলে মা বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসতেন। এখনও যখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাই; ভুলে যাই- মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আজ চার বছর। মাকে 'বাইরে যাচ্ছি' বলতে গেলে দেখি মায়ের বিছানাটা খালি। তখন মনের মধ্যে হুহু করে ওঠে। মা, তুমি যেখানে থাকো, ভালো থেকো। আমাদের সবার সব অর্জনের পেছনে তো তুমিই। মা ছাড়া পৃথিবীটা অসম্পূর্ণ মনে হয়।
সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com