প্রদর্শনী

শিল্পের আলোয় মৈত্রীর বন্ধন

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সঞ্জয় ঘোষ

ভাষা ও আচারের স্বাতন্ত্র্য যেমন বিভিন্ন জাতি ও ভূগোলের মানুষকে আলাদা করে- তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শিল্পও তাদের যার যার স্বকীয়তার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। তবে পৃথিবীর জাতি ও অঞ্চলগত বহুত্বের মাঝে ঐক্যের বন্ধন নির্মাণে শিল্পের রয়েছে নিজস্ব এক ধারণ ও প্রকাশক্ষমতা। তারই অনন্য উদাহরণ দেখা গেল 'ইমব্রেস ফ্রেন্ডশিপ :জাপান-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের ৫০ বছর উদযাপন' শীর্ষক চিত্র-প্রদর্শনীতে। শিল্পী আনিসুজ্জামান আনিসের ছাপচিত্রশৈলীর একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত এই প্রদর্শনী। যেখানে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে উডকাট প্রিন্টমেকিং-এর জাপানিজ কৌশলে চিত্রকর্মগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। আনিসুজ্জামান আনিসের ছাপাই ছবির দক্ষতায় দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন উপাদান, ঐতিহ্য ও প্রতীককে পাশাপাশি উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার মৈত্রীর বন্ধন শিল্পের আলোয় উপস্থাপন করার এ এক অনন্য প্রচেষ্টা; যা প্রতীক ও শিল্পীর করণকৌশল ছাপিয়ে দর্শকহৃদয়ে নিঃসন্দেহে জাপান-বাংলাদেশের যৌথতা ও বন্ধনের নতুন একটা মাত্রা তৈরি করেছে। দুই দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি, ভূগোল ও সংস্কৃতির নানা উপাদানের সহাবস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি ছাপচিত্রে যেমন একটা সমন্বয় ও সাজুয্য প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পী, তেমনি তাতে প্রকাশ পেয়েছে ছাপচিত্রের নানা উপস্থাপনভঙ্গির বহুমাত্রিকতা।

শিল্পী আনিসুজ্জামান আনিস প্রদর্শনীর এই ছাপচিত্রগুলো পরিকল্পিতভাবে একটি সুশৃঙ্খল উপস্থাপনার রূপ দিয়েছেন- যেখানে প্রায় সবক'টি ছাপচিত্রের গড়ন ও আকৃতি দেখতে একই রকম- কিন্তু তার ভেতরের বিষয় ও উপাদান আলাদা আলাদা। তবে সেই বিচিত্র বিষয়-উপাদানের উপস্থাপনের মধ্যে মূল পরিকল্পনাটি ছিল দুই দেশের মৈত্রীর বন্ধন তুলে ধরা। ছাপচিত্রগুলোর প্রতিটির চিত্রতলে দুটি পরস্পর নৈকট্যপ্রবণ বৃত্তাকার স্পেসের ভেতরেই দুই দেশের ঐতিহ্যিক উপাদানগুলো স্থান দেওয়া হয়েছে।

একটি ছাপচিত্রে স্থান পেয়েছে জাপানি জলে ভাসমান পদ্মফুলের সাথে বাংলাদেশের শাপলা। শাপলাগুলো ভাসছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রতীক স্মৃতিসৌধের সামনের জলে। অন্য ছবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের ঊর্ধ্বমুখী সৌকর্যের সাথে শিল্পী তুলে এনেছেন ঐতিহ্যবাহী জাপানি ছাতার বহুবর্ণিল ছটা।

অন্য একটি ছাপচিত্রে স্থান পেয়েছে বরফে আচ্ছাদিত ফুজি পর্বত- জাপানিদের কাছে যা শুধু একটি পর্বত নয়; অন্যতম জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। বরফে ঢাকা ঘুমন্ত এই আগ্নেয়গিরি কত কবির কল্পনা আর শিল্পীর চিত্রপট সমৃদ্ধ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। শিল্পী আনিসুজ্জামান আনিস তার কাঠ খোদাইয়ের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ দক্ষতায় সন্ধ্যার নীলাভ মায়াময় এক ফুজির দৃশ্যপট নির্মাণ করেছেন তার ছাপাই ছবিতে। পর্বতের সামনে সুনীল জলরাশিতে পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভেসে আছে অজস্র বাতি। আর এই দৃশ্যকাব্যের পাশে শিল্পী স্থাপন করেছেন বাংলার নীল আকাশের নিচে সাদা কাশফুলের মায়া। দুটি ভিন্ন উপাদান কিন্তু বর্ণে আবহে প্রকৃতির চিরাচরিত সম্পর্কের ছাপ; যা সত্যি দুটি দেশের সম্পর্কের প্রতীকী উপস্থাপনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

শিল্পী আরেকটি ছাপচিত্রে বিষয় হিসেবে স্থান দিয়েছেন জাপানের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের কদম ফুলকে। জাপানের সেই বাড়ির ওপর আকাশে অজস্র জ্বলজ্বলে ফানুস যেন উদযাপনের বর্ণচ্ছটা- আর বাংলার কদম সেই বর্ণচ্ছটারই অনুগামী বিচ্ছুরণ। স্থান পেয়েছে জাপানি জীবনযাত্রার দৈনন্দিন তৈজস, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের চিরচেনা মধুমঞ্জরি ফুল। একই চিত্রে দক্ষ ছাপের পৃথক পৃথক সবুজের সাথে ফুল ও পাতার স্পষ্ট বৈচিত্র্যের সজীবতা। আবার বাঙালি সংস্কৃতির নাগরদোলার সাথে উঠে এসেছে জাপানি কোনো অচেনা ফুলের সৌরভ। যে ছবিতে নাগরদোলার সাথে সামঞ্জস্য বিধানে যুক্ত হয়েছে আমাদের হলুদ পলাশ ফুলের আভা।

অন্য ছবিতে উঠে এসেছে গ্রামবাংলার আরেকটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক- নৌকাবাইচ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌকাবাইচের হুল্লোড় ফুটে উঠেছে জাপানি উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গের পাশে।

জাপানের পাহাড়ি ফসল-প্রকৃতির সাথে শিল্পী তুলে ধরেছেন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জনপদের জুম চাষাবাদের ঐতিহ্যবাহী দৃশ্যপট। অন্য একটি ছাপচিত্রে জাপানি মেঘমল্লারের সাথে শিল্পী তুলে এনেছেন বাংলার চিরচেনা বনানীর ওপর বর্ষার মেঘকালো আকাশ।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে জাপান অন্যতম। সেই থেকে শুরু। তারপর জাপানের সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্রমশ উন্নতি হয়েছে বিগত ৫০ বছরে। বাংলাদেশের বাণিজ্য, অবকাঠামো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাপান তার বন্ধুত্বের হাত সব সময়ই প্রসারিত করে রেখেছে। বাংলাদেশও তার সাধ্যমতো সেই সম্পর্কের উন্নয়নে সচেষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই উপলক্ষে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়েই দুই দেশের বন্ধনেরও সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপন চলেছে। তারই অংশ হিসেবে আয়োজিত হলো 'ইমব্রেস ফ্রেন্ডশিপ' চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনীটির আয়োজন ও উন্মোচন করেছে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) বাংলাদেশ।

চিত্রশিল্পী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রিন্টমেকিং অনুষদের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আনিসের এই ছাপচিত্রগুলো নিয়ে আয়োজিত এ প্রদর্শনীটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত বে'স এজওয়াটার-এর এজ গ্যালারিতে উদ্বোধন করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল ৫ মার্চ পর্যন্ত।

প্রদর্শনীটির উদ্বোধনে একটি ভিডিও বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তার প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, 'এই চিত্র-প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে পেরে আমি সত্যিই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। এটি জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে গৌরবময় বন্ধুত্বকে শ্রদ্ধার সাথে তুলে ধরেছে। নিঃসন্দেহে দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ়। এবং বাংলাদেশ-জাপান সরকার দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও উন্নত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'

প্রদর্শনীর বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ''চিত্র-প্রদর্শনীর এই অনুষ্ঠানটি সফলভাবে উদ্বোধন করার জন্য আমি জেটিআইকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আনিসকেও অভিনন্দন জানাই। 'ইমব্রেস ফ্রেন্ডশিপ' জাপান এবং বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ৫০ বছরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে প্রদর্শিত হচ্ছে। জাপান ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের পাশাপাশি জাপান এই অনুষ্ঠানটিকে একটি স্মারক অনুষ্ঠান হিসেবে সমর্থন করছে।''

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com