
তবুও সরকারি গাড়িতে চোখ আমলাদের
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২১ । ০২:৩৮ | প্রিন্ট সংস্করণ
অমিতোষ পাল

ছবি: ফাইল
বিনা সুদে ঋণের টাকায় বাড়িতে ঢুকেছে দামি গাড়ি। সেই গাড়িতে চড়ছেন স্ত্রী-সন্তান। কেউ কেউ আবার সেই ঋণের গাড়ি খাটাচ্ছেন ভাড়ায়। আর নিয়ম ভেঙে কর্মস্থল থেকে সরকারি গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবহার করছেন কর্মকর্তা নিজেই। চালক, জ্বালানিসহ এসব গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করছে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সংশ্নিষ্ট দপ্তর বা সংস্থা। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদের ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ অনিয়মের কারণে মাঠে মারা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে খরচ কমার বদলে উল্টো এ খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের অন্তত দুই হাজার কর্মকর্তা গাড়ি কেনার সুদহীন এই ঋণসুবিধা নিয়ে অনিয়মের পথেই হেঁটেছেন।
এই অনিয়ম রোধে সংশ্নিষ্ট আমলাদের কাছে তিন দফা চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
সরকারি গাড়িতেই 'মধু': সরকারের উপসচিব মিজানুর রহমান প্রেষণে এখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিবহন মহাব্যবস্থাপক। তিনি সরকার থেকে বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে একটি গাড়ি কেনেন। গাড়ির জ্বালানি, চালক ও ব্যবস্থাপনা বাবদ সরকার প্রতি মাসে তাকে দেয় ৫০ হাজার টাকা। সরকারি ঋণ নেওয়ার পরও ডিএনসিসি থেকে দুই হাজার সিসির ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-৩২৪৭ নম্বরের একটি বিলাসবহুল জিপ বরাদ্দ নিয়ে তিনি ব্যবহার করছেন। এ জন্য প্রতিদিন ডিএনসিসি থেকে তাকে ১৫ লিটার জ্বালানি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ওই জিপ চালানোর জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার টাকা বেতনের একজন চালক। আর ঋণে কেনা গাড়ি ব্যবহার করেন তার পরিবারের সদস্যরা। ঠিক একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) ড. মাহে আলম ব্যবহার করছেন ঢাকা মেট্রো ঘ-১৪-৫৪০১ নম্বরের আরেকটি বিলাসবহুল জিপ।
এ ব্যাপারে উপসচিব মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, 'আমি সরকারি ঋণ নিয়েছি। কিন্তু সরকার থেকে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেওয়া ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ২৫ হাজার ৬০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়।'
একই সুরে কথা বলেন ডিএসসিসির পরিবহন মহাব্যবস্থাপক ও সম্প্রতি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া বিপুল কুমার বিশ্বাস। তিনি নিজেও সরকারি ঋণে গাড়ি কেনার পরও করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, ঋণ নেওয়ার পরও সরকারি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতা গাড়ি বরাদ্দ নিলে প্রতি মাসে গাড়ির ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের দেওয়া ৫০ হাজার টাকার অর্ধেক ২৫ হাজার টাকা ও ডিএসসিসির নিয়ম অনুযায়ী আরও ৬০০ টাকা তার বেতন থেকে প্রতি মাসে কেটে নেওয়া হয়। এভাবে যারা গাড়ি ঋণ নিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হয়।
এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সমকালকে বলেন, 'এটা পুরোপুরি অনিয়ম। কারণ, কর্মকর্তাদের গাড়ি ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যই ছিল যারা ঋণ নেবেন, সেই গাড়ি তার অফিস ও পরিবারের কাজে ব্যবহার করবেন। এই উদ্যোগের কারণে সরকারকেও আর গাড়ি কিনতে হবে না। এরপরও যারা এটা করছেন, তা সম্পূর্ণ অনৈতিক।'
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য গাড়ি বরাদ্দ আছে। ওই পর্যায়ের কর্মকর্তার জন্য আরেকটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও একজন যুগ্ম সচিব বা উপসচিবের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়।
জানা গেছে, ডিএসসিসির সচিব আকরামুজ্জামান, পরিবহন মহাব্যবস্থাপক বিপুল কুমার বিশ্বাস, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) উপসচিব আরিফুল হক, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-৫ উপসচিব সাখাওয়াত হোসেন, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-১০ উপসচিব মামুন মিয়াসহ ডিএসসিসিতে প্রেষণে কর্মরত থাকা ২২ জনের মধ্যে ১৯ জনই গাড়ি কেনার ঋণ নিয়েছেন। ঋণ নেওয়া প্রত্যেকেই ডিএসসিসি থেকে গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবহার করছেন। ডিএনসিসির ১৪ কর্মকর্তাও সরকারি ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার করছেন। রাজউকে এ রকম রয়েছেন আরও পাঁচজন। যে প্রতিষ্ঠানেই প্রেষণে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের প্রায় সবাই সরকারি ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। পাশাপাশি কর্মস্থলের গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে সেটিও ব্যবহার করছেন। এ রকম প্রতিটি গাড়ির পেছনে সরকারের মাসে খরচ হচ্ছে ৫০-৬০ হাজার টাকা।
একাধিক দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তারা সমকালকে বলেন, প্রেষণে কর্মরতদের খুশি রাখার জন্য একটু ভালো গাড়িই তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। কারণ, তারাই প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা হয়ে আসেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ননক্যাডার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, গাড়ির ঋণ সুবিধা দেওয়ার পর থেকেই তাদের বেতন বাড়ানোর দাবি বন্ধ হয়েছে। এখন শুধু কর্মচারীরা বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন।
নীতিমালায় যা বলা আছে: প্রাধিকার পাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারের যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত এই ঋণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়। পরে নীতিমালা বদলিয়ে উপসচিব (প্রশাসন ক্যাডার) পদে যাদের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে ২০১৭ সালের ২০ জুন থেকে, তাদেরও সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই ঋণের শর্তে বলা হয়, যারা ঋণ সুবিধা নেবেন, তারা ওই গাড়ি অফিসিয়াল ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। ঋণ নিলে কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি বরাদ্দ নিতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না।
মানা হচ্ছে না ঋণের নিয়ম: দেশে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ৭২টি অধিদপ্তর ও পরিদপ্তর, ৩১৬টি দপ্তর ও সংস্থা রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় কর্মরত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা, সচিব, সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে তিন বছর পার করা কর্মকর্তারা ঋণ সুবিধার প্রাধিকারভুক্ত। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা এই ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। ওই সময় পর্যন্ত এ খাতে দেওয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ১৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ: বিনা সুদের গাড়ির এই অপব্যবহার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, একশ্রেণির কর্মকর্তা ঋণের টাকায় ঠিকই গাড়ি কিনছেন, তবে সেটা পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর নিজেরা চলাফেরা করছেন সরকারি গাড়িতে। অথচ যারা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ পান না বা নেন না, তাদের জন্যই সরকারি গাড়িগুলো বরাদ্দ।
এসব অনিয়ম রোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের তিন দফা (২০১৮ সালের ১ নভেম্বর, ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর ও গত ৮ মার্চ) চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, নীতিমালা না মেনে কিছু কর্মকর্তা সুদমুক্ত ঋণের গাড়ি নিজে ব্যবহার না করে সরকারি গাড়িতে অফিসে যাতায়াত করছেন। কেউ কেউ পারিবারিক কাজেও গাড়ি ব্যবহার করছেন। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে তুলে নিচ্ছেন। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই অনিয়ম রোধে সুদমুক্ত ঋণের টাকায় কেনা গাড়ির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও সরকারি গাড়ি অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। নীতিমালার ব্যত্যয় 'সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮' অনুযায়ী অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
এদিকে, সুবিধার অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা নিতে দেওয়া চিঠিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়, সুদমুক্ত ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করা যাবে না মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন। প্রেষণ, মাঠ প্রশাসন, প্রকল্পে কর্মরত কোনো কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক সরকারি যানবাহন ব্যবহারের সুবিধা থাকলে সুদমুক্ত ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে নির্ধারিত টাকার ৫০ শতাংশ পাবেন এবং কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব যা বলছেন: এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন সচিব কে এম আলী আজম সমকালকে বলেন, 'প্রেষণে কোনো কর্মকর্তা অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকলে, ওই পদের বিপরীতে গাড়ি বরাদ্দ থাকলে ওই কর্মকর্তা গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে গাড়ি ঋণ নেওয়া কর্মকর্তার কাছ থেকে গাড়ি ব্যবহার বাবদ বরাদ্দ করা টাকার অর্ধেক তার বেতন থেকে কেটে রাখা হয়। এর বাইরে কেউ বরাদ্দ নিয়ে ব্যবহার করলে সেটা আইনের ব্যত্যয়। যারা এটা করছেন, তাদের ব্যাপারেও মন্ত্রণালয় সজাগ আছে। মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদারকি করছে।'
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com