সিনেমায় সুবাতাস

প্রকাশ: ১২ মে ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১২ মে ২২ । ১১:৪২ | প্রিন্ট সংস্করণ

অনিন্দ্য মামুন

'গলুই' ছবির দৃশ্যে সহশিল্পীদের সঙ্গে শাকিব খান

গত কয়েক দশকে আমরা দর্শকের মুখে শুনেছি- দেশের 'চলচ্চিত্রে অশ্নীলতা', 'নকলের দৌরাত্ম্য থেমে নেই', 'সস্তা গল্পের মানহীন ছবি নির্মাণ চলছেই'- এমন অনেক নেতিবাচক মন্তব্য। এখন শোনা যাচ্ছে অনেক আশাব্যঞ্জক কথা। যেমন- 'চলচ্চিত্রের বাঁকবদল হচ্ছে'; 'নতুনরা সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে'; 'স্বল্প বাজেটেও ভালো ছবি সম্ভব, যা এখনকার নির্মাতারা দেখিয়ে দিয়েছেন'। কারণ, এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া চারটি সিনেমার তিনটিই দর্শকদের হলমুখী করেছে। সুস্থ বিনোদনপ্রেমীরা দেশের সিনেমা হলে ফিরে আসছে। দর্শকের হলমুখী হওয়ার সে খবরে সরগরম ফেসবুক ও ইউটিউব। সিনেমা হলে দীর্ঘ কয়েক বছরের বিরতির পর লক্ষ্য করা যাচ্ছে লম্বা লাইন, ভিড়ভাট্টা। যা-ই হোক, এবার একটু পেছন ফিরলে দেখা যাবে, গত চার বছর দেশে একের পর এক নতুন সিনেমা নির্মাণ ও মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর প্রায় প্রতিটিই সিনেমা হলে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে একটা সময় অনেক সিনেমা হলে ঝুলে যায় তালা। টানা লোকসানের মুখে লগ্নিকারক তথা প্রযোজকরাও যখন মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছিলেন, তখনই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। ঈদ উৎসবে হলে ফিরল দর্শক। ফের প্রমাণ হলো, দেশের ভালো সিনেমার দর্শক ছিল এবং আছে।

বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশে হলিউডের 'অ্যাভেঞ্জার্স' সিরিজের সিনেমা দেখার অগ্রিম টিকিট শেষ হওয়ার খবর শুনে আসছে দেশের মানুষ। এবার শুনল দেশি সিনেমার টিকিট শেষ হওয়ার খবর! শুনল সপ্তাহজুড়েই বাংলাদেশের ছবি 'হাউজফুল' শব্দটি। ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো হলো- 'গলুই', 'শান', 'বিদ্রোহী' এবং 'বড্ড ভালোবাসি'। এই ছবিগুলোর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে 'শান'। রাজধানীর হলগুলোতে সপ্তাহজুড়ে হাউজফুল চলছে ছবিটি। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে 'গলুই' ও 'বিদ্রোহী' দর্শক টেনেছে। ফলে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য এই ঈদে দর্শকদের হলমুখী হওয়ার বিষয়টি 'সিনেমা ঘুরে দাঁড়ানোর সবুজ সংকেত' হিসেবে দেখছেন সংশ্নিষ্টরা। তারা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন সিনেমা হল বন্ধ ছিল। পরে হল খুলে যাওয়ায় নতুন নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেও তা হলে না আসায় সিনেমাগুলো একের পর এক ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়। এবারের ঈদে ভালো কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শক হলে টানতে পেরেছে, যা ঢালিউড চলচ্চিত্রের সুবাতাস। হলমুখী এই দর্শকদের এখন নিয়মিত হলে আনতে পরিচালক ও প্রযোজকদের ভাবতে হবে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে সিনেমার সুদিন আসবেই। নইলে দেশের সিনেমা শিল্পের একেবারে বিলুপ্তি ঘটবে। বরেণ্য নির্মাতা কাজী হায়াতের ভাষ্য, 'এবারে ঈদের ছবি দেখার জন্য দর্শক হলে ফিরেছে- এটা আমাদের জন্য দারুণ খবর। এমন খবর আমরা প্রতি সিনেমার বেলাতেই পেতে চাই। নইলে লগ্নিকারকরা সিনেমা বানাতে আসবে না। এই ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষা করা যায়, এর জন্য সবাই মিলে এগোতে হবে। দেশের সিনেমা বাঁচাতে আমাদের শেষ লড়াইটা এবার করা প্রযোজন। তাই এখন নিজেদের মধ্যে রেষারেষি ভুলে চলুন, দর্শকদের জন্য সেরা গল্পের সেরা সিনেমাগুলো নির্মাণ করি।'

দেশীয় সিনেমার বাজার সারাবছর ভালো না থাকলেও বছরজুড়ে রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সে হলিউডের সিনেমার দর্শক বেশি থাকে। তবে এই ঈদে 'শান' ও 'গলুই' সিনেমা দুটি মুক্তির পর সিনেপ্লেক্সের সব শাখাতে ভিন্ন চিত্র দেখেছে কর্তৃপক্ষ। এ প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, "আমাদের এখানে বরাবরই বাংলা সিনেমা চালাতে চাই। কিন্তু ভালো মানের বাংলা ছবি না পাওয়ায় তা সব সময় সম্ভব হয় না। এবারের ঈদে আমাদের সব প্রেক্ষাগৃহে 'শান' ও 'গলুই' মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন থেকে শুরু করে আজ [বুধবার] পর্যন্ত 'শান' হাউজফুল যাচ্ছে। অন্যদিকে 'গলুই' ছবিও প্রতিটি শোতে প্রায় হাউজফুল হচ্ছে, যা শানের চেয়ে কম হলেও আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দর্শক ছবিটি দেখছেন। দুটি ছবি নিয়েই দর্শক ইতিবাচক মন্তব্য করছেন। এটা বাংলা সিনেমার জন্য বড় ব্যাপার। এবার আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো নারী দর্শকের উপস্থিতি।"

সিনেমা হলে দর্শক টানার এই জোয়ারকে আগামী দিনে সিনেমা নির্মাণ ও প্রযোজক ফিরে আসার বড় নিয়ামক হিসেবে দেখছেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা তপু খান। তিনি বলেন, 'লিডার- আমিই বাংলাদেশ' ছবি নির্মাণ করেছি আমি। ছবিটি মুক্তির অপেক্ষায়। এত দিন সিনেমা হলে দর্শক আসা নিয়ে অনেকটা সংশয়ে ছিলাম। এবারের ঈদের ছবি দেখতে দর্শক যেখানে প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছেন, এতে আমার সে ধোঁয়াশা কেটে গেছে। ভালো গল্পের সিনেমা হলে দর্শক দেখতে আসবেন- এটা আবারও প্রমাণিত হলো। আশা করি, আগামীতে এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। আমরাও ভালো ভালো সিনেমা দর্শকদের উপহার দেব।

বরাবরের মতো এবারও ঈদে দুই ছবি নিয়ে রাজত্ব ছিল শাকিব খানের। তার অভিনীত 'গলুই' ২৮টি হলে আর 'বিদ্রোহী' মুক্তি পায় ১০৩ হলে। তার সঙ্গে এবারে শাকিবের এই রাজত্বে পা রাখেন তরুণ নায়ক সিয়াম আহমেদ। তার অভিনীত 'শান' মুক্তি পায় ৩৪ হলে। শাকিবের দুই ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে ছিলেন না সিয়াম। নিজেকে ভেঙে অ্যাকশন হিরো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আর শাকিব তো শাকিবই। উৎসব ছাড়াই হলে তার ছবি মুক্তি পাওয়ায় ফিরে আসে উৎসবের আমেজ।

সিনেমা প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, "হলে মানুষ আসা শুরু করেছে। এখন পরিচালক ও প্রযোজকদের উচিত ভালো সিনেমা নির্মাণ অব্যাহত রাখা। ঢাকায় 'শান'-এর দর্শক বেশি। কারণ, ঢাকায় ভালো হলগুলো সে পেয়েছে। আবার গ্রামগঞ্জের মানুষ সিঙ্গেল স্ট্ক্রিনে 'গলুই' ও 'বিদ্রোহী' বেশি দেখছে। ফলে বলা যায়, আমাদের সিনেমায় সুবাতাস চলছে। ক্রমশ তা সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়।"


দর্শক রুচির পরিবর্তন হচ্ছে
মাসুদ পারভেজ

ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমা নিয়ে চলছে নানা রকম হৈচৈ। অনেককে বলতে শুনি, দর্শক আবার হলে ফিরে এসেছেন। এটা আমি মানতে নারাজ। যারা এটি বলছেন, তারা সঠিক বলছেন না। অবুঝের মতো বলছেন। কারণ, কোনো জিনিস ফিরিয়ে আনা যায় না। দুই বছর পর্যন্ত মানুষ ঘরবন্দি ছিল। করোনা কমায় বিনোদন কেন্দ্রে যাচ্ছে তারা। সবাই মুক্তির স্বাদ নেওয়ার জন্য চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কিছু দর্শক প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখছেন। এর মধ্যে ভবিষ্যৎ চিন্তা, কল্পনা- কোনো কিছু দেখছি না। আমরা চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের কথা সব সময়ই বলি। ওই সময়ে দর্শকের বিনোদনের মাধ্যম কম ছিল। মানুষ সিনেমা নিয়েই ভাবত। এখন বিনোদনের মাধ্যম বেড়েছে। তবে অতীতের নিজস্ব স্মৃতি মনে রেখে আগামী দিনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। সময়ের সঙ্গে দর্শক রুচির পরিবর্তন হচ্ছে। নতুনত্বকে দর্শক গ্রহণ করছেন। আলাদা দর্শক তৈরি হচ্ছে। আর দর্শক হলমুখী হয়েছে- এর প্রমাণ কী? আগে ১ হাজার ৭০০ সিনেমা হল ছিল, তা নেমে এসেছে ২০০-তে। ঈদে কয়টি হলে ছবি মুক্তি পেয়েছে? চারটি সিনেমার মধ্যে মাত্র একটি হলে মুক্তি পেয়েছে একটি সিনেমা। ওই একটি হল থেকে প্রযোজক কত টাকা পাবেন। যেসব হলে সিনেমা চলছে, তার সপ্তাহ শেষে মোট সেল কত? অনেক হল তো খুবই ছোট। আমার আশায় বাঁচি। করোনা পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নিলে দর্শক স্বতঃস্টম্ফূর্ত হলে আসবেন- এখন সেই আশায় দিন গুনছি।


ছবি দেখে দর্শক আনন্দ পাচ্ছেন
মতিন রহমান

দর্শক এবার ঈদের সুনির্মিত ছবিগুলো দেখে আনন্দিত। এটা সুখবর। গল্প বাছাই ও গল্প বলার ধরন ভালো ছিল বলেই তারা প্রেক্ষাগৃহে এসে ঈদে সিনেমা দেখছেন। আগে ঈদ উৎসবে সিনেমা মুক্তির ধুম পড়ে যেত। ভালোবাসার গল্প নিয়ে 'গলুই'-এর মতো সিনেমা হতো। রোজার পরে অ্যাকশন সিনেমা দেখতে চাইত না দর্শক। যে জন্য প্রেমের সিনেমা কে কত ভালো বানাতে পারেন, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত। বছরের শুরুতে নির্মাতারা ঈদে ছবি মুক্তি দেবেন- এ চিন্তা মাথায় নিয়ে এগিয়ে যেতেন। অনেক আগে থেকেই শুরু হতো প্রচার-প্রচারণা। শিল্পীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। সেই দিনগুলো হারিয়ে ফেলেছি। ঈদ আয়োজনে বিকল্পধারা, ওটিটির সিনেমা নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করেছি। নতুন নির্মাতাদের কাজ দেখে আমি মুগ্ধ। পাশাপাশি প্রচুর সম্ভাবনাময় শিল্পী তৈরি হয়ে গেছে। তাদের কাজ নিয়ে যদি এককথায় বলতে হয় তাহলে বলব 'চমৎকার'। তরুণ প্রজন্মের নির্মাতা অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করি। তাদের চিন্তা, গল্পকথন, গল্প নির্মাণ ভালো হচ্ছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে আমাদের আধুনিক মনস্ক হতে হবে। যেতে হবে চিন্তার জগতে। তা না হলে আমাদের মতো প্রথারীতির নির্মাতারা পিছিয়ে পড়ব। ইন্ডাস্ট্রি আমাদের যতই সহযোগিতা করুক না কেন, কোনো লাভ নেই। আমাদের মানসিক জগৎকে আরও উন্নত করতে হবে। পুরোনো জালবন্দি, তারকা পূজা থেকে আমরা যদি বেরিয়ে আসতে না পারি, তাহলে সিনেমা ভালো জায়গায় দাঁড়াবে না।


সিনেমা শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে
মোস্তাফিজুর রহমান মানিক

করোনার প্রাদুর্ভাব কমায় খুবই প্রত্যাশা ছিল যে দর্শক ঈদের সিনেমা দেখবেন। প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। ঈদের সিনেমা দর্শককে হলমুখী করতে পেরেছে। কনটেন্ট ভালো ছিল বলেই দর্শকের উপচে পড়া ভিড় ছিল হলে। এটা বড় আশাব্যঞ্জক খবর। সবাই আনন্দ নিয়ে ছবি দেখছেন। আমি মধুমিতা হলে এম এ রাহিম পরিচালিত 'শান', স্টার সিনেপ্লেক্সে এস এ হক অলিকের 'গলুই', চিত্রামহলে সেলিম খানের 'বিদ্রোহী' দেখেছি। 'বড্ড ভালোবাসি' সিনেমা একটি হলে মুক্তি পেয়েছে বলে এটি নিয়ে তেমন আলোচনা ছিল না। অনেক দর্শকই ছবিটি দেখেননি। 'শান' ও 'গলুই' সিনেমায় দর্শক সাড়া বেশি ছিল। আগে প্রেক্ষাগৃহে ঈদের সিনেমা দুই-তিন মাসও চলত। পরিবার নিয়ে দর্শক সিনেমা দেখতেন বলেই এমনটি হয়েছে। আশার কথা, অনেকে পরিবার নিয়েও হলে সিনেমা দেখতে এসেছেন। দর্শকদের হলমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কোরবানির ঈদে নির্মাতারা সিনেমা মুক্তি দিতে আগ্রহী হবেন। প্রতিযোগিতা বাড়বে। সারা পৃথিবীতে করোনার প্রাদুর্ভাব কমায় সিনেমায় ভালো ব্যবসা হচ্ছে। আর দর্শকের সিনেমা দেখার ক্ষুধা ছিল। হলের পরিবেশ ও কনটেন্ট ভালো পেলে সবাই আবার সিনেমা দেখতে হলে যাবেন বলে আমি মনে করি। ঈদের সিনেমা নিয়ে সবার আগ্রহ থাকে বলেই যে কান সিনেমা আলাদা প্রচার পায়। এ প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে। আমি আশাবাদী মানুষ। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের সিনেমা শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com