
লিবিয়ায় যেভাবে ‘দাস’ হয়ে উঠছেন বাংলাদেশিরা
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২১ । ১২:৩৩ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২১ । ১২:৩৩
অনলাইন ডেস্ক

ছবি-বিবিসি
ইতালির পালেরমো শহরে একটি চেয়ারে বসে অস্বস্তি নিয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েছিলেন এক তরুণ।
ধরা যাক বাংলাদেশি এই তরুণের নাম আলী। তার ঝুঁকিপূর্ণ জীবনকে আরও ঝুঁকিতে না ফেলতে তার আসল নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ১৯ বছর বয়সে আলীর এই ঝুঁকির জীবন শুরু হয়েছিল। ‘দালালরা’ কীভাবে কৌশলে তাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রাখে, কীভাবে সেখান থেকে তিনি পালিয়েছেন, সেই কাহিনী তিনি বলেছেন সংবাদমাধ্যম বিবিসির কাছে।
ভালো জীবনের হাতছানিতে আলীর মত অনেক বাংলাদেশি তরুণ লিবিয়া হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এপথে যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। আলীর সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
আলীকে বিদেশে নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল এক দালাল বা ট্রাভেল এজেন্ট। মূলত তারা মানবপাচারকারী। এরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কৌশলি প্রচারণায় তরুণদের প্রলুব্ধ করে।
সিসিলিতে থাকা আরও একজন বাংলাদেশি তরুণ জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে ১৫ বছর বয়সে কীভাবে তিনি দালালের খপ্পরে পড়ে দেশ ছেড়েছিলেন।
তিনি বলেন, আমার পরিবার চেয়েছিল আমি বিদেশে যাই, কিন্তু বয়স কম হওয়ায় পারিনি। ভুয়া পাসপোর্ট করার জন্য তাই দালালকে টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার। পরে আমার বয়স পাসপোর্টে দেখানো হয় ২১ বছর।
আলীর সঙ্গে যে দালালের পরিচয় হয়েছিল, সে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়মিত লিবিয়া যাওয়ার প্ররোচণা দিত। এমনকি তাকে বাড়িতে রাতের বেলা দাওয়াত করেও খাওয়াত।
বাংলাদেশে থাকার সময় ঢাকার কাছে একটি শহরতলীতে কয়েক বছর একটি প্রসাধনীর দোকানে কাজ করত সে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, আলীর মতে এমন সুবিধাবঞ্চিত যারা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দালালরা তাদের সেই স্বপ্নকেই পুঁজি করে।
লিবিয়ার উদ্দেশে যারা পাড়ি জমান, তাদের মধ্যে খুব কমই গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত এই দেশটি সম্পর্কে জানেন। যারা সেখানে পাচার হয়ে যান, তারা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বন্দি হন দাসত্বের শৃঙ্খলে।
আলী বলেন, লিবিয়া সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। দালালরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, লিবিয়ার কারখানায় কাজ করে মাসে ৫০০ ডলার আয় করা যাবে। পরে অবশ্য আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
আলীর বাবা-মা দালালদের বলেছিল, লিবিয়া যাওয়ার খরচ তারা যোগাতে পারবেন না। কিন্তু তাদের তিনটি বড় আকারের গরু দেখে দালালরা সেখান থেকে একটি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করার বুদ্ধি দেয়।
ঢাকা থেকে বাসে যাত্রা শুরু করে ভারতের কলকাতায় পৌঁছানোর পর উড়োজাহাজে কয়েক দফায় মুম্বাই, দুবাই এবং কায়রো হয়ে লিবিয়া পৌঁছাতে আলীর সময় লেগেছিল এক সপ্তাহ। লিবিয়ার বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আলীর মনে হয়েছিল নিরাপত্তা আর পুলিশবিহীন বিশৃঙ্খল একটি জায়গা সেটা।
দালালের লোকেরা তাকে সেখান থেকে দ্রুত একটি বন্দিশালায় নিয়ে যায়। এরপর তার কাছে থাকা সব টাকা কেড়ে নেয়। এরপর তাকে মুক্তিপণের জন্য সেখানে আটকে রাখে।
তাকে মুক্ত করার জন্য আলীর বাবা-মাকে শেষ গরুটিও বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
আলী বলেছেন, বন্দিশালায় ছোট একটি কক্ষে তার সঙ্গে আরও ১৫ বাংলাদেশি ছিলেন। যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারত না তাদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হত না এবং মারধর করা হত।
তিনি বলেন, তারা আমার সামনে একজনকে পিটিয়েছিল। এক সময় তার উরুসন্ধি থেকে রক্তপাত শুরু হয়। তারা ওই ব্যক্তিকে কোনো চিকিৎসা দেয়নি, হাসপাতালেও নেয়নি।
বিবিসি লিখেছে, লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে আটক বাংলাদেশিদের অবস্থা গত কয়েক বছরে আরও খারাপ হয়েছে।
২০২০ সালের মে মাসে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির কাছে মিজদাহ শহরে একটি গুদামে ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ২৬ জন ছিলেন বাংলাদেশের।
ওই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাদের পরিবার মুক্তিপণের অর্থ দিতে পারেনি।
অবশেষে বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আলী বেনগাজিতে পাচারকারীদের একটি পানি বোতলজাত করার কারখানায় কাজ পান। পরে ত্রিপোলিতে গিয়ে একটি টালি কারখানায় কাজ করতে হয়।
সেখানে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া দুর্বিষহ এক পরিবেশে ছিলেন তিনি। আলীর মত এমন ২০ হাজার বাংলাদেশি লিবিয়ায় রয়েছেন বলে সম্প্রতি এক হিসাব পাওয়া গেছে।
আলী বলেন, কাজ থামালেই আমাদের মারধর করা হত।
টালি কারখানার মালিক কিশোর বয়সীদের বাসায় তালা দিয়ে আটকে রাখতেন জানিয়ে তিনি বলেন, মালিক আমাদের কাজে নিয়ে যেতেন এবং কাজ শেষ হলে বাসায় ফিরিয়ে নিতেন। আমাদের নজরদারির জন্য দুইজন পাহারাদার ছিলেন। কাজের জন্য আমাদের কোনো মজুরি দেওয়া হত না এবং পর্যাপ্ত খাবারও পেতাম না। যে কারণে আমরা পালিয়ে যেতে চাইতাম, আমাদের একজন পালানোর চেষ্টার সময় তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলে।
কয়েক দফা পালানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর লিবিয়ার এক ব্যক্তি আলীকে মসজিদে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন। তবে তার মনে হয়েছিল, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছাতে তাকে আবারও পাচারকারীদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হবে।
আলীর বাবা-মাকে আবারও অর্থ যোগাড় করতে হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ইতালি পর্যন্ত দুর্ভোগের এই যাত্রায় সব মিলিয়ে তার পরিবারকে প্রায় চার হাজার ডলার যোগাড় করতে হয়েছে। সেজন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিতে হয়েছে।
গত বছর জুলাই মাসে ডিঙি নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ৭৯ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর সঙ্গে আরও একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় আলীকে।
তিনি বলেন, দুইদিন আমরা সাগরের পানি ছাড়া কিছু দেখিনি, কোনো কিনারা নাই। এক পর্যায়ে আমরা দূরে দুটি হাঙর দেখতে পাই। কয়েকজন বলে, তারা আমাদের খেতে আসছে। ভাবলাম, আমরা শেষ। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করে ল্যাম্পেদুসা দ্বীপে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পৌঁছান সিসিলি।
আলী এখন সিসিলির প্রধান শহর পালেরমোতে অভিবাসীদের একটি শিবিরে থাকেন। নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া এবং সেনেগাল থেকে আসা তরুণ অভিবাসীরাও রয়েছেন সেখানে।
তিনি জানান, লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের নিজেদের মধ্যে কিংবা অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পাচারকারীদের ওই বন্দিশালায় বিভিন্ন দেশের মানুষকে আলাদা আলাদা রাখা হত।
আলী এখন ইতালিতে কাজের অস্থায়ী অনুমতি পেয়েছেন। কিন্তু আশ্রয় চেয়ে করা তার আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন।
পালেরমোয় বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন আলী। সেখানে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ নিয়েছেন।
সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করে তিনি মাসে পান ৮৭০ ডলার, যা সিসিলিয়ানদের আয়ের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। ওই আয়ের মধ্যে ৫৭০ ডলার তিনি দেশে বাবা-মাকে পাঠাতে পারেন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com