সুশাসন

মাঠ, নদী, বন দখল এবং উন্নয়নের নতুন সংজ্ঞা

প্রকাশ: ১২ মে ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জাহেদ উর রহমান

করোনার পর দীর্ঘকালীন ছুটি শেষে যখন স্কুলসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলল, তখন ঢাকা আক্ষরিক অর্থেই এক স্থবির নগরীতে পরিণত হয়েছিল। গাড়িতে চড়ে যাওয়ার গতিবেগ কমে এসেছিল হাঁটার চাইতেও। এই অচল ঢাকার সঙ্গে তীব্র গরমে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছিল। ঈদের আপাত শান্তির অবস্থা কেটে কয়েক দিনের মধ্যেই আবার ঢাকা চলে যাবে সেই পরিস্থিতিতে- ভাবতেই আতঙ্ক ভর করে।

দীর্ঘ গবেষণা করে অনেক সংস্থার মাধ্যমে ঢাকা শহরের পরিবহন পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেসব গবেষণার অনেক পরামর্শের মধ্যে মূল পরামর্শ ছিল ব্যক্তিগত গাড়িকে নিরুৎসাহিত করার কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে গণপরিবহনকেন্দ্রিক পরিবহন পরিকল্পনা করা। একটা শহরে যত রাস্তা প্রয়োজন তার তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আছে ঢাকা শহরে। তাই এ শহরকে চালু রাখতে এর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু আমরা করিনি সেটা।

সর্বোপরি ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি একেবারেই, বরং দেশের সবকিছুকে আরও বেশি করে স্রেফ কেন্দ্রীভূত করে ফেলা হচ্ছে ঢাকায়। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে না পারলে পরিবহন নিয়ে যত পরিকল্পনাই করা হোক; আখেরে অচল ঢাকা আর সচল হবে না।

ঢাকার যানজট কমার কোনো আশু পদক্ষেপ আসলে আমরা দেখব না- এটা নিশ্চিত। একটা সমস্যা সমাধান করতে প্রয়োজন সেটাকে এবং সেটার তীব্রতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। সেই স্বীকৃতি দেওয়ার পর সেটা নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। বিষয়টা রোগের মতো। আগে রোগীকে তার রোগ স্বীকার করে নিতে হবে, তারপর তিনি চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে যাবেন; তার পরামর্শমতো চলবেন। মজার ব্যাপার, শারীরিক রোগ মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যতটুকু স্বচ্ছন্দ; মানসিক রোগ মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ততটা নই। তাই আমরা দেখব মানসিক রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে আমরা যেতে চাই না, কিংবা গেলেও সেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলি না। এর মূল কারণ, আমরা রোগটিকে স্বীকার করে নিই না।

বর্তমান অচল ঢাকা দেখে যখন সরকারের দীর্ঘ সময়ের অবহেলা স্বীকার করে নেওয়ার কথা ছিল, তখন একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তো দিয়েছেন নতুন তত্ত্ব- 'আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ায় সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। তাই যানজটও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে উপজেলা পর্যায়েও যানজট সৃষ্টি হবে।' বক্তব্যটি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর।

এমন ব্যক্তিরা মানুষকে ভীষণ নির্বোধ এবং যুক্তিবোধহীন মনে করেন। তারা নিশ্চিত থাকেন এটা ভেবে যে, মানুষ কোনো খোঁজখবর রাখে না। তারা ভাবেন, মানুষ মেনে নেবে যে রাস্তার জ্যাম আর উন্নয়ন সমানুপাতিক। তারা ভাবেন, এই দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ উন্নত ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তার পরিস্থিতির খবর নেই এবং চাইলেও কেউ সেটা পেতে পারে না।

অনুমান করা যায়, সরকারের অন্যরা স্থানীয়

সরকারমন্ত্রীর এ বক্তব্য পছন্দ করবে। কারণ তিনি সংকটকে 'উন্নয়নের সঙ্গে' সংযুক্ত করতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে আমরা অন্যান্য সংকটকে নিয়েও একই রকম ব্যাখ্যা দেখতে পাব।

ঈদের আগে তুমুল আলোচিত তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে এ সংকটের সমাধান হয়েছে কি? বহুদিন ধরে এই মাঠে পুলিশের থানা নির্মাণের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী এবং পরিবেশবাদীদের আন্দোলন হয়েছিল। সর্বশেষ সেই আন্দোলনে খুবই সক্রিয় একজন নারী সৈয়দা রত্না এবং তার সন্তানকে গ্রেপ্তার এবং তারপর সেটা নিয়ে প্রচণ্ড শোরগোল হয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে সরকার সিদ্ধান্তটি থেকে সরে আসে। বাংলাদেশের হালের যে ট্রেন্ড; সেটাকে অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নিতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকেই।

আমি বিশ্বাস করি, অনলাইন-অফলাইনে চরম শোরগোলের মুখে সরকার একটা আপৎকালীন ব্যবস্থা নিয়েছে মাত্র। এমন বিশ্বাসের কারণ হচ্ছে, যেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই মাঠে কোনো স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে না; তখন তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন- এই জমির মালিকানা পুলিশেরই থাকছে। রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একটি জমি কিনেছে। সেটা সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া কোনো সমস্যার বিষয় ছিল না, কিন্তু তা করা হয়নি। সুবিধাজনক কোনো সময়ে এই মাঠে থানা হবে না- সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? চরম দখলের মুখেও ঢাকায় এখনও কিছু মাঠ বাকি আছে দখলের। সেগুলো দখলের চেষ্টা চলছে। বলাবাহুল্য, সেগুলোও দখল হয়ে যাবে অচিরেই।

মাঠ দখল তো তুলনামূলক সহজ। কারণ এখানে ভূমি তৈরিই আছে। ক্ষমতাসীন দলের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দখলদাররা দখল করে ফেলে নদীও। নদীতে বালি-মাটি ফেলে ভরাট করে সেখানে দখলদারিত্ব চালানো এ দেশের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই দেশে দখল হয়ে যায় বনও। হাজার হাজার একর বনভূমি উজাড় করে অবৈধ দখলদারদের কবজায় চলে যাওয়ার খবর দেখি প্রায় নিয়মিত।

ভেবে দেখলাম, এসব দখলেরও একটা বয়ান সরকার তৈরি করতে পারে উন্নয়নকে কেন্দ্রে রেখে। সরকার বলতেই পারে, তাদের উন্নয়নের কারণে মানুষের হাতে এত টাকা গেছে, তারা এখন প্রকাণ্ড সব ভৌত স্থাপনা তৈরি করতে পারে। কিন্তু ছোট্ট বাংলাদেশে এত ধনীর এত অবকাঠামো বানানোর মতো জায়গা নেই। তাই খেলার মাঠ, খাসজমি, নদী, বন- সবকিছুতে তাদের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে।

অবৈধ দখলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তার জবাবে কোনো মন্ত্রী বলতেই পারেন- আওয়ামী লীগ আরেকবার ক্ষমতায় থাকলে অবকাঠামো তৈরির তোড়ে উপজেলায়ও আর ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাবে না। সরকার দাবি করতেই পারে- দখলদারিত্ব উন্নয়নের সমানুপাতিক।

কথাগুলো শুনতে আশা করি খুব উদ্ভট মনে হচ্ছে না। এটাই এখনকার বাংলাদেশ।

ডা. জাহেদ উর রহমান: শিক্ষক ও নাগরিক অধিকারকর্মী

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com