ইউক্রেন সংকট

পুতিন যে যুদ্ধ চাননি

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মারওয়ান বিশারা

আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন এই যুদ্ধ চাননি। এটি তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি তার 'প্রিয়' ইউক্রেনে হামলা এড়াতে সব করেছেন। কিন্তু এমন ক্ষমতাবানের পক্ষে কতটা সহনশীল হওয়া সম্ভব? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছিলেন- ইউক্রেন রাশিয়ার প্রতিবেশী। রাশিয়া যদি ইউক্রেনকে না পায়, তবে কেউই পাবে না।

কিন্তু হায়! কেউই তার কথা শুনল না। রাশিয়াও তার সম্মান রাখল না। ইউক্রেনে হামলার মাধ্যমে রাশিয়া যা করেছে, তা কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং আধুনিক জারের মাধ্যমে তার পৌরুষ প্রকাশ করেছেন অমানবিকভাবে। আগ্রাসী পুরুষ মানে আমি পুতিনের বরফে সাঁতার কাটা, কুস্তি যুদ্ধ কিংবা খালি গায়ে ঘোড়দৌড়ের দিকে ইঙ্গিত করছি না। বরং রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে দেশটির স্বার্থে ব্যবহারে তার দৃঢ়তা ও ঐকান্তিকতার কথা বলছি। পুতিন কয়েক বছর ধরে পশ্চিমাদের সতর্ক করে ভূ-রাজনৈতিক হঠকারিতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে রাশিয়ার প্রভাবাধীন অঞ্চল ইউক্রেনে মাছ শিকার না করার কথা বলছিলেন। ইউক্রেনে হামলার আগে সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা পুতিনের বক্তব্য ছিল আবেগি ও তিক্ত। পশ্চিমারা তাকে এমন জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে তার আর বিকল্প ছিল না। যখন তিনি হামলা করেন ততক্ষণে আসলে দেরি হয়ে যায়।

পুতিন হতাশা ও ঈর্ষায় সহনশীল হতে পারতেন, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেননি। ইউক্রেন সেটাই করেছে। ৩০০ বছরের সম্পর্ক ভুলে, রাশিয়ার অবদান অস্বীকার করে, তার অবস্থানের বিষয়টি চিন্তা না করে ইউক্রেন তাই করেছে। তার চেয়ে দুঃখজনক বিষয়, অনেকটা বিশ্বাসঘাতকের মতো ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের হাতের 'স্প্রিংবোর্ড' হিসেবে কাজ করেছে। ইউক্রেনের এই অবস্থান পুতিন রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে ভয়ংকর হিসেবে দেখেছেন। রাশিয়া দেখেছে, পূর্বর্ ইউক্রেনের মানুষ ২০১৪ সাল থেকে ৮ বছর অমানবিক আচরণের শিকার। তাই তাদের রক্ষায় পুতিনকে তৎপর হতেই হয়। বস্তুত রাশিয়ার সাম্প্রতিক লক্ষ্য হলো, দেশটি রাশিয়ানদের রক্ষায় যা ইচ্ছা সবই করবে। এর মধ্যে ইউক্রেনে বসবাসরত এক কোটি ২০ লাখ রাশিয়ানও রয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের রাশিয়ানদের জন্য পুতিন সাত লাখ ২০ হাজার পাসপোর্ট দ্রুত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ক্রিমিয়াতে ২০১৪ সালে তিনি তাই করেছিলেন। আবার তিনি এসবের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। তবে এসবের কোনোকিছুই হঠাৎ 'সারপ্রাইজ' হিসেবে আসেনি।

শীতল যুদ্ধ সমাপ্তির পর এবং পুতিনের ক্ষমতা গ্রহণের আগে রাশিয়া দুই ধরনের ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখেছিল। প্রথমটি হলো, কৌশলগত হুমকি। বিশেষত পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে। দ্বিতীয়টি, সোভিয়েত ভেঙে সৃষ্টি হওয়া নতুন দেশগুলোর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। রাশিয়া নব্বইয়ের দশকের অধিকাংশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়েছিল। তারা গণতান্ত্রিক সংস্কারে এগিয়ে এসেছিল। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টিও রাশিয়া বিবেচনা করছিল। তখন ন্যাটো তেমন আগ্রহ দেখায়নি। শুধু এখানেই নয়; ভদ্মাদিমির পুতিনের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়ার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ন্যাটো দেশটিকে সদস্যপদ দেয়নি। বরং তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ওয়ারশ প্যাক্ট গঠন করার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।


মজার বিষয় হলো, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি ও ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার প্রতি ওয়ারশ প্যাক্টের ভুল পুতিন স্বীকার করেছেন। তখন রুশোফোবিয়া যা করেছে, এখন পূর্ব ইউরোপে আমরা তা দেখছি। 'বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বিপর্যয়' সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ভদ্মাদিমির পুতিন উদ্বিগ্ন হলেও তিনি এর পুনরুত্থান চাননি। বরং অসংখ্য রাশিয়ানের মতো তিনিও এ ভাঙনে বিলাপ করছিলেন। এমনকি পশ্চিমাদের পছন্দের ভিন্নমতাবলম্বী রাশিয়ান এলেক্সে নাভালনিও মস্কো কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল সমর্থন করেছিলেন।

যা হোক, সেখান থেকে পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিক গৌরব পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনার শপথ নেন। পুতিনের পদক্ষেপ সে লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি কাজাখস্তানে সাম্প্রতিক ভূমিকাও তার বাইরে নয়। বলাবাহুল্য, ইউক্রেন ছাড়া রাশিয়ার গৌরব কখনোই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারণ ইউক্রেন 'রাশিয়ান জাতির জন্মভূমি'। ইউক্রেন নিয়েই পুতিন রাশিয়াকে আবার 'গ্রেট' বানাতে পারেন। তার মানে ইউক্রেনই মুখ্য।

পুতিন চেষ্টা করছিলেন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আপসে সংকট উত্তরণের জন্য। এমনকি তিনি ইউক্রেনের ইচ্ছার প্রতিও সম্মান জানানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু সে পথে ইউক্রেন হাঁটেনি। ইউক্রেন যখন রাশিয়ার প্রভাব অস্বীকার করে তখন পুতিন চেয়েছিলেন, তারা বেলারুশের মতো 'বাফার স্টেট' বা নিরপেক্ষ থাকুক কিংবা দেশটির নিরস্ত্রীকরণ হোক। কিন্তু যখন ইউক্রেন এসব অস্বীকার করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে পশ্চিমামুখী হয়, তখনই পুতিন তার পৌরুষদৃপ্ত চেহারা প্রকাশে বাধ্য হন। ইউক্রেন যখন রাশিয়ার দরজায় যাকে ইচ্ছা আমন্ত্রণ জানায় তখন স্বাভাবিকভাবেই পুতিন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। অথচ পুতিন রাশিয়া কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই ইউক্রেনের বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন।

পুতিন বিশ্বাস করেন, রাশিয়া পরাশক্তি হওয়ার জন্য জন্মেছে। কারণ জাতি হিসেবে রাশিয়া হওয়ার আগেও এটি ছিল সাম্রাজ্য। পুতিনের মতে, ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী জাতি রাশিয়া। চীন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাদের সংশ্নিষ্ট অঞ্চলে শাসন করার অধিকার তার রয়েছে এবং তারা সবাই মিলে শাসন করবে বিশ্ব। যে কারণে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী তার প্রভাব বলয় বাড়িয়ে সেভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে, যাতে পশ্চিমারা কাজে ও কথায় মস্কোর ক্ষমতা স্বীকার করে।

তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশিয়ান ফেডারেশন এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। রাশিয়ার অর্থনীতিও খুব বড় নয়। এমনকি মধ্য আকারের ইতালির চেয়েও ছোট। পুতিন হয়তো ভুলে গেছেন, সোভিয়েত সাম্রাজ্য পশ্চিমাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা গোয়েন্দা শক্তি কম থাকার কারণে হারেনি বরং দুর্বল অর্থনীতির কারণেই হেরেছে। সে জন্য ব্যাপক অবরোধের কারণে ইউক্রেনে পুতিনের 'অ্যাডভেঞ্চার' রাশিয়ার জন্য বিধ্বংসী হতে পারে।

তাছাড়া ইউক্রেনীয়দের স্বাধীনতা ও রাশিয়ার প্রভাব থেকে নিজেদের বেঁচে থাকার ইচ্ছার বিষয়টিও অস্বীকারের উপায় নেই। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ের রেষারেষিতে যদি ইউক্রেনকে দ্বিতীয় আফগানিস্তান বানানো হয়, তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ হবে।

যা হোক, যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা এখনও খুব দেরি হয়ে যায়নি। ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য এখনই ব্যাপক ও আন্তরিক আলোচনা হওয়া জরুরি। পুতিন অবশেষে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন তাকে সৃষ্টির পরিবর্তে বিচক্ষণ হতে হবে।

মারওয়ান বিশারা: লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com