
দুই বাঘ শাবকের মৃত্যু
সেই মাছির ঝুঁকিতে চিড়িয়াখানার প্রাণী
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২১ । ০২:২৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
জাহিদুর রহমান

মিরপুর চিড়িয়াখানায় মায়ের সঙ্গে দুর্জয় ও অবন্তিকা। সেটসি ফ্লাই নামের মাছির কামড়ে ট্রিপানোসোমিয়াসিস রোগে দুই শাবকের মৃত্যু হয়েছে- ফাইল ছবি
রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় একসঙ্গে জন্ম নিয়েছিল বেঙ্গল টাইগার টগর ও বেলি জুটির প্রথম শাবক দুর্জয় আর অবন্তিকা। করোনাকালে গত ২৬ মে তাদের জন্মের পর আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের উপস্থিতিতে গত ১৬ আগস্ট চিড়িয়াখানায় তাদের নাম রেখে জন্মনিবন্ধন অনুষ্ঠান করা হয়েছিল বেশ ঘটা করে।
জন্মের প্রায় ছয় মাস পর ২১ নভেম্বর দুর্জয় ও অবন্তিকা চলেও গেল একসঙ্গে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, সেটসি ফ্লাই নামে এক ধরনের মাছির কামড়ে ট্রিপানোসোমিয়াসিস রোগে তারা প্রাণ হারিয়েছে। ২১ নভেম্বর মৃত্যু হলেও এ ঘটনা এতদিন গোপনই ছিল। গত শনিবার রাতে মৃত্যুর কথা জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আব্দুল লতিফ সমকালকে বলেন, ১৭ নভেম্বর সকালে দুর্জয়ের এবং ১৮ নভেম্বর অবন্তিকার অসুস্থতা ধরা পড়ে। দুটি শাবকই পেছনের পা দিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন) পরিচালক ডা. নিলুফা বেগমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। তাদের পরামর্শে শাবক দুটিকে আইসোলেশন রুমে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই দিনই রক্ত সংগ্রহ করে সরকারের কেন্দ্রীয় রোগ গবেষণাগার (সিডিআইএল) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইটোলজি বিভাগে পাঠানো হয়।
১৯ নভেম্বর পাওয়া রিপোর্টে দেখা যায়, তাদের শরীরে ট্রিপানোসোমিয়াসিসের জীবাণু রয়েছে। ট্রিপানোসোমিয়াসিস এক ধরনের বিশেষ মাছি বা পোকাবাহিত প্রাণঘাতী রোগ।
এই জীবাণুর কোনো ভ্যাকসিন নেই। রিপোর্ট আসার পর চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (সিসিইউ) রেখে দুর্জয়কে দুটি ডোজ এবং অবন্তিকাকে একটি ডোজ দেওয়া হয়। কিন্তু শত চেষ্টার পরও ২০ নভেম্বর রাত আড়াইটায় দুর্জয় এবং ২১ নভেম্বর সকালে অবন্তিকা মারা যায়। মৃত্যুর পর তাদের ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা পরীক্ষা করা হয়েছে। দুর্জয় ও অবন্তিকার মা-বাবা এখনও সুস্থ। তাদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।
এর আগে ১৯৯০ সালে জাতীয় চিড়িয়াখানায় এ রোগে চারটি এবং ২০১৬ সালে দুটি বাঘ শাবক মারা যায়। প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বহিরাগত জটিল রোগ। দক্ষিণ আফ্রিকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতের ওডিশার নন্দনকানন চিড়িয়াখানায় ট্রিপানোসোমিয়াসিস রোগে ১১টি বাঘ মারা যায়। মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় এ রোগের অস্তিত্ব ধরা পড়ায় এখানকার অন্য বাঘ, সিংহ, জেব্রা, জিরাফসহ হরিণজাতীয় প্রাণীতেও এই জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই এটি প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আব্দুল লতিফ বলেন, ট্রিপানোসোমিয়াসিস রোগে এখন পর্যন্ত শুধু বাঘ মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে অন্য প্রাণীদের কোনো ঝুঁকি নেই। তার পরও সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। তবে চিড়িয়াখানা উন্মুক্ত স্থান হওয়ায় এখানে মশা-মাছি অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে। এটি একটি বড় সমস্যা।
দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে ডা. লতিফ বলেন, সীমিত সাধ্য ও দক্ষতা দিয়ে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। চিকিৎসাব্যবস্থা আরও সহজ করার ব্যাপারেও ভাবা হচ্ছে। নতুন মাস্টারপ্ল্যানে প্রাণীর চিকিৎসার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ চিকিৎসক, ল্যাবরেটরি, আইসিইউ-সিসিইউসহ বিভিন্ন কিছু সংযোজন করে আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল স্থাপন করার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশের ঝুঁকি আছে কিনা, থাকলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নে ডা. আব্দুল লতিফ বলেন, মানুষের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, অদক্ষ চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা ও অযত্ন-অবহেলাই এই মৃত্যুর কারণ। বাঘ শাবক দুটিকে হাসপাতালে না নিয়ে চিড়িয়াখানার খাঁচায় রেখে চিকিৎসা দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, বনের মধ্যে কয়টি বাচ্চা নিল, কয়টি মারা গেল, কেউ তার হিসাব রাখে না। এখানে চোখের সামনে হলেই সমস্যা! যিনি দায়িত্ব পালন করেন, দায়ভার তারই ঘাড়ে যায়। যিনি দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন, তিনি বড় বড় কথা বলতে পারেন এবং জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেন- এটি পীড়াদায়ক। জাতীয় চিড়িয়াখানার সঙ্গে দেশের মানসম্মান জড়িত। এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়েই আমরা কাজ করছি। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ছুটি নেই। বাঘ শাবকের মৃত্যুর পর আমি তিন দিন ধরে ঠিকমতো খাবার খেতে পারছি না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রাইপানোসোমিয়াসিস রোগে আক্রান্ত হলে রক্তের হিমোগ্লোবিন নষ্ট হয়। এতে প্রাণীর দেহে দ্রুত রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। খাবারদাবার কমে যায়। পাশাপাশি পক্ষাঘাত দেখা দেয়।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গাজী আজমত জানান, ট্রিপানোসোমিয়াসিস এখন খুবই সাধারণ রোগ। এই রোগের চিকিৎসা আছে। আমেরিকা-ভারতসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলেই এ রোগের ওষুধ পাওয়া যাবে। কিন্তু চিড়িয়াখানার চিকিৎসকদের এ-সংক্রান্ত জ্ঞান নেই। দক্ষ চিকিৎসক ও আধুনিক হাসপাতাল তৈরি না করলে এভাবে প্রাণী মারা যাবে।
তিনি প্রশ্ন করেন, আমাদের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ট্রিপানোসোমিয়াসিস রোগটি সম্পূর্ণ অপরিচিত নয়। তাহলে এই রোগ থেকে চিড়িয়াখানার বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? কোনো প্রাণী এ রোগে আক্রান্ত হলে যথাসময়ে যথাযথভাবে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই কেন?- এসব বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ নেই।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা সমকালকে বলেন, ট্রিপানোসোমিয়াসিস প্রতিরোধমূলক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিষয়ক শিক্ষক ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ রোগের উৎস জানার চেষ্টা করছি। আরও কী করা যায়, সে জন্যও চিন্তা করছি। বিদেশের চিড়িয়াখানার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com