
বেলগ্রেডের নিকোলা টেসলা মিউজিয়াম
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২২ । ১৪:৩৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইমদাদ হক

গন্তব্য নিকোলা টেসলা জাদুঘর। গাড়িতে যেতে সময় লাগার কথা মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিট। কিন্তু সার্ব ড্রাইভার আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, বলা মুশকিল। এ গলি থেকে ও গলি, এই মোড় থেকে ওই মোড়, সামনে গিয়ে আবার ইউটার্ন, এসব করতে করতে লেগে গেল পাক্কা ২৫ মিনিট।
এক দিনে বেলগ্রেড শহরের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘোরার কর্মসূচি নিয়ে বের হয়েছি। সকাল থেকে চলছে ঘোরাঘুরি, দেখছি একটির পর আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্থান বা স্থাপনা। মধ্য সকালের নাশতার পর আমরা যাব সার্বিয়ার রয়েল প্যালেসে। নাশতার এই সময়টাকে আমি কাজে লাগাতে চাই। নিকোলা টেসলা জাদুঘরটায় একচক্কর মেরে আসতে চাই। আমাদের সঙ্গে থাকা সার্বিয়ান টিমের সবাই ব্যস্ত। আর আমার সঙ্গীদের মনোযোগ নাশতার টেবিলে, কাউকে পেলাম না। ড্রাইভারকে নিয়ে একাই বের হলাম। ড্রাইভার ইংরেজি জানেন না। কাজেই বকবকানির বালাই নেই। গুগল ম্যাপে লোকেশন ঠিক করে তিনি স্টিয়ারিং চালানো শুরু করলেন।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। মাঝারি ধরনের মেটে রঙের ভবন; যা বেলগ্রেড শহরের ঠিক মধ্যখানে। বেলগ্রেডের অন্যতম প্রধান জাদুঘর এটি। যার নির্মাণকাল ১৯২৯ সাল। ব্যতিক্রমী মূল্যবান সংগ্রহশালা হিসেবে রয়েছে এর বিশেষ খ্যাতি।
হাতে সময় কম। কম সময়ে দেখতে হবে পুরো জাদুঘর। কাজেই গবেষণার উপায় নেই। হাঁটতে হবে পায়ে জোর লাগিয়ে। এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি মূল নথি, বই এবং জার্নাল রয়েছে এই জাদুঘরে। ঐতিহাসিক প্রযুক্তিগত পণ্যের সমাহারে যে কেউ অবাক হবেন। ফটোপ্রেমীদের জন্য রয়েছে সেই সময়ের ফটোগ্রাফ, প্রযুক্তিগত বস্তু, ফটোগ্রাফের যন্ত্রপাতি। বিখ্যাত সব ছবির পরিকল্পনা আর নানা অঙ্কনের ফটো প্লেটও আছে এখানে। বিজ্ঞান-ইতিহাসের গবেষক ও উদ্ভাবকদের জন্য এটি তথ্যভান্ডার। তাই বেলগ্রেড ভ্রমণকারীরা নিকোলা টেসলা মিউজিয়াম ঘুরে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।
মিউজিয়ামের এই রুম থেকে ওই রুম, এ বারান্দা থেকে ওই বারান্দা ঘুরে বেড়াই। ঘুরে বেড়ানো বললে ভুল হবে, দৌড়ে বেড়াই। সঙ্গে কেউ থাকলে ভালো হতো? না, একাই যথেষ্ট। একা ঘুরতে গেলে নিজের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারি আমরা। শুনতে অদ্ভুত মনে হতে পারে, বাস্তবতা হলো ব্যস্ত জীবনে ক্রমশ নিজের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আসছে আমাদের। যার জন্য একটা সময় গ্রাস করে অবসাদ। কাজেকর্মে উৎসাহ হারাতে থাকার পেছনে এটা গুরুতর একটি কারণ। এই সমস্যা কাটাতে মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়া উচিত। একা ঘুরতে গেলে নিজের মতো করে সময় কাটানো যায়। একা চলতে হয়, ঘুরতে হয়। কেনাকাটা, খাবারদাবারও সারতে হয় একা একাই। আত্মবিশ্বাসটা বাড়ে। অনুকূল-প্রতিকূল সব পরিস্থিতি একা সামলানোর চেষ্টা থাকে। যাতে করে নিজের সম্পর্কে ভরসার পাঠটাও রপ্ত হয়। সংস্কৃতি, খাবার, পোশাক, গানবাজনা কত কিছু জানাও সহজ হয় একলা ভ্রমণে। দলবেঁধে গেলে মনে হয় ঘোড়ার গাড়িকে টেনে সামনে নিতে হয়। সময় খরচ হয় বেশি, বাড়ে ঝক্কিঝামেলাও। এই ট্যুরে বসে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাই।
এই জাদুঘরটি দর্শন ও ইতিহাসের গবেষণার আধার। প্রাচীন গ্রিস থেকে জাদুঘরের উৎপত্তি, লক্ষ্য ছিল শিল্প ও দর্শন চর্চা। আগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দেখভালেই জাদুঘর পরিচালিত হতো। এখন কোথাও এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে। কোথাও কোথাও বা চলছে নিজে নিজেই স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে। ১৮ মে বিশ্বের সব দেশ মিলে পালন করে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। ১৯৭৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস হিসেবে এটি পালিত হচ্ছে। জাদুঘর-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন 'আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ'-এর তথ্য বলছে, বিশ্বের ২০২টি দেশে ৫৫ হাজারের বেশি জাদুঘর রয়েছে।
ঘটনাটা টেসলার জন্মের সময়ে। ক্রোয়েশিয়ার এক প্রান্তিক গ্রামে স্মিয়ানের এক ছোট্ট বাড়িতে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন ডিউকা। চিন্তিতভাবে পায়চারি করছে তার খ্রিষ্টান পুরোহিত স্বামী মিলাটিন। ওদিকে বাইরে তখন চলছে তুমুল ঝড়। থেকে থেকে মেঘে ঢাকা কালো আকাশের বুক চিরে দিয়ে যাচ্ছে বজ্রপাত। প্রসব কাজ সবে শেষ হয়েছে। বৃদ্ধ ধাত্রী বজ্রপাতের ঝলকানিতে ভয় পেয়ে গেল। শিশুটির জন্মে সে একে অশুভ সংকেত হিসেবে ধরে নিলেও তা মানতে রাজি হননি ডিউকা। বরং পরম ভালোবাসায় বললেন, 'আমার এ সন্তান ছড়িয়ে দেবে আলো!' নিকোলা টেসলাকে নিয়ে তার বাবার আশাবাদ সত্য হয়েছিল।
বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম বিস্ময় যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার গ্রিড। প্রায় একশ বছরে গড়ে ওঠে এই জটিল বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক। এতে যুক্ত অসংখ্য পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ট্রান্সফরমার। এগুলো ছড়িয়ে আছে প্রায় ৪৫০ হাজার মাইল এলাকাজুড়ে। এ অভাবনীয় সংযোগে যুক্ত করে দুনিয়ার বুকে আলো ছড়িয়ে দেওয়া মানুষটির নাম নিকোলা টেসলা।
সময় বাঁচাতে দৌড়ে দৌড়ে ঘুরতে থাকি। এ জাদুঘরটি টেসলার ব্যবহূত ব্যক্তিগত আইটেমগুলোর বিরাট সংগ্রহশালা। এর মধ্যে রয়েছে হাতে লেখা পেনসিল নোট, টিকা, মুদ্রিত ব্যবসায়িক কার্ড ও বাতিল ডাকটিকিট। টেসলা ভক্তদের মন কাড়বে সস্তার কাগজে অ্যাকাউন্ট বুক, হাতে লেখা চেক আর মুদ্রিত ফর্ম দেখে। ডুপ্লিকেটসহ টাইপ করে লেখা পাঠ্য। সেইসঙ্গে পার্চমেন্টে রঙিন কালিতে লেখা ডিপ্লোমা। একটি ইন্টাগ্লিও স্ট্যাম্পসহ একটি চার্টারও চোখে পড়বে সহজেই। ট্রেসিং পেপারে ভারতের কালিতে আঁকা পরিকল্পনার ব্লুপ্রিন্ট কপি দেখে একটু থামি। ৫৪৮টি বাক্সে করে সব জিনিস এখানে প্রদর্শিত হয়। আর এগুলোকে ভাগ করা হয় সাতটি ক্যাটাগরিতে। এসব আর্কাইভাল উপকরণকে নতুন ফোল্ডার এবং বাক্সে সর্বোচ্চ মানে রিপ্যাক করা হয়েছে। প্রতিটি চেম্বার বিশেষভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ডকুমেন্টারি উপাদানের ডিজিটালাইজেশন পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখে। জাদুঘরকে ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। প্রতিটি উপাদানের মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব উপাদান একেবারে অপরিবর্তিতরূপে দেখতে পারে। বহু যুগ পরেও এসব নিদর্শন আগের মতোই এগুলো দেখা যাবে।
পুরো জাদুঘর কার্পাস ৯টি সংগ্রহশালা নিয়ে গঠিত। এ সংগ্রহশালায় ১২০০টিরও বেশি আইটেম নিবন্ধিত। যার মধ্যে বিভিন্ন যান্ত্রিক এবং বৈদ্যুতিক প্রকৌশল প্রযুক্তিগত মূল জিনিসপত্র রয়েছে। সাভা কোসানোভিচ নামের এক ব্যক্তি এসব জিনিস সংগ্রহ করেন। শুরুতে এগুলো রাখা হয় বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে। পরে ১৯৫২ সালের জুনে অনুষদ থেকে সরিয়ে ব্রিগাডা তে গেনসিচ ভিলায় নেওয়া হয়। সেই ভিলাই পরে জাদুঘরে রূপ নেয়। ১৯৫৫ সালের ২০ অক্টোবর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় জাদুঘর। ১৯৬৯ সাল থেকে জাদুঘরটি বেলগ্রেড শহরের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালে নিকোলা টেসলার জাদুঘরকে 'মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে' যুক্ত করেছে ইউনেস্কো।
ঘুরে দেখতে দেখতে ভাবুক হয়ে যাচ্ছি। মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে, সার্বিয়ান টিমের কো-অর্ডিনেটর ক্রিভোর ফোন। জাদুঘর দেখতে আমার সময় ছিল ৩০ মিনিট, পার করে ফেলেছি বাড়তি ১৫ মিনিট। ফোনের সবুজ বাটন আর টিপি না, দৌড়ে বের হই, খুঁজি প্রধান ফটক। এক্ষুুনি ফিরতে হবে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com