
'হাউস পার্টি'র ফাঁদ ছাত্রলীগ নেতার
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২১ । ০২:৩৭ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ প্রতিনিধি

গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর সরকারের ইয়াবা চক্রের খোঁজ নিতে গিয়ে 'হাউস পার্টি'র আড়ালে লোকজনকে ফাঁসানোর একটি সংঘবদ্ধ চক্রেরও তথ্য পাওয়া গেছে। গাজীপুর ছাড়াও আশুলিয়া, ময়মনসিংহ ও ঢাকার উত্তরা এলাকায় তাদের আস্তানা রয়েছে। নাচ, গানের পার্টির আড়ালে এই চক্রের নারী সদস্যদের কক্সবাজার থেকে ইয়াবা বহন করার কাজে ব্যবহার করা হতো। জাহাঙ্গীর ছাড়াও তার আরেক ভাই আলমগীর সরকার এর সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। দুই ভাইকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। এ ছাড়া জব্দ করা হবে জাহাঙ্গীরের দামি গাড়িও। অবৈধ অর্থ দিয়ে গাড়ি, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, জাহাঙ্গীরের একটি দুষ্ট চক্রের খোঁজ পাওয়া গেছে। নারীদের ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলার তথ্যও মিলেছে। আবার কক্সবাজার থেকে ইয়াবা স্থানান্তরে তার ভাড়া করা লোকজন ছিল। তাদের ইয়াবা চক্রে আরও অনেকেই ছিল।
১৮ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগ এলাকায় প্রাইভেটকারের ভেতরে ২০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয় জাহাঙ্গীরের প্রাইভেটকার চালকসহ তার চার সহযোগীকে। এর পরই বেরিয়ে আসে ওই চালানটি ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের। এরই মধ্যে তাকে আসামি করে মামলা করা হয়। ইয়াবা চক্রে জড়িত থাকায় সংগঠন থেকে জাহাঙ্গীরকে বহিস্কার করা হয়েছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় জাহাঙ্গীরের শ্রীপুর এলাকার এমসি বাজারে '৯৯' নামে একটি দোকান ছিল। মূলত দোকানের আড়ালে ইয়াবা কেনাবেচা করা হতো। দোকানের কর্মীদেরও ইয়াবা কারবারে ব্যবহার করতেন তিনি। বিভিন্ন সময় জাহাঙ্গীরের ওই দোকানের ম্যানেজার আরিফুল ইসলামসহ একাধিক কর্মী মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়। তখন জাহাঙ্গীর যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করতেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ফাঁসাতে তার কর্মীদের মাদকসহ গ্রেপ্তার করাচ্ছে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরের ভাই আলমগীরের ওই এলাকায় হার্ডওয়্যারের দোকান রয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে আলমগীরের এক দোকান কর্মচারীও অবৈধ মদের চালানসহ আটক হয়।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, শুরুতে জাহাঙ্গীরের এই সিন্ডিকেটে একজন নারীর নাম জানা গেলেও পরে আরও অন্তত পাঁচজনের নাম বেরিয়ে আসে। সব মিলিয়ে পুরুষ-নারী মিলে তার চক্রের গতকাল পর্যন্ত ১৮ জনের নাম পেয়েছে পুলিশ। এরা মূলত জাহাঙ্গীরের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় তাদের ভাড়া বাসায় হাউস পার্টির আয়োজন করত। কখনও আবার কক্সবাজার থেকে মাদকের চালান আনত। এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে আছে এনামুল মুন্সী, পিস্তল মাসুদ, মো. আশাদ, রুবেল ইসলাম, রাকিবুল হাসান, ফিরোজ, সূর্য বর্মণ শান্ত, রনি আহম্মেদ, হৃদয়, জোনাকি, রুবেল খান নীরব ও মহসিন।
এলাকাবাসী জানান, রাজনীতিতে জাহাঙ্গীরের উত্থান ও অল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ায় অনেকে বিস্মিত হন। করোনাকালে হঠাৎ শ্রীপুর এলাকায় তার সোয়েটার ফ্যাক্টরি তৈরি করতে দেখেও কেউ কেউ হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। শ্রীপুরের এমসি বাজার ইজারা ও অন্যান্য ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলাকায় কারও কারও সঙ্গে জাহাঙ্গীরের প্রকাশ্য বিরোধ ছিল। একসময় এমসি বাজারের ইজারা পেতেন শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম মোড়ল। সর্বশেষ তাকে হটিয়ে এই ইজারা পান জাহাঙ্গীর। বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শফিক ও জাহাঙ্গীরের লোকজনের মধ্যে চলতি বছর সংঘর্ষও হয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি মামলা করে। এ ছাড়া শ্রীপুরের সিসিডিবি এলাকায় একটি বড় কোম্পানির মুরগির ফার্ম রয়েছে। ওই ফার্মের মুরগির 'গিলা-কলিজার' ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও তেলিহাটী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল বাতেন সরকারের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিরোধ। অভিযোগ আছে, জাহাঙ্গীরের নানা অনৈতিক কারবারে প্রশ্রয় দিতেন গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম রবিন। দু'জনের বাড়ি একই এলাকায় হওয়ায় তাদের মধ্যে আগে থেকেই এক ধরনের সখ্য ছিল।
জাহিদুল ইসলাম রবিন সমকালকে বলেন, জাহাঙ্গীরের কথাবার্তা ও চালচলনে কখনও মনে হয়নি সে এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। আর তাকে কোনো ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একই এলাকা ও একই কমিটির নেতা হওয়ায় যতটুকু সম্পর্ক থাকার ঠিক তাই ছিল।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com