
নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়ে যাওয়া গৃহকর্মীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২২ । ১৯:১৪ | আপডেট: ১১ মার্চ ২২ । ১৯:১৪
বরিশাল ব্যুরো

বরিশালে অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়ে যাওয়া গৃহকর্মী মিমকে (১৭) শুক্রবার দুপুরে নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘিয়া এলাকা থেকে উদ্ধার করেছেন মহানগর পুলিশের কোতয়ালী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মোঃ শাহ জালাল। বৃহস্পতিবার দুপুরে মিম গৃহকর্তার কলেজ রোডের বাসা থেকে পালিয়ে যায়। বাঘিয়া এলাকার বাসিন্দা রিক্সাচালক আরিফ মোল্লা মিমকে তার বাসায় নিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী এতিম মিমের বাড়ি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার তুলসিপুকুর গ্রামে। মিমের বাবা অরেন গোমেজ ও মা মনিকা গোমেজ ৭-৮ বছর আগে মারা গেছেন। কাকা স্বপনের মাধ্যমে ১০ বছর বয়সে মিম সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর আকিমুল ইসলামের ঢাকার বাসায় কাজ শুরু করে। আকিমুল ইসলাম গত ১ বছর ধরে কর্মসূত্রে বরিশাল নগরীর কলেজ রোড এলাকায় স্ত্রী সিমু পারভিন ও দুই শিশু সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি কলেজ রোডের ক্যামিষ্ট ল্যাবরেটরিজের প্রশাসন ও অপারেশন বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিওএ)। তার পৈত্রিক বাড়ি উত্তর বঙ্গে।
শুক্রবার বেলা ১ টায় বাঘিয়া এলাকার বাসিন্দা রিক্সাচালক আরিফ মোল্লার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নির্যাতিতা মিম পুলিশের কাছে কাঁদতে কাঁদতে তার ওপর গৃকর্তা ও গৃহকত্রীর চালানো নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছে। মিম পুলিশকে বলে, ‘আমাকে ভোর রাতে জাগিয়ে ঘরের ৪টি বাথরুম পরিস্কার করতে বাধ্য করা হতো। সবার কাপড়-চোপড় ধোয়ার পর রান্না ঘরের কাজে যেতাম। সকালে একটা রুটি খেতে দিত। দুপুরে খেতে দিত গৃহকর্তার শিশু সন্তানদের এঠো খাবার। ২-৩ মিনিটের মধ্যে খাবার শেষ না হলে আমার হাত থেকে খাবারের থালা ফেলে দিত। রাতে ঘুমাতাম মেঝেতে’।
হাত-পায়ে মারধরের কালো দাগ দেখিয়ে মিম জানায়, কারণে-অকারণে গৃহকর্তা আকিমুল ও তার স্ত্রী সিমু পারভিন লাঠি ও খুনতি দিয়ে পেটাতো। দেয়ালে মাথা টাকাতো। এ সময় মিম তার দুই হাত-পায়ের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের কালো দাগ পুলিশ ও সাংবাদিকদের দেখায়। পায়ের নিচে খুনতির পিটিনুতে দগদগে ঘা হয়েছে বলে জানায় মিম।
অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মিম বলে, ‘আমি এতিম। আমাকে কোন বেতন দিত না। ভাল জামা-কাপড় দিত না। ঠিক মত খাবার দিত না। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছি। আমার ওপর নির্যাতনের বিচার চাই। আমি বাঁচতে চাই।'
মিম জানায়, বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টার দিকে গৃহকর্তার বাসায় বৈদুত্যিক মিস্ত্রী আসে। তখন দরজা খোলা পেয়ে কৌশলে গৃহকর্তার বাসা থেকে পালায়।
রিক্সাচালক আরিফ মোল্লা বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের সামনে মেয়েটিকে (মিম) কাঁদতে দেখি। কান্নার কারণ জানতে চাইলে, মিম তার নাম পরিচয় ও বর্বর নির্যাতনের পাশবিক কাহিনী জানায়। অনুরোধ করে তাকে (মিম) কোন খ্রীষ্টান কলোনী এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আরিফ মোল্লা বলেন, মিমের দুর্ভাগ্যের কথা শুনে মায়া লাগে। তখন মিমকে বাসায় নিয়ে যাই। খাবার খেতে দেই। ভাল কাপড়-চোপড় পড়াই। শুক্রবার দুপুরে মিমকে কাশিপুর খ্রীষ্টান কলোনীতে পৌছে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার আগেই পুলিশ আসে।
গৃহকর্মী মিমের অসহায়ত্বের খবর পেয়ে প্রথমে রিক্সাচালক আরিফ মোল্লার বাঘিয়া এলাকার বাসায় যান মহানগরের বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক উত্তম দে। তিনি বিস্তারিত শুনে বাঘিয়া এলাকা কোতয়ালী মডেল থানার আওতাধীন হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে কোতয়ালী থানা পুলিশকে খবর দেন। দুপুর ১ টায় কোতয়ালী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মোঃ শাহজালাল নারী পুলিশ সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মিমকে উদ্ধার করে কোতয়ালী থানার ভিকটিম সার্পোট সেন্টারে নিয়ে আসেন।
শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩ টায় উপ-পরিদর্শক শাহাজালাল সমকালকে বলেন, মিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার অভিযোগগুলো শুনছি। মিমের শরীরে নির্যাতনের আলামত আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ টায় উপ-পরিদর্শক শাহাজালাল কবির সমকালকে বলেন, মিমকে উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। মিমের শরীরে নির্যাতনের আলামত আছে।
কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্য (ওসি) মোঃ আজিমুল করিম সমকালকে বলেন, মিমের অভিযোগগুলো লিপিবদ্ধ করে এজাহার হিসেবে নিয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। নির্যাতনের ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় বাদী হয়েছেন মিম। আসামি করা হয়েছে গৃহকর্তা আকিমুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সিমু পারভিনকে।
পুরো অভিযোগের বিষয়ে গৃহকর্তা মেজর (অব:) আকিমুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মিমের ওপর তারা কোন নির্যাতন করেননি। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে মিম নিখোঁজ ছিল। পালিয়ে গিয়ে সে এখন নির্যাতনের কল্প-কাহিনী বলছে।
নিখোঁজ হওয়ার পর থানায় জিডি করেছেন কিনা জানতে চাইলে আকিমুল ইসলাম বলেন, কোন জিডি করেননি। আকিমুল ইসলামের স্ত্রী সিমু পারভিনের বক্তব্য জানতে কলেজ রোডের বাসায় গিয়ে প্রধান গেট বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com