ইতিহাসের পালাবদলের রাষ্ট্রপতির জীবনাবসান

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২০ মার্চ ২২ । ০২:১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল প্রতিবেদক

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ (১৯৩০-২০২২)

দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে সব রাজনৈতিক দলের বিরল ঐকমত্যে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে সময়ে রাষ্ট্রপতি পদ এখনকার মতো আলংকারিক নয়; সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে প্রয়োজনের বেশি এক দিনও থাকতে রাজি ছিলেন না। এ কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকা সেই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আর নেই। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ৯২ বছর বয়সে গতকাল শনিবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের শীর্ষ রাজনীতিক ও বিশিষ্টজন।

গতকাল বিকেলে সাহাবুদ্দীন আহমদের মরদেহ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে তার জন্মস্থান নেত্রকোনার কেন্দুয়ার পেমই গ্রামে নেওয়া হয়। সেখানে গার্ড অব অর্নার শেষে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ রোববার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন।

১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওই বছরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলগুলোর নেতৃত্বাধীন তিন জোটের আন্দোলনে এরশাদের পতন হয়। প্রশ্ন দেখা দেয়- কে হবেন রাষ্ট্রপতি। কার অধীনে হবে পরের নির্বাচন? তিন জোট সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপ্রধান করতে একমত হলেও তিনি বিচারালয় ছাড়তে রাজি ছিলেন না। নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাবেন- এই শর্তে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে মিনিট দশেক পর তার কাছে পদত্যাগপত্র দেন এরশাদ। এর মাধ্যমে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনের সরকার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পরিচিত পায়। তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খানের 'এরশাদের পতন ও সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী শাসন' বইয়ে সে সময়ের বর্ণনা ও বিশ্নেষণ উঠে এসেছে। মনজুর রশীদ লিখেছেন- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসেরও কম সময়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সেই নির্বাচন ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু।

নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকার গড়লেও তখনও রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা ছিল। মনজুর রশীদ লিখেছেন, ক্ষমতা থাকার পরও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাজে হস্তক্ষেপ করেননি সাহাবুদ্দীন আহমদ; বরং দ্রুত সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাগিদ দিয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভাশাসিত সরকার পদ্ধতির চেয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হয়। সংশোধনীতে সই করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নিজের ক্ষমতা কমানোর বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

সরকার ও বিরোধী দলের বিরল সমঝোতায় সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর ৩০৮ দিন দায়িত্ব পালন শেষে রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে যান সাহাবুদ্দীন আহমদ। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে রাষ্ট্রপতি পদে তাকে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় দফায় তিনি আলংকারিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাঁচ বছর ৩৬ দিন দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গভবনে থেকেও নিজ খরচে ব্যয় নির্বাহ করে সততার দৃষ্টান্ত হিসেবে এত বছর পরও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তিনি।

২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর বঙ্গভবন থেকে বিদায়ের পর গুলশানের বাড়িতে নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। গতকাল সিএমএইচ থেকে তাকে শেষবারের মতো গুলশানের প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে নেওয়া হয়। সেখানে গোসল করানো হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে ২০০৫ সালে মারা গেছেন। বাকি সন্তানদের মধ্যে দুই মেয়ে বিদেশে রয়েছেন। দুই ছেলে বাবার মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন।

সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। তার মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী শোক প্রকাশ করেছেন। আজ রোববার সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের অবসরকালীন বেঞ্চের কার্যক্রম সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বন্ধ থাকবে।

সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী শোক জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকসহ প্রায় সব দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন।

মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনসহ অনেকেই শোক জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও শোক প্রকাশ করেছেন।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com