
পরিবেশ
খরা ও মরুময়তার দিকে পদ্মাতীরের জনপদ
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২২ । ০২:৫৮ | প্রিন্ট সংস্করণ
মেজবাহ উদ্দিন তুহিন

প্রমত্ত পদ্মার তীর ঘেঁষে অনেক আগে নদীকেন্দ্রিক নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠলেও বর্তমানে পদ্মার তীরের জনপদ নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। এক সময় ছিল পদ্মার উত্তাল যৌবন। কালের আবর্তে পদ্মার বুকে চর জেগে এখন সেখানে বাড়িঘর, গাছপালার সমাহার। তবে বর্ষায় এসব বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যায়।
শীত ও শুস্ক মৌসুমে স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্ত পানি দিয়ে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ হয় না এ জনপদের মানুষের। সৃষ্টি হয় পানির টানাপোড়েন। উজানের ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব পড়ছে এখানে। পানি প্রবাহ না থাকায় শুস্ক মৌসুমে প্রচণ্ড খরা এবং বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে জলবায়ু ক্রমেই মরুময়তার দিকে যাচ্ছে।
জীববৈচিত্র্যের বিনাশসহ পরিবেশগত নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় সেচের জন্য ২৫ শতাংশ পানির চাহিদা মিটত নদীনালা ও খালবিল থেকে। এখন তা অতীত স্মৃতি। ফলে গভীর নলকূপের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক ওপরের দিকে উঠে আসছে। গ্রীষ্ফ্মকালে তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি এবং শীতে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তাপমাত্রার সমন্বয় না হওয়ায় ভবিষ্যতে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ঘটে এ অঞ্চল মরুময়তার দিকে ধাবিত হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টির উৎপত্তি হিমালয়সহ ভারতের অন্যান্য উৎস থেকে। পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি নদী মরুনদীতে পরিণত হয়েছে। পদ্মার উৎপত্তি ভারতের গঙ্গা থেকে। আর হিমালয়ের হিমশৈলে অলকানন্দা এবং ভাগিরথী- এই দুই ধারায় গঙ্গার উৎপত্তি। এই দুটি নদী ভারতের উত্তরপ্রদেশের তেহরি গুরুয়াল জেলার গঙ্গোত্রীর কাছে দেবপ্রয়াণ নামক স্থানে মিলিত হয়ে গঙ্গা নামে হরিদ্বারের কাছে ভারতের সমতল ভূমিতে প্রবেশ করে। পরে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করে। বাংলাদেশে রাজশাহীতে প্রবেশের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী শহর, সারদা ও বাঘার তীর বেয়ে হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ হয়ে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দের উজানে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
বাঘা উপজেলা সদর থেকে পিচঢালা সড়ক বেয়ে মাত্র দুই কিলোমিটার দক্ষিণে পদ্মা নদী। এক সময় এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করত বাঘসহ নানা বন্যপ্রাণী। জনশ্রুতি আছে, বাঘ হেঁটে পদ্মার তীরে গিয়ে হুংকার ছেড়ে স্বচ্ছ পানিতে নিজ চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখত। পদ্মার পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাত বন্য প্রাণিকুল। কালের আবর্তে এসবই এখন গল্প-স্মৃতি। এখানে তৈরি হয়েছে উপজেলা সদর ও জনপদ রক্ষায় বেড়িবাঁধ। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা ও জীবন-জীবিকার তাগিদে জনপদ গড়ে উঠলেও এখন তা বদলে গেছে ভিন্ন আদলে। নদীতে চর জেগে ওঠা, নাব্য হ্রাস এবং বর্ষা মৌসুমে বন্য হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এ এলাকার মানুষ। চর জেগে বন্ধ হয়েছে নৌপথ। মৎস্য ও পশুসম্পদ বিলীন হওয়ার পথে। জীবিকা হারিয়েছে পদ্মার ওপর নির্ভরশীল নানা পেশার মানুষ। অনেকেই হারিয়েছে বাস্তুভিটা, যেখানে কেটেছে তাদের শৈশব-কৈশোর।
পদ্মার উত্তর তীরের জনপদ পানিকামড়া, কালিদাসখালি, নারায়ণপুর, বিলবাড়িয়া। নদীর তীরের এসব গ্রাম আম্রকাননসহ নানা প্রাকৃতিক শোভায় বর্ণিল হলেও বর্ষার চিত্র করুণ। বেড়িবাঁধ হওয়ার ফলে উপজেলা সদরের মানুষকে তেমন একটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় না, তবে যেভাবে পদ্মা ভাঙছে তা অব্যাহত থাকলে এক সময় হয়তো বেড়িবাঁধও ধ্বংস হয়ে যাবে। হাল আমলের বর্ষা মৌসুমের মতিগতি ঠিক না থাকা এবং উজানের পানি প্রবাহের ফলে বিলীন হয়েছে ও হচ্ছে আম্রকাননসহ হাজার হাজার একর ফসলি জমি, জনবসতি। আবার খরা মৌসুমে পানিশূন্য নদীতে চর জেগে ওঠায় তৈরি হয় করুণ চিত্র। যেখানে এক সময় পানিতে সয়লাব থাকত। সেখানেই এখন পানির অভাবে মানুষ ও পশুপাখি তৃষ্ণার্ত। এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মার বর্তমান ক্ষীণকায় রূপের লাবণ্যহীনতা সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় জনগণের কাছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নদীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে এই নদী গড়ে তুলেছে জনপদ, ব্যবসায়িক ও শিল্প কারখানার কেন্দ্রবিন্দু। সৃষ্টি হয়েছে সমাজের অগ্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্য। অপরদিকে এসব নদনদীর ভাঙন ও প্লাবনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে মানুষের দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি। রাজশাহীর নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, লোকগাথা, লোকগীতির পরিস্ম্ফুটন ঘটেছে পদ্মাকে কেন্দ্র করে। খুঁজে পাওয়া যায় এ এলাকার ঐতিহ্য ও শেকড়ের স্বরূপ। দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন করতে না পারলে অন্যান্য খরা অঞ্চলের মতো পদ্মাতীরের জনপদও হয়তো রক্ষা পাবে না।
ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন: গবেষক ও কলামিস্ট, পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাউবি
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com