
প্রতিবেশী
আরএসএস-এর জ্বালানো আগুন ভারতকে ছারখার করে দেবে
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২২ । ০২:৫৮ | প্রিন্ট সংস্করণ
অরুন্ধতী রায়

আলোচনাটি আমি শুরু করতে চাই তা ভারতের সেসব মানুষের প্রতি উৎসর্গ করে, যারা শুধু নিজেদের বিবেক অনুযায়ী কথা বলার জন্য দেশটির বিভিন্ন কারাগারে বন্দি আছেন। আমি স্মরণ করতে চাই গোকারাকোন্ডা নাগা (জিএন), সাঁইবাবাসহ সেসব পণ্ডিত, অ্যাক্টিভিস্ট, সংগীতশিল্পী ও আইনজীবীদের, যাদের ভিম কোরিগাঁ ১৬ বলে ডাকা হয়; স্মরণ করছি সেই অ্যাক্টিভিস্টদের, যারা নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার দায়ে এখনও জেলে আছেন এবং কাশ্মীরে পাঁচ মাস আগে গ্রেপ্তার হওয়া খুররম পারভেজকে, যিনি তার সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটির (জেকেসিসিএস) মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীরের জনগণের ওপর যে খুন, নির্যাতন, গুম নামিয়ে আনা হয়েছে তা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে নথিভুক্ত করে যাচ্ছিলেন।
ভারতে ভিন্নমত মাত্রই এখন অপরাধ। সেখানে ভিন্নমতের মানুষকে অ্যান্টি-ন্যাশনাল বা জাতির শত্রু হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আমাদের প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী বুদ্ধিজীবী বলে ডাকা হচ্ছে। সেই ভয়ংকর আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ)-যার মাধ্যমে যে কাউকে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলে রাখা যায় তা কিছুদিন আগে সংশোধন করা হয়েছে শুধু বর্তমান সরকার যাদের সন্ত্রাসী বুদ্ধিজীবী মনে করেন তাদের শায়েস্তা করার জন্য। আমরা নাকি আরবান নকশাল বা জেহাদি; আর এটা বলে আমাদের বিরুদ্ধে উন্মত্ত জনতাকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা আমাদের আইন দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে।
গত মার্চে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে নজিরবিহীনভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। উত্তরপ্রদেশের এ নির্বাচনটাকে সাধারণত ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের সেমিফাইনাল বলে ধরা হয়। মনে হচ্ছে, এ বিজয় বিজেপির নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ ও অতি আত্মবিশ্বাসের মিশ্রণে গঠিত একটা অদ্ভুত ভাব তৈরি করেছে। নির্বাচনী ফল বের হওয়ার পরপর হিন্দুদের রামনবমী উৎসব ছিল। এ বছর একই সময়ে রমজানও চলছে। এবারের রামনবমীতে উগ্র হিন্দুরা তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ১১টি শহরে তাণ্ডব চালায়। ধর্মীয় সাধু ও বিজেপি কর্মীদের নেতৃত্বে তারা মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মসজিদের সামনে গিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানায়; একই সঙ্গে চলে নানা অশালীন স্লোগান, মুসলিম নারীদের ধর্ষণের মাধ্যমে প্রেগন্যান্ট করা, এমনকি মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর আহ্বান।
কিন্তু মুসলিমরা যখন এর প্রতিবাদ করতে গেছে তখন তাদের সম্পত্তি হয় সরকারি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নতুবা উন্মত্ত জনতার দ্বারা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার পর যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই মুসলিম; তাদের বিরুদ্ধে দাঙা লাগানোর ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয়েছে। সম্ভবত এ অভিযোগে তাদের বছরের পর বছর জেলে থাকতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, এ অভিযুক্তদের একজন আগে থেকেই অন্য এক মামলায় জেলে আছেন; ওয়াসিম শেখ নামে একজনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মিছিলে পাথর ছোড়ার অভিযোগ আনা হয়েছে, যার দুই হাত, দুই পার কোনোটাই নেই। ঘটনার সময় কোনো কোনো শহরে বুলডোজারের ওপর দাঁড়িয়ে টিভিতে তা ব্রডকাস্ট করা হচ্ছিল!
এদিকে ২০২০ সালের দিল্লির গণহত্যার আগে যে বিজেপি নেতারা হিন্দু দাঙ্গাকারীদের উস্কানি দিয়েছিল সম্প্রতি তাদের দিল্লি হাইকোর্ট ওই অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে এই বলে যে, যখন কেউ হাসতে হাসতে কোনো উস্কানিমূলক কাণ্ড করে তখন তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। ওই খালাসপ্রাপ্তরা এখন এলাকায় ফিরে আবারও একই অপকর্ম করে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিজেপি নেতাদের যখন খালাস দেওয়া হয় তখন তরুণ মুসলিম স্কলার ওমর খালিদ জেলে পচে মরছেন। সিএএবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ভারতীয় সংবিধানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও অহিংসার কথা বলেছিলেন। তবে পুলিশ বলেছে, এটা ছিল ওমরের একটা ছল মাত্র; এর আড়ালে নাকি তিনি দাঙ্গায় উস্কানি দিয়েছেন। পুলিশের কথা মানলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় মুসলমানরাই ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য দাঙ্গা করে নিজেরা নিজেদের খুন করেছে।
এগুলো করেও নরেন্দ্র মোদি, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানোর পর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে যাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, এখনও এক প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। প্রায়ই নীরব থাকলেও অনেক সময় তিনিই যুদ্ধের ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। ওই উন্মত্ত জনতার কাছে মোদি একদিকে হলেন ত্রাতা, আরেকদিকে পবিত্র মানুষ, যে জনতাকে তৈরি করা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভুল ইতিহাস পড়িয়ে পড়িয়ে। তাদের বলা হয়েছে, মুসলমানরা তোমাদের ইতিহাসের একটা সময়ে নির্যাতন করেছিল; এখন সময় এসেছে এর প্রতিশোধ নেওয়ার।
এ এক ইতিহাস যেখানে এমন কোনো ফ্যাক্ট নেই, যার সঙ্গে একমত হওয়া তো দূরের কথা, তর্কও করা যায় না। এগুলো হলো ইতিহাসের বিপরীতে মিথ বা পুরাকথা। এ পুরাকথা প্রচার করছে রাষ্ট্র, করপোরেট পুঁজি এবং ২৪ ঘণ্টার অসংখ্য নিউজ চ্যানেল। এগুলো যত পরিমাণ মানুষের কাছে পৌঁছায় তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। আমরা জানি, যেখানে যুক্তিতর্ক করার সুযোগ থাকে না সেখানেই লম্বা যুদ্ধ শুরু হয়।
ভারতে মুসলমানদের এখন হিটলারের সময়কার জার্মান ইহুদিদের মতো ঘেটোতে বাস করতে হচ্ছে। তারা একঘরে এবং আর্থিক-সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার। মুসলিমরা এখন নিয়মিতভাবেই লাভ জেহাদে (হিন্দু নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের মাধ্যমে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল) অভিযুক্ত হতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মুসলমানরা করোনা জেহাদ (উদ্দেশ্যমূলকভাবে করোনা ছড়ানো- হিটলার যেমন ইহুদিদের বিরুদ্ধে টাইফাস রোগের জীবাণু ছড়ানোর অভিযোগ করত), জব জেহাদ (ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরি বাগিয়ে হিন্দুদের শাসন করার চক্রান্ত) ইত্যাদি চালাচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করলে বা সামান্য কোনো ভুল করলে একজন মুসলমানকে গণপিটুনিতে খুন হতে হচ্ছে, যদিও হত্যাকারীরা ফুলের মালা দিয়ে বরিত হচ্ছে, সুখের ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি পাচ্ছে।
ভারত একটা দেশ হিসেবে, একটা আধুনিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে; এর একমাত্র কারণ হলো একটা সংবিধান এখানকার বহু ধর্মের, বহু ভাষার, বহু বর্ণের, বহু নৃগোষ্ঠীর এবং জাতিসত্তার মানুষকে একটা সামাজিক বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। প্রত্যেক ভারতীয় কোনো না কোনোভাবে একটা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ফলে আমাদের দেশটা সংখ্যালঘুদের মধ্যকার একটা সামাজিক বন্ধনের ফসল। রাজনৈতিকভাবে একটা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবে এখানে ওই সামাজিক বন্ধনকে ধ্বংস করে কৃত্রিমভাবে একটা 'সংক্ষুব্ধ হিন্দু সংখ্যাগুরু' গঠন করা হচ্ছে; তাদের বোঝানো হচ্ছে যে সাধারণভাবে যাকে হিন্দু জাতি বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে তোমরাই হলে সে জনগণ, যারা জাতির শত্রু বলে বিবেচিত 'অপর'-এর বিপরীতে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। অর্থাৎ ভারতের এখানেই সমাপ্তি।
আমরা যারা ভারতে আছি তাদের এখন একটাই করণীয়; হয় সর্বজনীন ন্যায়বিচার অর্জন ও যন্ত্রণাকে ঝেরে ফেলার লক্ষ্যে কাজ করা এবং যা আমাদের যৌথ স্মৃতিকে মুছে দিতে চায় তাকে ঘৃণা করা নতুবা তাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তার নেতৃত্বাধীন দলটি এবং তার মাতৃসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও (আরএসএস) যে ফ্যাসিবাদী সংস্থাটির তিনিও একজন সদস্য- ওই ঘৃণাকে আরও বাড়ানোর পক্ষে। তারা যে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তা শুধু তাদের তৈরি পথে এগোবে না; এটা গোটা দেশকেই পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। ইতোমধ্যে সে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। এ আগুনে শুধু ভারত ও কাশ্মীরের মুসলমানরা পুড়ছে না, খ্রিষ্টানরাও তা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শুধু গত বছরে শত শত চার্চের ওপর হামলা হয়েছে, যিশুর মূর্তিকে অপমান করা হয়েছে, পাদ্রি ও নানেরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
ভারত এখন এমন ব্যক্তিরা শাসন করছেন, যারা ক্ষমতায় এসেছেন হাজার হাজার মুসলমানের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে; এ মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা চালানোর ভূতুড়ে এক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে। অস্বীকার করা যাবে না, ভারতে এ ঘৃণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যও মানুষ আছে; তারা আছেন প্রতিটি ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে; তাদের দেখা গেছে সিএএবিরোধী আন্দোলনে, গত বছরের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ূ, কেরালা ও মহারাষ্ট্র থেকেও একই বার্তা পাওয়া গেছে, যেখানে আঞ্চলিক দলগুলো সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করে বিজেপিকে নির্বাচনে পরাস্ত করেছে। এটাও বলা যায় যে, ভারতের বেশিরভাগ মানুষ বিজেপির এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না।
তবে বিজেপির প্রতি তাদের এ বিরাগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজেপির ওই কাজগুলোর প্রতি নিছক বিতৃষ্ণা বা অনাগ্রহ দেখানো বা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যা মোটা বেতনের ফ্যাসিবাদী ক্যাডারদের প্রবল আদর্শিক তেজের সামনে অকার্যকর বলেই মনে হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, দেশের একমাত্র জাতীয় বিরোধী দল, একটা নৈতিক অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রেও এতটা দুর্বল যে মুসলিম শব্দটাও এদের নেতাদের প্রকাশ্য ভাষণে উচ্চারিত হতে দেখা যায় না। মোদি যে কংগ্রেসমুক্ত ভারতের ডাক দিয়েছেন তার লক্ষ্য ভারতকে বিরোধী দলশূন্য করা। এ অবস্থাকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক তা অন্তত গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না। ভারতে এখনও একটা নির্বাচনী গণতন্ত্র আছে; একটা সংবিধান আছে, যার বলে আমরা দেশটিকে একটা সেক্যুলার ও সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে দাবি করি, যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে; একটা স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং মুক্ত গণমাধ্যম আছে। কিন্তু বাস্তবে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা (বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো, গোয়েন্দা বাহিনীগুলো, পুলিশ এবং নির্বাচন যন্ত্রসহ) এখনও পুরোপুরি আরএসএসের পেটে না গেলেও ব্যাপকভাবে ভারতের এ হিন্দু জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী ও সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা প্রভাবিত। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সংবিধানটি সরিয়ে রেখে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা উচিত। সংগঠনটির প্রচারকরা প্রকাশ্যেই হিটলারের প্রশংসা করে থাকেন এবং মুসলমানদের জার্মানির ইহুদিদের সঙ্গে তুলনা করেন।
আর্য শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা মনে করে, কিছু মানুষ ঈশ্বরের মতো; তারা স্বর্গ থেকে এসেছে স্বর্গে চলে যাবে; আর অন্যরা হলো মানবেতর প্রাণী, যারা দূষিত এবং অস্পৃশ্য। ব্রাহ্মণ্যবাদ বা হিন্দুদের বর্ণপ্রথা, যা আজকের হিন্দু সমাজেরও মূলনীতি, তার ভিত্তিই হলো ওই আর্য শ্রেষ্ঠত্ববাদ। দুঃখজনক হলো, আজকেও নিপীড়িতদের অনেকে আরএসএসের এ আদর্শের পেছনে দৌড়াচ্ছে। তারা ফ্যাসিবাদী ওই সংগঠনটির প্রচারণার জোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে ভোটের মাধ্যমে ওই শক্তিকে তাদেরই ওপর খবরদারি করার কর্তৃত্ব দিচ্ছে। ২০২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার একশ বছর পূর্ণ হবে। এ একশ বছরের গোঁড়ামিতে ভরা যে ত্যাগ তা সংগঠনটিকে জাতির ভেতরে জাতি তৈরির ক্ষমতা দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আরএএস হলো পশ্চিম উপকূলের ব্রাহ্মণদের একটা গোষ্ঠী দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি সংগঠন।
বর্তমানে আরএসএসের সদস্য সংখ্যা দেড় কোটি, যাদের মধ্যে মোদি যেমন আছেন তেমনি তার বহু মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালরাও আছেন। এটা এখন রাষ্ট্রের সমান্তরাল একটা রাষ্ট্র। তার নিজস্ব হাজার হাজার প্রাথমিক স্কুল আছে; কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠন আছে। তার একটি প্রকাশনা সংস্থা আছে, যার কাজ হলো বনবাসী আদিবাসীদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে তাদের 'পরিশুদ্ধ' করে হিন্দুত্বের মধ্যে 'ফিরিয়ে' আনা। আরএসএসের বেশ কয়েকটি নারী সংগঠন আছে। মুসোলিনির কালোজামা বাহিনীর আদলে লাখ লাখ সদস্যবিশিষ্ট মিলিশিয়া বাহিনীর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি অকল্পনীয় সহিংসতাবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন সে গড়ে তুলেছে, যাদের কাজ হলো বিভিন্ন সেক্টরে ছায়া সংগঠন হিসেবে কাজ করা এবং মানুষের দৃষ্টি থেকে সত্যটাকে আড়াল করা।
ভারতে যখন দিন দিন চাকরি কমে যাচ্ছে এবং অর্থনীতি একটা বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হচ্ছে তখন বিজেপি অব্যাহতভাবে মোটতাজা হচ্ছে। নির্বাচনী বন্ড নামক চূড়ান্ত অস্বচ্ছ এক ব্যবস্থার বদৌলতে বর্তমানে বিজেপি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে; কারণ এ বন্ড ব্যবস্থা তার জন্য গোপন করপোরেট ফান্ডিংয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতে বিজেপি সমর্থক এবং করপোরেট মালিকানাধীন কয়েকশ টিভি চ্যানেল আছে, যারা সম্ভবত প্রতিটি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে। আর এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে একদল সামাজিক যোগযোগমাধ্যম কর্মী, যারা ট্রলের মাধ্যমে বিকৃত তথ্য প্রচারে বেশ দক্ষ।
এসবের জন্য বিজেপি এখনও আরএএসের সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আরএসএসরূপী জাতির ভেতরের জাতিটি সে ছায়া থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং অচিরেই সে বিশ্ব পরিসরে কাজ শুরু করবে। ইতোমধ্যে বিদেশি দূতেরা আরএসএসের দপ্তরে দলে দলে গিয়ে তাদের পরিচয়পত্র এবং সংগঠনটির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন শুরু করেছে। বিশ্ব পরিসরে বৈধতা পেতে মরিয়া এ সংগঠনটির নতুন লক্ষ্যবস্তু হলো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিপদের বিষয় হলো, এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যারা চালাচ্ছেন তারা বিশ্বাস করেন, যা এমনি এমনি জয় করা যায় না বল্কগ্দাহীন পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে তা সহজেই কিনে নেওয়া যায়।
২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষ উদযাপন ভারতের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর আগের বছর আমরা একটা সাধারণ নির্বাচনে মিলিত হবো। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা আকস্মিকভাবে যে সহিংস কার্যক্রম শুরু হয়েছে তার উৎস সম্ভবত এ বিষয়গুলো। আমাদের স্বপ্নগুলো ঝলসে দেওয়া হয়েছে আর কল্পনাশক্তি দূষিত হয়ে পড়েছে। যদি আরএসএস এ লড়াইয়ে জিতে যায় তাহলে আমাদের এজন্য অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হবে এটা নিশ্চিত। কারণ তখন ভারতের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। নির্বাচন এ জোয়ারের গতিপথ পাল্টাতে পারবে না। কারণ যে সময়ে তা করা দরকার ছিল তা পেরিয়ে গেছে। তবে আগুন আমাদের সবার দোরগোড়ায় চলে এসেছে। আমাদের প্রত্যেককে এ প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হতে হবে।
অরুন্ধতী রায় বুকার প্রাইজপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখক, চিন্তক ও অ্যাকটিভিস্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ এপ্রিল দেওয়া তার বক্তৃতাটি ছাপা হয় মার্কিন অনলাইন সাময়িকী লিটারেরি হাবে। ভাষান্তর:সাইফুর রহমান তপন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com