
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
গবেষণা নেই, স্মরণিকা সেমিনারেই আটকা
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২২ । ০১:৪৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
হাসনাইন ইমতিয়াজ

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভবন সমকাল
দেশ-বিদেশের নানা জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা, সংরক্ষণ এবং প্রচার-প্রসারের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত গৌরবোজ্জ্বল দিন একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পটভূমিতে এই ইনস্টিটিউট স্থাপন দেশের জন্য সম্মানজনক। তবে ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও উদ্দেশ্য পূরণে যথার্থ কার্যক্রমই হাতে নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। শুধু সেমিনার আয়োজন, নিউজ লেটার ও স্মরণিকা প্রকাশ এবং বাংলা বানান শেখানোর সীমিত কাজ হয়েছে।
কোনো গবেষণা কাজ হাতে নেওয়া হয়নি। উল্লেখ করার মতো দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে 'নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা' কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে গত এক দশকে। কিন্তু এখনও এই সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রকাশনা নেই। শুধু একটি খণ্ডের কাজ শেষ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি নাম 'ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট'-এর অ্যাব্রেভিয়েশন থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে 'আইএমএলআই' বলেও উল্লেখ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেস্কোর ক্যাটাগরি-২ ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি পেয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম না থাকায় স্বীকৃতি বাতিল হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা।
মূলত ফেব্রুয়ারি মাস এলেই একটু দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় এখানে। বছরের বাকি সময় তেমন কোনো কাজ থাকে না নিউজ লেটার প্রকাশ ছাড়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় আমলাদের দ্বারা। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি শাখায় পরিণত হয়েছে। স্ব্বাধীনভাবে কাজের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। চলছে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের দ্বারা। স্বীকৃত কোনো ভাষা গবেষক নিয়োগ পাননি এবং সেরূপ নিয়োগ-নীতিমালা এখনও গৃহীত হয়নি।
শুরু যেভাবে :১৯৯৯ সালে সরকার দেশে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির পাশে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্ততর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময় এই প্রকল্পের কাজ আটকে যায় যায়। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এটি ছয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
যেমন চলছে ইনস্টিটিউট :প্রতিষ্ঠানটির জন্য ২৩টি কাজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চার-পাঁচটি পুরোপুরি এবং কয়েকটি আংশিক বাস্ততবায়িত হয়েছে। বিদেশে বাংলা প্রসারে সুনির্দিষ্ট কোনো কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাংলা উচ্চারণ ও বানান শেখানোর কাজ করেছে ইনস্টিটিউট। কয়েকটি বুলেটিন আর জার্নাল প্রকাশ, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন, ভাষা পদক প্রদানের কাজেই সীমাবদ্ধ গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউটটির কাজ। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা সংরক্ষণে আর্কাইভ ও একটি ভাষা-জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। যদিও প্রচারের অভাবে দর্শনার্থী তেমন আসে না।
সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ইনস্টিটিউট ভবনে বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রীর অফিস করা হয়েছে। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে গঠিত জাতীয় কমিটির কার্যালয় ভবনটিতে স্থাপন করা হয়েছিল।
দেশের ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে ১০টির নিজস্ব লিপি আছে। এগুলোর মধ্যে চাকমা-মারমাসহ পাঁচট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় বই দিয়েছে সরকার। এ কাজে ভাষা ইনস্টিটিউট সহযোগিতা করেছে। আরও নৃগোষ্ঠীদের ভাষায় বই প্রণয়নের কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ কয়েক ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে।
ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিন্নাত ইমতিয়াজ আলী। গত নভেম্বরে তিনি অবসরে যান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) শাফীউল মুজ নবীন এবং একাধিক উপপরিচালকের সঙ্গে সমাকলের কথা হয়। তারা জানান, ভাষা জাদুঘরে ১১০টি ডিসপ্লেতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত সেমিনার, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তবে করোনার কারণে কার্যক্রম অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। তারা জানান, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ ও প্রতিষ্ঠান এই গবেষণায় অংশ নিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শিকদার মনোয়ার মোর্শেদ (সৌরভ সিকদার) বলেন, নিজে থেকে এভাবে ক'জন এগিয়ে আসবে। উদ্যোগটা ইনস্টিটিউটকেই নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি ভালো উদ্যোগ। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাষা নিয়ে গবেষণার জন্য। কিন্তু আদতে হয়েছে আমলাদের একটি কর্মক্ষেত্র। তাদের কাজ শুধু তিন মাস পরপর একটা বুলেটিন বের করা, বছরে একবার গবেষণার নামে জরিপ করা এবং একুশে ফেব্রুয়ারি এলে সেমিনার। প্রতিবছর একই লোকদের দিয়ে সেমিনার করা হচ্ছে। কোনো বৈচিত্র্য নেই। গবেষণা নেই। মন্ত্রণালয় ও আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন কোনো সত্তা নেই।
সবেধন কাজ :গত ১১ বছরে প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র বড় আকারের কাজ 'নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা'। বাংলাদেশের বসবাসরত বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষা-পরিস্থিতি ও ভাষিক সম্প্রদায়ের অবস্থা ও অবস্থান জানার জন্য ২০১৪ সালে এ কাজ শুরু হয়। সমীক্ষা শেষে ১০টি বাংলা ও ১০টি ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশ করার কথা ছিল। ২০১৬ সালে শেষ হয় এই সমীক্ষা। তবে এখন পর্যন্ত একটি প্রকাশ করা হয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা আগে ভাবতেন দেশে ২৭টি ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছে। কিন্তু এ সমীক্ষায় বাংলাসহ ৪১ ভাষার অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা।
নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার পরামর্শক অধ্যাপক সৌরভ সিকদার জানান, নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার একটি খণ্ড ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে বই আকারে ছাপানো হয়েছে। এরপর আর কোনো গ্রন্থই প্রকাশ করা হয়নি।
ভাষা পদক :বিশ্ব্বজুড়ে মাতৃভাষায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সাল থেকে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রদান শুরু হয়। তিন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে গত বছর প্রথমবারের মতো এ পদক দেওয়া হয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং খাগড়াছড়ির জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, উজবেকিস্ততানের গবেষক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ এবং বলিভিয়ার অনলাইন উদ্যোগ অ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াস এই সম্মাননা পেয়েছেন।
গবেষক ও দক্ষ জনবল সংকট :ইনস্টিটিউটের জনবল কাঠামো অনুযায়ী ১৭টি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদসহ মোট ৯৮টি অনুমোদিত পদ আছে। তবে বর্তমানে কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে এখানে ৭০ জন কাজ করছেন। কোনো গবেষক আজ পর্যন্ত এখানে নিয়োগ পাননি। জনবল কাঠামোতে ৯৩টি পদ রয়েছে। লোক নিয়োগ ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে। পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগের কার্যক্রম বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে অধ্যাপক শিকদার মনোয়ার মোর্শেদ বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় নিজেরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না ভাষা ইনস্টিটিউট। তবে ভাষা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, গবেষণা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেটি পেলেই গবেষক নিয়োগ ও তাদের সহযোগিতার বিষয়টি সহজ হবে।
কোনো গবেষণা কাজ হাতে নেওয়া হয়নি। উল্লেখ করার মতো দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে 'নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা' কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে গত এক দশকে। কিন্তু এখনও এই সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রকাশনা নেই। শুধু একটি খণ্ডের কাজ শেষ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি নাম 'ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট'-এর অ্যাব্রেভিয়েশন থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে 'আইএমএলআই' বলেও উল্লেখ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেস্কোর ক্যাটাগরি-২ ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি পেয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম না থাকায় স্বীকৃতি বাতিল হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা।
মূলত ফেব্রুয়ারি মাস এলেই একটু দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় এখানে। বছরের বাকি সময় তেমন কোনো কাজ থাকে না নিউজ লেটার প্রকাশ ছাড়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় আমলাদের দ্বারা। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি শাখায় পরিণত হয়েছে। স্ব্বাধীনভাবে কাজের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। চলছে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের দ্বারা। স্বীকৃত কোনো ভাষা গবেষক নিয়োগ পাননি এবং সেরূপ নিয়োগ-নীতিমালা এখনও গৃহীত হয়নি।
শুরু যেভাবে :১৯৯৯ সালে সরকার দেশে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির পাশে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্ততর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময় এই প্রকল্পের কাজ আটকে যায় যায়। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এটি ছয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
যেমন চলছে ইনস্টিটিউট :প্রতিষ্ঠানটির জন্য ২৩টি কাজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চার-পাঁচটি পুরোপুরি এবং কয়েকটি আংশিক বাস্ততবায়িত হয়েছে। বিদেশে বাংলা প্রসারে সুনির্দিষ্ট কোনো কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাংলা উচ্চারণ ও বানান শেখানোর কাজ করেছে ইনস্টিটিউট। কয়েকটি বুলেটিন আর জার্নাল প্রকাশ, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন, ভাষা পদক প্রদানের কাজেই সীমাবদ্ধ গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউটটির কাজ। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা সংরক্ষণে আর্কাইভ ও একটি ভাষা-জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। যদিও প্রচারের অভাবে দর্শনার্থী তেমন আসে না।
সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ইনস্টিটিউট ভবনে বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রীর অফিস করা হয়েছে। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে গঠিত জাতীয় কমিটির কার্যালয় ভবনটিতে স্থাপন করা হয়েছিল।
দেশের ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে ১০টির নিজস্ব লিপি আছে। এগুলোর মধ্যে চাকমা-মারমাসহ পাঁচট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় বই দিয়েছে সরকার। এ কাজে ভাষা ইনস্টিটিউট সহযোগিতা করেছে। আরও নৃগোষ্ঠীদের ভাষায় বই প্রণয়নের কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ কয়েক ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে।
ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিন্নাত ইমতিয়াজ আলী। গত নভেম্বরে তিনি অবসরে যান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) শাফীউল মুজ নবীন এবং একাধিক উপপরিচালকের সঙ্গে সমাকলের কথা হয়। তারা জানান, ভাষা জাদুঘরে ১১০টি ডিসপ্লেতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত সেমিনার, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তবে করোনার কারণে কার্যক্রম অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। তারা জানান, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ ও প্রতিষ্ঠান এই গবেষণায় অংশ নিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শিকদার মনোয়ার মোর্শেদ (সৌরভ সিকদার) বলেন, নিজে থেকে এভাবে ক'জন এগিয়ে আসবে। উদ্যোগটা ইনস্টিটিউটকেই নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি ভালো উদ্যোগ। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাষা নিয়ে গবেষণার জন্য। কিন্তু আদতে হয়েছে আমলাদের একটি কর্মক্ষেত্র। তাদের কাজ শুধু তিন মাস পরপর একটা বুলেটিন বের করা, বছরে একবার গবেষণার নামে জরিপ করা এবং একুশে ফেব্রুয়ারি এলে সেমিনার। প্রতিবছর একই লোকদের দিয়ে সেমিনার করা হচ্ছে। কোনো বৈচিত্র্য নেই। গবেষণা নেই। মন্ত্রণালয় ও আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন কোনো সত্তা নেই।
সবেধন কাজ :গত ১১ বছরে প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র বড় আকারের কাজ 'নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা'। বাংলাদেশের বসবাসরত বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষা-পরিস্থিতি ও ভাষিক সম্প্রদায়ের অবস্থা ও অবস্থান জানার জন্য ২০১৪ সালে এ কাজ শুরু হয়। সমীক্ষা শেষে ১০টি বাংলা ও ১০টি ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশ করার কথা ছিল। ২০১৬ সালে শেষ হয় এই সমীক্ষা। তবে এখন পর্যন্ত একটি প্রকাশ করা হয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা আগে ভাবতেন দেশে ২৭টি ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছে। কিন্তু এ সমীক্ষায় বাংলাসহ ৪১ ভাষার অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা।
নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার পরামর্শক অধ্যাপক সৌরভ সিকদার জানান, নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার একটি খণ্ড ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে বই আকারে ছাপানো হয়েছে। এরপর আর কোনো গ্রন্থই প্রকাশ করা হয়নি।
ভাষা পদক :বিশ্ব্বজুড়ে মাতৃভাষায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সাল থেকে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রদান শুরু হয়। তিন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে গত বছর প্রথমবারের মতো এ পদক দেওয়া হয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং খাগড়াছড়ির জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, উজবেকিস্ততানের গবেষক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ এবং বলিভিয়ার অনলাইন উদ্যোগ অ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াস এই সম্মাননা পেয়েছেন।
গবেষক ও দক্ষ জনবল সংকট :ইনস্টিটিউটের জনবল কাঠামো অনুযায়ী ১৭টি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদসহ মোট ৯৮টি অনুমোদিত পদ আছে। তবে বর্তমানে কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে এখানে ৭০ জন কাজ করছেন। কোনো গবেষক আজ পর্যন্ত এখানে নিয়োগ পাননি। জনবল কাঠামোতে ৯৩টি পদ রয়েছে। লোক নিয়োগ ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে। পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগের কার্যক্রম বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে অধ্যাপক শিকদার মনোয়ার মোর্শেদ বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় নিজেরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না ভাষা ইনস্টিটিউট। তবে ভাষা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, গবেষণা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেটি পেলেই গবেষক নিয়োগ ও তাদের সহযোগিতার বিষয়টি সহজ হবে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com