তামাকের অভিশাপ থেকে দরিদ্র মানুষকে বাঁচাতে হবে

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২২ । ১৮:৫৫ | আপডেট: ২৯ মার্চ ২২ । ১৯:২৫

মো. ফরিদুল হক খান

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যে পথনকশা আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, আমরা সে পথেই এগিয়ে চলেছি। আর এ অগ্রযাত্রায় যোগ্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। করোনা মহামারির মধ্যেও মাথাপিছু আয় বেড়ে আড়াই হাজার ডলারের বেশি হয়েছে। এই খবরগুলো খুশি হওয়ার মতো বটে। তবে একই সঙ্গে আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার পথে চ্যালেঞ্জ নিয়েও ভাবতে হবে। আমাদের দেশে যারা প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষ তাদের কাছে উন্নয়নের সুফল যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের প্রধানতম কর্তব্য। এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীই কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। সবশেষ করোনা মহামারির সময়েও আমরা দেখেছি, তারাই সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন। বর্তমানে বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াতেও তারা নতুন করে চাপের মুখোমুখি হতে শুরু করেছেন। সরকার নিশ্চয়ই তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে তাদের জীবনযাপন যেন এ দুর্যোগের মধ্যেও যতটা সম্ভব মসৃণ রাখা যায়।

সব সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র মানুষদের নিয়ে আলাদা করে ভাবা দরকার। এ প্রেক্ষাপটে দরিদ্র পরিবারগুলোর তামাকপণ্য ব্যবহারের রাশ টেনে ধরার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া চাই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে দেখা যায়, এ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের আয়ের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি ব্যয় করে ফেলছে তামাকপণ্যের পেছনে। অর্থাৎ তাদের যদি এ তামাকপণ্য ব্যবহার থেকে বিরত করা যায় বা অন্তত তাদের তামাক ব্যবহারের পরিমাণ কমানো সম্ভব হয় তবে তারা একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারবেন। ওই অর্থ তারা অন্য কাজে ব্যবহার করে নিজেদের জীবনমান উন্নত করতে সক্ষম হবেন। বলা বাহুল্য, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের পেছনে যে সরকারি টাকা ব্যয় হয় তাও বেঁচে যাবে। আমি নিজে চরের মানুষ। এখনও চরের মানুষের ভোটেই জনপ্রতিনিধি হয়ে দেশ সেবায় নিয়োজিত আছি। চরাঞ্চলের দারিদ্র্য দেশের গড় দারিদ্র্যের চেয়ে বেশি। তাই দরিদ্র মানুষকে তামাকের অভিশাপ থেকে রক্ষার বিষয়টি আমাকে আলাদা করে ভাবায়।

মোট জনসংখ্যার তুলনায় তামাকপণ্য ব্যবহারকারীর অনুপাতের বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের একটি। প্রতি বছর তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেড় লাখের বেশি মানুষ এ দেশে মৃত্যুবরণ করেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে পরবর্তী দুই দশকের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সে অনুসারে প্রতি বছর বাজেটেই তামাকপণ্যের ওপর কর বাড়ানোর মাধ্যমে এগুলোকে মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু শুরুতেই যেমন বলেছি, আমাদের মাথাপিছু আয় দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু তামাকের ওপর কর যে গতিতে বাড়ানো হচ্ছে, মাথাপিছু আয় তার চেয়ে বেশি গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তামাকপণ্য দরিদ্র মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। ফলে তামাকমুক্ত দেশ গঠনের দিকে যে গতিতে এগিয়ে যাওয়া দরকার, তা দৃশ্যমান হচ্ছে না। ২০২১-২২ অর্থবছরেও কেবল দামি সিগারেটের খুচরা মূল্য সামান্য বাড়ানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে নানামুখী চাপে থাকায় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠনগুলোর সুপারিশ সেভাবে আমলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট আগামী জুন মাসে মহান জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত হবে। দেশের অর্থনীতিও এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এবারও তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন, গবেষক এবং কর্মীরা একত্রিত হয়ে তামাকপণ্যে যথাযথ করারোপের প্রস্তাবনা সামনে আনতে শুরু করেছেন। আমার বিশ্বাস, এ বছর তাদের প্রস্তাবনাগুলো যতটা সম্ভব জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হবে।

২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী যখন তামাকমুক্ত দেশ গঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন সে সময়ই এই মহৎ লক্ষ্য অর্জনের পথনকশা আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তামাকপণ্যে করের কাঠামো ঢেলে সাজানো হবে এবং এক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা দাঁড় করানো হবে যাতে তামাকপণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির ফলে এগুলোর ব্যবহার কমে আসার পাশাপাশি তামাকপণ্য বিক্রি থেকে আসা রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তামাকবিরোধী অংশীজনরা আসন্ন অর্থবছরে তামাকপণ্যে করের যে প্রস্তাবনা হাজির করেছেন, তাতে ১৩ লাখ ব্যক্তির তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হওয়া, ৯ লাখ কিশোর বা তরুণের তামাক ব্যবহার শুরু না করা এবং প্রায় ৯ লাখ অকাল মৃত্যু রোধ হওয়ার পাশাপাশি বাড়তি রাজস্ব হিসেবে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা আসার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটি বাস্তবায়নের জন্য এ প্রস্তাবনাগুলো বিশেষ সহায়ক হতে পারে। তাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বাজেট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সব কর্তৃপক্ষেরই উচিত হবে এই প্রস্তাবনাগুলো যথাসম্ভব আমলে নেওয়া।

তবে মনে রাখা চাই, রাজস্ব আয় বাড়া বা কমা নয়; তামাকপণ্য ব্যবহার কমিয়ে আনার মূল লক্ষ্য হলো জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া তামাকপণ্য বিক্রি থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যায় তার তুলনায় এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৩৪ শতাংশ বেশি। সাধারণভাবেই তামাক বর্জনীয়। ইসলাম ধর্মেও তামাক অগ্রহণীয় বলা হয়েছে। তাই দেশের মানুষকে, বিশেষত যারা দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের তামাকের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে তামাকপণ্যের ওপর যথাযথ করারোপ করার এখনই সঠিক সময়। এ কারণে সাম্প্রতিককালে তামাকবিরোধী নাগরিকদের পাশাপাশি সংসদ সদস্যরাও তামাকপণ্যে যথাযথ করারোপের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। এভাবে সব অংশীজন যদি একত্রে মতবিনিময় করেন এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া যায় তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে দেশকে তামাকমুক্ত করা সম্ভব হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।


© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com