আমার মেয়ের মুখ

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নাসিমা আনিস

গাউছিয়ায় শাড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে আছে মা-মেয়ে, দোকানি শাড়ি খুলে দেখাচ্ছে, মোটামুটি ভিড়, বসার সুযোগ নেই, হঠাৎ মেয়ের আর্তনাদ এবং মেয়ের হাত এক ফর্সা লোকের গালে ছুটে গিয়ে পড়ার দৃশ্য। মা প্রথমটায় হতচকিত হলেও সামলে নিয়ে বললেন,

মারো, আরও মারো, ওকে ছাড়া যাবে না!

তিনজন দোকানদার ছুটে এল লোকটাকে বাঁচাতে। একজন বয়স্ক মহিলা বড় বড় চোখ মেলে মেয়ের কাণ্ড দেখতে থাকলেন, তারপর অস্টম্ফুট উচ্চারণ করলেন, এ যুগের মেয়ে! চারদিকে আরও কিছু দর্শক চোখ জুড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষায়।

এ যুগের মেয়ে- তার অভিনন্দন উক্তি নাকি তিরস্কার বোঝার কোনো উপায় ছিল না। যে তিন দোকানি লোকটাকে উপর্যুপরি কিল-থাপ্পড়ের হাত থেকে বাঁচাতে চাইল তারা আসলে শান্তি চাইছিল, যাতে ক্রেতারা বিরক্ত হয়ে না পালায়। একজন লোকও মেয়ের হয়ে তাকে দুটো চড় মারতে গেল না। শুধু মা গিয়ে লোকটার কলার চেপে ধরতে চাইল আর মুখে বলেই যেতে লাগল,

মার, মেরে হাড্ডি গুঁড়া কর!

যেন পঁচিশ বছর আগে বৃষ্টির দিনে ইডেনের সামনে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটা এইটা। যে বলেছিল,

আহ্‌ এত অনেক জোরে বৃষ্টি, ভিজে যাবে তো, দাঁড়াও না এই ছাতার নিচে, বৃষ্টি থামলেই চলে যেও।

বয়স্ক একটা লোক, বৃষ্টির ফোঁটাও বড় বড়। সে কৃতজ্ঞ কচি মন নিয়ে ছাতাটার নিচে মাথাটা দিয়ে দাঁড়ায়। মনুষ্য জাতি এই পুরুষ শ্রেণির প্রতি তার মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। সামান্য কয়েক মিনিট, তারপর লোকটা যাচ্ছেতাইভাবে বুকের ওপর থাবা দিয়ে হনহন করে চলে গেলে তার সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। মনে হয় পায়ে কে দশ মণ বস্তা বেঁধে দিয়েছে, গলায় ঢুকিয়েছে রোমশ হাত কবজি পর্যন্ত, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বুঝেছিল পুরুষ মানুষ আসলে একপ্রকার হিংস্র জীবের আরেক নাম, এদের বিশ্বাস করলে পৃথিবী অন্ধকার।

মায়েরা জেলা শহর থেকে ঢাকা শহরে যখন মেয়েকে পড়াতে পাঠায়, তখন এসব বিকৃত অসভ্য রুচির লোকগুলোই মাথার ভেতরে সর্বক্ষণ কুটকুট করে ঘিলু খেতে থাকে, হয়তো বাবারও। আর সেই জেলা শহর কতটা নিরাপদ! নিরাপদ নয় মোটেই। স্কুলে যাওয়া-আসা পথ থেকে তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে করা অহরহ ঘটনা। দু'দিন রেখে তারপর খবর পাঠায় অভিভাবকদের। মেয়ে আপনাদের, মেনে নেবেন কি নেবেন- না এই অভিরুচি আপনাদের। তার পরদিন শহরে বোরকা বিক্রি বেড়ে যায়, টেইলার মাস্টাররা নতুন নতুন ডিজাইনের বোরকা বানানোর অর্ডার পায়। কুষ্টিয়ার এনএস রোডে রাতারাতি কয়েকটা বোরকা-হিজাবের দোকান খুলে যায়। আর এই মাহেন্দ্রক্ষণকে পুঁজি করে দলে দলে নারী সম্প্রদায় কারও কারও বাড়ি গিয়ে দিনদুনিয়ার কাজ করার জন্য সদস্য সংগ্রহে পূর্ণোদ্যমে কাজে লেগে পড়ে।

হাউজিংয়ের যে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে করেছিল, তার পরিবার কি মামলা করবে! কীসের মামলা করবে! ধর্ষণ মামলা! কয়দিন পর করবে! বাহাত্তর ঘণ্টা এখানে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে বলে অনুমান করবেন স্বজনরা! নাকি মামলা করা থেকে নিরস্ত্র হবে! যা হওয়ার হয়ে গেছে মামা চেপে যান, মেয়েকে সামলে রাখতে পারেন নাই, বদনাম বাড়ায় লাভ নাই কিংবা অকারণ আইনজীবীদের পয়সা দিবেন, ওদের জেলহাজত কিছুই হবে না ভাই! - ধরতেই পারবে না, পারলেও ওদের প্রভাব সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নাই, বাইর হয়ে আসলে গুষ্টিসুদ্ধা ভেজালে পড়বেন কিন্তু।

রেহানা মরিয়ম নূর দেখে মেয়েরা যখন চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বের হয় তখন সে জানে তার অন্তরাত্মা বৈষম্যের কত গভীর ছাপ বয়ে বেরাচ্ছে। কত গ্লানি সে নিজেকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া থেকে বিরত, কতবার নিজেকে হননের ইচ্ছা তার জেগেছিল! ফলে নিজেকে সেখানে দেখে সে বিহ্বল হয়ে পড়বে- এটাই স্বাভাবিক।

লিঙ্গবৈষম্যের শিক্ষা তো পরিবার দেয়, পরিবারে এই শিক্ষা বেশির ভাগ সময় নারীই দেয়। ফলে দিন দিন তার নিজের মেয়েটি মানুষ থেকে বামনে পরিণত হয়, ছেলেটা পুরুষতন্ত্রের নিয়ামক হিসেবে পরিণত হয় দানবে। এই দানবকে রোখার কেউ নাই, কিছু নাই। কেননা তারা সব কিছু গ্রাস করতে করতে এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।

টুলু আমার বাল্যবন্ধু হলেও দেখাসাক্ষাৎ হয় কম। কিন্তু দেখা হলে কয়েকটা দরজাও সাট সাট করে খুলে দেয়। কিছুদিন আগে বলল, মেয়ে বিয়ে দিব, পাত্র পাচ্ছি না রে। কী ব্যাপার পাত্রদের তো তোর মেয়ের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা! সে বলে, পাই তো, ভালো বলতে যা বুঝিস সে রকম পাত্রই পাই। - তো! - তো হঠাৎ হুজুর হওয়া পাত্র পেয়েছি দুইটা, স্কলার কিন্তু দিব না। - কেন? - শোন, তোকে বুঝতে হবে সচ্ছল ঘরের একটা ছেলে ড্রাম বাজাতে বাজাতে কি ব্যান্ডদলের ভোকাল হওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ চিল্লার দিকে কেন সে হাঁটা দেয়! কি সে গুমোর! - কী গুমোর! - অসুস্থ প্যারেন্টিং, অস্বস্তিকর বয়হুড, জীবনকে ভালোবাসার কোনো বস্তু সে পায়নি পরিবারে। এই না পাওয়াই তাকে না দেখা জগতের প্রেমে পড়ে গেছি বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এবং সে মতো নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে দেখে, আরে লোকের তো বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় এই লেবাসে! এটা খুব অসুস্থ একটা ব্যাপার যেটা বাইরে থেকে তুমি বুঝতেই পারবে না।

আরেক বন্ধুর বাড়ি গেলাম বহুদিন পর, সব ঠিকঠাক কিন্তু আমি তার মন খারাপ ধরতে পারলাম। কারণ শুনে তো আমি আকাশ থেকে পড়ি। নাতিটা নিচের তলায় একটা বাসায় খেলতে যায় বছরের পর বছর। সে বাসায় ওর সমান একটা ছেলে আছে, দু'জনেই এখন থ্রিতে পড়ে একই স্কুলে। কয়েকদিন আগে ছেলেটা মেয়েটাকে বলেছে তুমি প্যান্ট খোল আমি এসব দেখেছি ইউটিউবে, আমার ট্যাবে। নাতনি এসে বলে দিয়েছে দাদিকে। করোনার সময় ওটাই ছিল নাতনির একটু খেলার জায়গা। ঘটনাটা শুনে যে কেউ ভড়কে যাবে। প্রতিটা বাড়িতে হাতে হাতে মোবাইলে ট্যাবে ইউটিউব। অভিভাবকদের কোনো মাথাব্যথা নাই এসব নিয়ে। উন্নত দেশে রীতিমতো নিষেধ আইন আছে শিশুদের এসব ডাটা ডিভাইস দেওয়ার ব্যাপারে। একলা শিশু, বিনোদনহীন শিশু, নিরাপত্তাহীন শিশু এভাবে বড় হচ্ছে বিকৃত রুচি নিয়ে। তৈরি হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

বহু বছর আগে আমার এক আত্মীয়ার স্বামী যিনি এডিসি হিসেবে আমার কর্মক্ষেত্র বেসরকারি কলেজে এসেছিলেন পরীক্ষার নকল রোধে। নকল তখন ভালোই চলত কমবেশি সব জায়গায়। তো তিনি আমার বাসায় বেড়াতে এসে গল্প দিলেন, করুক নকল, নকল করে কতদূর যাবে! এদের দিয়ে কিছু হবে না। করবে তো ব্যবসা বা দোকানদারি। আমাদের ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিব বাইরে এ লেভেলের পর। এ দেশে থাকার কোনো দরকারই নাই। এ দেশে মানুষ থাকে! একজন আমলার এই ধরনের দেশবিদ্বেষ দেখে কত কথাই মনে হয়! শেষ পর্যন্ত দেশে বেসরকারি ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেখানে লেখাপড়া করতে গিয়ে রেপ কেসের আসামিও হলো ছেলে। এই কথাগুলো বলার কারণ এই মানসিকতাকে আমার কূপমণ্ডূকতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি তখন এবং এখনও, সময় পাল্টাচ্ছে, কে দোকানদারি করবে আর কে বিদেশ গিয়ে পড়বে সেসব বলাটা ক্ষমতার দাপট এবং একরকম অভব্যতা। শিল্পপতিদের বেলায়ও এসব কথা খাটে, অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা থাকলে বিদেশ হয়, দেশ হয়, সব নিজের মতো করে ব্যবহার ও অপব্যবহার করা হয়, এই সংস্কৃতিই তো আমাদের!

রেইনট্রি হোটেল মামলা এখন পর্যন্ত আমাদের কী শিখাল! সবাই খালাস পেয়ে গেছে আদালতের রায়ে, বিচারকের বলা বাহাত্তর ঘণ্টার ঘণ্ট এখনও পুরোপুরি ফয়সালা হয় নাই (আইনমন্ত্রী সজাগ আছেন) প্রতিবাদী জনগণ জাগ্রত আছে, তারা পথে নেমেছে, নামবে আরও। সামাজিক বৈষম্য, অনাচারে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, তলানিতে গিয়ে ঠেকলে জেগে ওঠা অনিবার্য।

মেয়েরা বাইরে যাবে কাজ শেষে ঘরে ফিরবে সুস্থভাবে, এটা কি খুব অলৌকিক কিছু চাওয়া! পথেঘাটে, বাসে-ট্রেনে গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার যৌনস্পৃহা কেন জাগে! জাগে কারণ এসব করে করে তারা মজা পেয়ে গেছে, কোনো প্রতিবাদ নাই, কোনো প্রতিরোধ নাই, ধরা পড়লে কোনো বিচার নাই। কুৎসিত বিকৃত রুচির সার্থক প্রয়োগ সে বিনা বাধায় করে যেতে যেতে দানব হয়ে উঠেছে। এমন দানব যে অপরিচিত কি পরিচিত কি বান্ধবী প্রেমিকা স্ত্রী কেউ তাদের হাতে নিরাপদ নয়।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com