আইনশৃঙ্খলা

পর্যটন কেন্দ্র হোক নিরাপদ

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২১ । ০২:৪১ | প্রিন্ট সংস্করণ

আশেক মাহমুদ

কোনো অপরাধ যখন প্রায় প্রতিদিন ঘটে, তখন মানুষ সে অপরাধকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। এই স্বাভাবিক ভাবনাটা যে কোনো দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ আমাদের সামাজিক অসুস্থতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়াদি মিশে আছে। কিন্তু ধর্ষণ এমন এক অপরাধ, যা আমাদের মান-মর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে। এক নারী স্বামী-সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যান কক্সবাজার। সমুদ্রের পানিতে না নামতেই সন্ত্রাসের ঢেউ এসে নারীকে তলিয়ে নিয়ে যায় এক ভয়ংকর হিংস্রতার সাগরে। লাবনী সি-বিচ থেকে এলাকার সন্ত্রাসীখ্যাত আশিকুল তার সাঙ্গোপাঙ্গর সহযোগিতায় স্বামী-সন্তানকে বেঁধে ওই নারীকে টেনে নিয়ে যায়। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন তিনি।

ভুক্তভোগী সেই নারী ও স্বামী হয়তো জানতেন না, ওখানে সন্ত্রাসীদের দাপট কতখানি। আশিকুলের ভয়ে এলাকার মানুষ তটস্থ। ৬০-৭০ জন মাস্তান নিয়ে বহু অপরাধ চালিয়ে যেত। এসব অপরাধের দায়ে তাকে কারাবন্দি করা হয়। এক মাস পরই সে জামিনে বেরিয়ে আসে। পর্যটন কেন্দ্রে সে বহু অপরাধ করেছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রেকর্ডে আছে। সেই আশিকুল কী করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে পর্যটন স্পটগুলোতে! অথচ প্রতিটি ট্যুরিস্ট কেন্দ্রে ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকার কথা। তারা কি সে দায়িত্ব পালন করেছে? ঘটনাটি ঘটাতে অনেক সময় নিয়েছে; টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে; স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখেছে; নারীকে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে। আর সবই হয়েছে লাবনীর মতো লোকালয়ে। এর মানে কি ধরে নেব, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো সদস্য ছিলেন না? সেখানে উপস্থিত পর্যটকরা কি ঘটনাটি ঘটতে দেখেননি? যারা দেখেছেন, তাদের কেউ কেন বাধা দিতে আসেননি? অথবা ৯৯৯ নম্বরে কেউ কি ফোন করেছিলেন? সংবাদমাধ্যমে এসেছে, রিসোর্টে রুমবন্দি থাকা নারী কৌশলে এক ব্যক্তির সহায়তায় ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেছিলেন। উত্তরে নাকি বলা হয়েছিল থানায় এসে জিডি করতে। পরে র‌্যাবকে ফোন দিলে র‌্যাব-১৫ এসে ওই নারীকে উদ্ধার করে।

তথ্যগুলো এ ধারণা দিচ্ছে, জনগণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বে অবহেলাকে স্বাভাবিক জ্ঞান করে। এ ধরনের ঘটনা চোখের সামনে ঘটলেও আমরা অনেকেই না দেখার ভান করে নিজেরা উপভোগ করতে থাকি। এর মানে- আমাদের সামাজিক বন্ধন, পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীলতা এতই নিচে নেমে গেছে; প্রতিবাদ দূরের কথা, ৯৯৯-এ কল দেওয়ার বোধশক্তিও হারিয়ে ফেলছি! এই আমরাই তো সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। এমন মূল্যবোধ নিয়ে চাকরি করলে অবহেলাই বাড়বে। সুতরাং এর দায়ভার সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ওপর বর্তাবে।

পর্যটন খাতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় দুটো বিষয় অত্যাবশ্যক- পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিনিয়োগের একটা অংশ ব্যয় করতে হবে নিরাপত্তার জন্য। কক্সবাজারের ঘটনাটি প্রমাণ করে, পর্যটনশিল্পকে আমরা এখনও শৈল্পিক ও নিরাপদ করতে পারিনি। সম্প্রতি এক সুইস পর্যটক ভারতে এসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ও এক ব্রিটিশ নারী ধর্ষণের ভয়ে জানালা থেকে লাফ দেন। মেক্সিকোতেও ৬ স্প্যানিশ নারী ধর্ষণের শিকার হন। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় শুধু আর্থিক ক্ষতিই ডেকে আনে না; সম্মানহানিও করে বহুগুণ। আসলেই নারীদের নিরাপত্তাহীনতা এখন সবখানে- ঘর, অফিস, বিনোদন কেন্দ্র, লোকালয়ে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, প্রতিদিন বাংলাদেশে কমপক্ষে চারজন নারী ধর্ষণের শিকার হন, আর মাত্র ৩ শতাংশ ধর্ষণের মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায়। গত ১৫ বছরে ঢাকার নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত তথ্যে দেখা যায়, ৪১ শতাংশ বিচারের আগেই অব্যাহতি পায়; ৫৫ শতাংশ পায় বেকসুর খালাস।

এসব চিত্রই বলে দিচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থাকে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য প্রস্তুত করা না যাবে, ততদিন নারীর তো বটেই, সবাইকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলতে হবে। আমাদের সিভিল সোসাইটিকে এমনভাবে গতিশীল করতে হবে, যাতে প্রতিটি সামাজিক সংগঠন অপরাধের দ্রুত বিচারের দাবি জোরালো করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রত্যেক আসামি বা সন্ত্রাসীর অতীত অপরাধের রেকর্ড আছে। সে অনুযায়ী জামিন ব্যবস্থাকে আরও কঠিন করে তুলতে হবে। জামিনের পর তাদের নজরদারিতে রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও নজরদারি জোরদার করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি এবং অপরাধের শাস্তি- দুই-ই নিশ্চিত করতে না পারলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা হারাবে। সে উপলব্ধি থেকেই কক্সবাজারসহ প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করতে হবে। দায়িত্ব পালনের পুরস্কার আর দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি- এই মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নারীদের জন্য নিরাপদ সমাজ গঠন করা সহজতর হবে। পুলিশের বক্তব্য, ধর্ষণের শিকার নারীর শিশুসন্তানের হার্টে ব্লক রয়েছে। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের জন্য তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে দেহব্যবসা করে আসছিলেন। এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে সেই নারী যে সংঘবদ্ধ চক্রের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তা পুলিশের বক্তব্যেও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ওই নারী পর্যটক হিসেবে গিয়েছিলেন, নাকি অন্য উদ্দেশ্যে, সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে অপরাধমুক্ত সমাজ ও নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্র নিশ্চিতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।

ড. আশেক মাহমুদ :সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com