
মাসে ৬ অপরিণত শিশুর মৃত্যু বিনা চিকিৎসায়
চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যসেবা
প্রকাশ: ২৬ মে ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৬ মে ২২ । ০১:৫৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে প্রতিদিনই গড়ে ছয় থেকে আটজন অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশের জন্ম হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে। আর অপরিণত শিশুর প্রাণ বাঁচাতে নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ) সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলেও স্বাধীনতার এত বছর পরও সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি জরুরি এই সেবা। সহজলভ্য হয়নি দেশের শিশু স্বাস্থ্য সেবাও। চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর কোনোটিতেই নেই এনআইসিইউ সেবা। শুধু এই সেবার অভাবেই প্রতি মাসে গড়ে প্রাণ ঝরছে কমপক্ষে ছয় অপরিণত শিশুর। বেসরকারিভাবে শহরের কিছু হাসপাতালে এই সেবা মিললেও শুধু এনআইসিইউ শয্যা বাবদ ভাড়া গুনতে হয় দিনে অন্তত ২০ হাজার টাকা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর জন্ম নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ শিশুর ১৪ লাখের মধ্যে ১৭ হাজারই মারা যাচ্ছে। বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ ও স্বল্প ওজন।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ জন অপরিণত শিশু জন্ম নেয়। তাদের মধ্যে ২৩ হাজার ৬০০ শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। অপরিণত শিশু জন্মের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ১০ দেশের মধ্যে সপ্তম।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত ৭৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ নারী অপরিণত শিশু জন্ম দিয়েছেন। এই মায়েদের ১ দশমিক ২ ভাগ শিশুকে এনআইসিইউতে রাখতে হয়েছে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস, হরমোন ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে অপরিণত শিশু জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। অপরিণত নবজাতক প্রতিবন্ধী হতে পারে এবং সবকিছুই দেরিতে করবে। তবে যারা দ্রুত চিকিৎসা নেয়, তাদের অনেকে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে।
অপরিণত নবজাতকের প্রধান সমস্যাগুলোর আরেকটি হলো রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিউরিটি (আরওপি)। তবে এই পরীক্ষার সুযোগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখনও 'দুঃস্বপ্ন'। অপরিণত শিশুমৃত্যু কমাতে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) একটি বড় পদক্ষেপ। কিন্তু সেটির সুযোগও নেই সরকারি হাসপাতালে। তাই মায়ের কাছ থেকে শিশুদের আলাদা রেখেই এখনও দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা।
চমেকে দৈনিক গড়ে ভর্তি ৮ শিশু :চমেক হাসপাতালের এনআইসিইউ বিভাগে গত এক বছরে ২৭৮১ জন অপরিণত শিশু ভর্তি হয়েছে। এ হিসাবে মাসে গড়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৩২ জন। আর প্রতিদিন এ সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ৮ জন। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের ও চট্টগ্রাম শহরের ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের ১১ শতাংশ, পার্বত্য এলাকার ৪ শতাংশ, কক্সবাজারের ৪ শতাংশ এবং সন্দ্বীপ ও ভোলার ২ শতাংশ রয়েছে। গত এক বছরে মা ও শিশু হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে আড়াই হাজার অপরিণত শিশু ভর্তি হয়েছে।
চিকিৎসাকেন্দ্র দূরে, যথাসময়ে মেলে না সেবাও :চট্টগ্রাম অঞ্চলের একমাত্র ভরসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত মা ও শিশু হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রতি মাসে গড়ে ৪ থেকে ৬ শিশুর মৃত্যু হওয়ার তথ্য মিলেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি হিসাবেই হাসপাতালে ভর্তিবস্থায় গত এক বছরে ৫৬৮ অপরিণত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ হিসাবে মাসে গড়ে মারা গেছে অন্তত ৪৭ জন।
চট্টগ্রাম শহর থেকে সাতকানিয়া উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৬১ কিলোমিটার। সেখান থেকে শহরে আসতে লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। দুই মাস আগে নলুয়া ইউনিয়নের এক বাসিন্দার অপরিণত দুই যমজ কন্যার জন্ম হয়। জন্মের এক ঘণ্টার ব্যবধানে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে যায়। দরকার হয়ে পড়ে এনআইসিইউ। তিন ঘণ্টা পর চমেকে এনে ভর্তি করলেও শিশুটিকে আর বাঁচানো যায়নি। এ জন্য বিলম্বে ভর্তির বিষয়টিকে দায়ী করেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া ১১ বছর পর সন্তানের মুখ দেখলেও এনআইসিইউর অভাবে সেই সন্তানকেও হারান আরেকটি পরিবার। শিশুটিকে হাসপাতালে আনা হলেও শয্যা খালি ছিল না।
ব্যয়বহুল চিকিৎসা :চট্টগ্রাম শহরের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে সামান্য কিছু এনআইসিইউ শয্যা থাকলেও একদিনে শুধু শয্যা বাবদ গুনতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। চমেক হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে অনুমোদিত শয্যা মাত্র ৩২টি। কয়েক দফা বাড়িয়ে সেটি একশটি করার পরও সংকট কাটেনি। প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি থাকে এখানে। মা ও শিশু হাসপাতালে বিশেষায়িত ২২টিসহ ৫২টি এনআইসিইউ শয্যা থাকার পরও প্রতিদিন অনেক মুমূর্ষু শিশুকে ফিরে যেতে হয়।
বাড়ছে না চিকিৎসার সুযোগ :চমেক হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জগদীশ চন্দ্র দাশ সমকালকে বলেন, অপরিণত নবজাতকের জন্মের হার বাড়লেও বাড়ছে না চিকিৎসার সুযোগ। এই অঞ্চলে একমাত্র চমেক হাসপাতালেই রয়েছে এনআইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার সুযোগ। শয্যা খালি না থাকায় প্রতিদিন অনেক শিশুকে ভর্তির সুযোগ দিতে পারি না। বাধ্য হয়ে এক শয্যায় পালা করে কয়েকজন শিশুকে চিকিৎসা দিতে হয়। গ্রামে চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এ ছাড়া এত সংখ্যক রোগীর জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্সও।'
মা ও শিশু হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মু. জিয়াউর রহমান বলেন, গ্রাম থেকে শহরে আসতে আসতে বা ভর্তির পর অনেকের মৃত্যু হয়। মাসে এমন অনেক সংকটাপন্ন শিশু আসে যাদের তাৎক্ষণিক এনআইসিইউর প্রয়োজন হয়। শয্যা খালি না থাকায় কিছুই করার থাকে না।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, কোনো উপজেলায় অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো এনআইসিইউ সেবার উপযুক্তও নয়।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com